ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

কড়া নিরাপত্তায় বান্দরবানের আলীকদমে ৭৯ সদস্যের অস্ত্র জমা ॥ সংগঠন বিলুপ্তির অঙ্গীকার

অবশেষে পাহাড়ী সন্ত্রাসী গ্রুপ এমএনপির আত্মসমর্পণ

প্রকাশিত: ০৫:২৫, ৬ নভেম্বর ২০১৫

অবশেষে পাহাড়ী সন্ত্রাসী গ্রুপ এমএনপির আত্মসমর্পণ

মোয়াজ্জেমুল হক, চট্টগ্রাম/এস বাসু দাশ, বান্দরবান ॥ পাহাড়ে শান্তি বাহিনীর পর সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপ এমএনপি অবশেষে আত্মসমর্পণ করেছে। দীর্ঘ ৫ বছর সময় ধরে অপহরণ, খুন, মুক্তিপণ আদায়, অস্ত্র বেচাকেনাসহ সহিংস তৎপরতার অবসান ঘটিয়ে বান্দরবানের ম্রো সম্প্রদায়ের গড়া ম্রো ন্যাশনাল পার্টি (এমএনপি) বৃহস্পতিবার দুপুরে অস্ত্রসহ আত্মসমর্পণ করে। পাশাপাশি অঙ্গীকার করেছে আগামীতে তাদের দাবি দাওয়া বাস্তবায়ন হলে এই সংগঠনটির বিলুপ্তি ঘোষণা করা হবে। ১৯৯৭ সালে খাগড়াছড়িতে শান্তি বাহিনীর সশস্ত্র আত্মসমর্পণের ঘটনার পর পাহাড়ে সন্ত্রাসী গ্রুপের নতুন করে আত্মসমর্পণের এটি দ্বিতীয় ঘটনা। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সিভিল প্রশাসনের সহায়তায় ম্রো সম্প্রদায়ের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে দীর্ঘদিন আলাপ আলোচনা চালানোর পর এ সফলতা এসেছে বলে প্রশাসন সূত্রে দাবি করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার দুপুরে আলী কদম উপজেলার দুর্গম কুরুকপাতা বাজারে কড়া নিরাপত্তা প্রহরা ও বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানমালার মাধ্যমে এমএনপির ৭৯ সদস্য আত্মসমর্পণ করে। আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের আগে তাদের রক্ষিত ৫৫টি বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র সেনাবাহিনীর হাতে অর্পণ করে। এ অনুষ্ঠানে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী বীর বাহাদুর এমপি প্রধান অতিথি ছিলেন। এ ছাড়া সেনাবাহিনীর ২৪ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি এবং চট্টগ্রাম অঞ্চলের এরিয়া কমান্ডার মেজর জেনারেল শফিকুর রহমান, সেনাবাহিনীর বান্দরবান রিজিওন কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নকিব আহমেদ চৌধুরী, বান্দরবান জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ক্য শৈ হ্লা, জেলা পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান, আলী কদম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ আল আমিনসহ স্থানীয় প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে এমএনপি সদস্যদের পক্ষ থেকে দেশীয় তৈরি বন্দুক, পিস্তল, রাম দা, ধনুকসহ বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র সেনাবাহিনীর হাতে হস্তান্তর করা হয়। আত্মসমর্পণ করার জন্য এমএনপির ২ সদস্যকে ২০ হাজার টাকা করে এবং অন্য ৭৭ সদস্যদের প্রত্যেককে ১০ হাজার টাকা হারে নগদ অর্থ প্রদান করা হয়। অনুষ্ঠানের শুরুতে আত্মসমর্পণকৃত ৭৯ সদস্যের ফুলের মালা দিয়ে বরণ করা হয়। এরপর একে একে মন্ত্রী ও সেনা কর্মকর্তারা বক্তব্য রাখেন। সরকার পক্ষে তাদের ধন্যবাদ জানিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসে প্রয়োজনীয় কর্মসংস্থানের আশ্বাস প্রদান করা হয়। ম্রো সন্ত্রাসী গ্রুপের সদস্যদের আত্মসমর্পণ ঘটনার পর বান্দরবানের সর্বত্র স্বস্তি নেমে এসেছে। স্থানীয় মানুষের ধারণা, সন্ত্রাসী এ গ্রুপটি অস্ত্রের পথ পরিহার করে আলোর পথ ধরে এগিয়ে যাবে। প্রসঙ্গত, বান্দরবানের আলী কদম ও থানচির গহীন অরণ্য এলাকায় ম্র্রো সম্প্রদায়ের অধিকাংশ সদস্যের বসবাস। পার্বত্য চট্টগ্রামে যে ১১টি নৃগোষ্ঠীর সদস্যদের অবস্থান রয়েছে তার মধ্যে বান্দরবানে মার্মা, ম্রো, চাকমা ও ত্রিপুরাদের আধিক্য রয়েছে। এর মধ্যে মার্মা সম্প্রদায়ের সদস্যদের সংখ্যা সর্বাগ্রে। