ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মুক্তিযুদ্ধের কথকতা

প্রকাশিত: ০৬:০০, ৬ নভেম্বর ২০১৫

মুক্তিযুদ্ধের কথকতা

সম্প্রতি ঢাকা সফরের সময় হাতে আসে ‘মুক্তিযুদ্ধের কিছু কথা’ নামে একটি ব্যতিক্রমী বই। নীলুফার বেগমের বইটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ও যুদ্ধ সংশ্লিষ্ট কয়েকটি লেখা নিয়ে সাজানো। এই সংকলনটি ব্যতিক্রমী এই কারণে যে এটিতে একই সঙ্গে ১৯৭১ ভিত্তিক নিবন্ধ স্মৃতিকথা এবং গল্প সন্নিবেশিত হয়েছে। লেখকের এই অভিনব প্রয়াসকে স্বাগত জানাতে হয় কেননা এর মধ্য দিয়ে তিনি ’৭১ কে দেখাতে পেয়েছেন একটি বহুমাত্রিকতায়। নিবন্ধের পাশে স্মৃতিকথা, গবেষণালব্ধ লেখনীর পাশে গল্পের স্বচ্ছন্দ অবস্থান তৈরি হয়েছে এই সংকলনে। লেখার উপজীব্য হিসেবে ‘যুদ্ধ’ বিশেষ করে ‘মুক্তিযুদ্ধ’ একটি কঠিন বিষয়বস্তু। যুদ্ধ কোন নিছক ঘটনা নয় যে তা সাদামাটাভাবে উপস্থাপন বা বর্ণনা করা যায়। যুদ্ধের ঠরড়ষবহপব বা ভয়াবহতার প্রকৃতি এমন যে সেই ভয়াবহতাকে ভাষার মোড়কে ধারণ বা আটকে ফেলা সম্ভবপর হলেও তা খুব সহজ কোন কাজ নয়। তাই একমাত্রিকতায় নয়- বহুমাত্রিকতার সাহায্য নিয়েছেন লেখক। কখনো স্মৃতি হাতড়ে, কখনো তথ্য সাজিয়ে, কখনো সাহিত্যরসের আশ্রয় নিয়ে ‘অবর্ণনীয়কে’ বিধৃত করেছেন। অর্বচনীয়কে ব্যক্ত করেছেন। তার উদ্দেশ্য মুক্তিযুদ্ধের কথাকে ফুরোতে না দেয়া, যার অর্থ হচ্ছে আমাদের ‘কথা’গুলোকে লেখার অক্ষরে স্থায়িত্ব এনে দেয়া। আমাদের মুখের কথা, স্মৃতির কথাকে সযতেœ লালন করে, এর প্রসার ও পরিচিত দেয়া। এই অর্থে ‘মুক্তিযুদ্ধের কিছু কথা’ নামকরণটিও অত্যন্ত সার্থক। বইটি যে শুধুমাত্র ঋড়ৎস এর দিক থেকেই ব্যতিক্রমী, তা নয়। লেখক ১৯৭১-এর ‘মুক্তিযুদ্ধকে’ একটি ঈষড়ংবফ বা আবদ্ধ ঘধৎৎধঃরাব-এ পরিণত করেননি। বইটিতে তিনি একটি বিশেষ কালকে তুলে ধরেছেন। সেই প্রজন্মকে মন, বিশেষ বিশ্বাস ও দেশপ্রেমের আয়না আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন। পরবর্র্র্র্র্র্র্র্র্র্তী প্রজন্মের মানুষকে বার বার আহ্বান করেছেন সেই আয়নাকে সামনে নিয়ে নিজেদের অবয়বকে যাচাই করে নিতে। আমাদের সমাজের তিক্ততা, দ্বন্দ্ব, বিভাজন-আসক্তির মুখে তিনি দায়িত্বশীল বয়োজ্যেষ্ঠের মতো নতুন প্রজন্মকে শুনিয়েছেন রউফ, রাবিয়া, সাত্তার, রমিজ, গেনুর মার কথা। শুনিয়েছেন ১৯৭১-এ দেশের মানুষের ত্যাগ ও সংগ্রামের কথা, জানিয়েছেন বাংলাদেশের মানুষদের আত্ম-অন্বেষণের সুবর্ণ গৌরব গাথা। লেখকের আশা যে নতুন প্রজন্ম এর থেকে শিক্ষা নেবে, অনুপ্রেরণা পাবে। এই অর্থেই বইটিকে এক ধরনের ঙঢ়বহ হধৎৎধঃরাব বলা যায়। কেননা নীলুফার বেগম চেয়েছেন এক সময়ের আলো আরেক সময়ের মানুষদের জন্য বাতিঘরের মতো কাজ করুক। বইটি থেকে এই সময়ের তরুণরা জানবে যুদ্ধে যাওয়া তাদের পূর্ব পুরুষদের কিংবদন্তি সুলভ বীরত্ব গাথা, একই সঙ্গে জানবে তাদের পূর্বতনদের সহজ, আটপৌরে, আড়ম্বরহীন দৈনন্দিন জীবন যাপনের কথা। দেখবে কিভাবে এদেশের সন্তানরা অস্ত্র হাতে বা মায়েরা ভাতের সানকি হাতে একটু একটু করে একটি মানচিত্র গড়ে তুলেছিলেন। বইটিতে লেখক যাদের তুলে ধরেছেন ’৭১-এর মুখায়ব হিসেবে তাদের সকলের মধ্যে একটি বিশেষ মিল। অন্যকে তারা সাহায্য করেছেন অকৃপণ হাতে, দেশকে রেখেছেন সব কিছুর ঊর্ধে, নিজের স্বার্থকে সর্বোপরি তুচ্ছ জেনেছেন। এসব গুণাবলী মানুষে-মানুষে আত্মার বন্ধনকে প্রগাঢ় করে, জাতীয় ঐক্যবোধ গড়ে তোলে। যার ফলে ১৯৭১-এর স্বাধীনতার স্বপ্ন বাস্তবে পরিণত হয়। অন্যের প্রতি কর্তব্য ও শ্রদ্ধাবোধ, শুভবুদ্ধির জাগরণ, সাদামাটা জীবনাভ্যাস এবং দেশের প্রতি প্রশ্নাতীত ভালোবাসা ছিল অনেক মানুষের মধ্যে বলেই আমরা আমাদের নিজেদের দেশ অর্জন করতে পেরেছি-এই সহজ পাঠটি নীলুফার বেগম দিতে চেয়েছেন। সঙ্গে আমরা পাই অন্য কিছু বাড়তি প্রাপ্তি : বর্ষাস্নাত রমিজের পর্ণকুটিরে লাল ভাতের মৌতাত। ‘উজানী কই মাছ’ নামের গল্পটিতে। অন্যান্য লেখায় আগেও লিখেছি-নীলুফার বেগম যেভাবে বাংলাদেশের কথা তার ছোট গল্পে বলেন- তেমনটি আর কাউকে করতে দেখি না। নুজহাত আমিন
×