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে ম্রো সম্প্রদায়। উল্লেখ্য, বান্দরবানের ম্রো অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে পর্যটনের উন্নয়নসহ বিভিন্ন কারণে সরকার ও বহিরাগতদের জমি দখলের প্রতিবাদে ২০১০ সালে ম্রো ন্যাশনাল পার্টি (এমএনপি) গঠন করা হয়। স্বাধিকার আন্দোলনের নামে এ সংগঠন গঠিত হলেও শেষ পর্যন্ত এটি একটি সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপে পরিণত হয়। এমএনপির মধ্যে আবার উপগ্রুপও রয়েছে। বান্দরবানে বিভিন্ন সময়ে যে সমস্ত অপহরণ, খুন, গুম, মুক্তিপণ আদায় করে ছেড়ে দেয়াসহ নানা সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটেছে এর অধিকাংশের সঙ্গে এমএনপির সদস্যরা জড়িত ছিল। এদের অন্তর্কোন্দলে খুন হয়েছে এমএনপির প্রতিষ্ঠাতা মেনরুং ম্রো এবং তার সেকেন্ড ইন কমান্ড পালে ম্রোসহ কমপক্ষে ২৫ নেতাকর্মী। প্রতিষ্ঠাতা মেনরুং ম্রোর হত্যাকা-ের পর এদের মধ্যে দ্বিধাবিভক্তি সৃষ্টি হয়। এ সম্প্রদায়ের জমিজমা দখল বন্ধ করা, বিভিন্ন সমস্যার সমাধান এবং ক্রামা ধর্ম প্রচারের ব্যানারে এমএনপি এলাকার পোয়া মুহুরী-দুয়াছড়িসহ বিভিন্ন এলাকায় চাঁদাবাজি, হত্যা, গুম, অহপরণসহ, অস্ত্র বেচাকেনাসহ নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়ে। ২০১২ সালের এমএনপি প্রধান মেনচিং ম্রো গ্রেফতার হওয়ার পর পালে ম্রো এ সংগঠনের পরিচালনার দায়িত্ব নেয়। একই বছরের ৫ এপ্রিল কর্তৃপক্ষের হামলায় প্রাণ হারায় সংগঠন প্রতিষ্ঠাতা মেনরুং ম্রো এবং ৭ জুন তার সেকেন্ড ইন কমান্ড পালে ম্রো আলী কদমের দুর্গম পাহাড় ভাঙ্গা গ্রামে প্রতিপক্ষের গুলিতে প্রাণ হারায়। পরবর্তীতে ২০১২ সালে সেনাবাহিনী, বিজিবি এবং পুলিশের লাগাতার অভিযানে এমএনপির ৩৭ সদস্য গ্রেফতার হয় এবং ৪২ জন আত্মসমর্পণ করে। এদিকে বিভিন্ন সূত্রের তথ্যানুযায়ী, ম্রো সম্প্রদায়ের সদস্যরা তাদের জমিজমা রক্ষা ও সুষ্ঠু জীবনযাপন করতে গিয়ে নানা প্রতিবন্ধকতার শিকার হয়ে তাদের নেতাদের আহ্বানে এমএনপি নামের সংগঠনটি গড়ে তুলেছিল। এ সম্প্রদায়ের কিছু অংশ আধুনিক জীবনের ছোঁয়া পেলেও অধিকাংশই রয়ে গেছে অরণ্যে। এরা স্বাভাবিক জীবনমানের উন্নয়ন থেকে বঞ্চিত রয়েছে। ম্রো সম্প্রদায়ের যুবকদের মধ্যে হতাশা, নানা অভিযোগকে পুঁজি করে এমএনপি গঠিত হলেও এরা নিজেদের ভাগ্য উন্নয়নে তৎপর হয়। ফলে তাদের মাঝে গ্রুপিং সৃষ্টি হয়। এ গ্রুপিংয়ের শিকার হয়ে সংগঠনটির দুই শীর্ষ নেতা প্রাণ হারান। বান্দরবানের আলী কদমের দুর্গম পাহাড়ী এলাকার একটি পাহাড়ী চূড়ায় এদের সদর দফতর স্থাপন করা হয়। দীর্ঘদিন ধরে এদের ক্যাডার রিক্রুট এবং প্রশিক্ষণ পরিচালিত হয়ে আসছিল। সংগঠন চালানোর জন্য এরা সশস্ত্র সহিংসতায় নেমে পড়ে। শুরু করে খুন, গুম, চাঁদাবাজি, অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় ও অবৈধ অস্ত্র বিক্রির ব্যবসা। প্রসঙ্গত, ২০১০ সালে এ স্বাধিকার আন্দোলনের নামে সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা হলেও অল্প সময়ের মধ্যেই তাদের মধ্যে অন্তর্কোন্দল শুরু হয়। সংগঠন প্রধান মেনরুকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। মেনরুংয়ের মৃতদেহকে খ- খ- করে মাটিচাপা দেয় বিক্ষুব্ধ প্রতিপক্ষের সদস্যরা। এ ঘটনার পর গত ৬ এপ্রিল সেনাসদস্যরা দুর্গম কুরুকপাতা-পোয়ামুহুরী এলাকার মধ্যবর্তী মেনচিংপাড়ায় অভিযান চালায়। অভিযানে বন্দুক, গুলি, সোলার প্যানেল, ল্যাপটপসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম উদ্ধার হয় এবং গ্রেফতার হয় ১০ জন। এদের মধ্যে ৪ জন এখনও জেলহাজতে রয়েছে। সংগঠন প্রধান মেনরুং ম্রো নিহত হওয়ার পর সেনাবাহিনী আলী কদম জোনের পোয়ামুহুরী ক্যাম্পে আত্মসমর্পণ করে এমএনপির ৪২ সদস্য। পরে আরেক অভিযানে গত ৮ মে পোয়ামুহুরী ইয়াংরিং মুরুং কারবারীপাড়া থেকে ৭টি তাজা বন্দুক, একটি পিস্তল, বল্লম, গানপাউডার, কেমিক্যাল ও অস্ত্র তৈরির বিভিন্ন সরঞ্জামসহ ৭ মুরুংকে আটক করা হয়। আটককৃতদের জিজ্ঞাসাবাদের পর পোয়ামুহুরীর মেনচিংপাড়ার দুর্গম অরণ্য থেকে নিহত মেনরুংয়ের মাটিচাপা লাশের কঙ্কাল উদ্ধার করা হয়। বান্দরবান জোনে কর্মরত সেনা কর্মকর্তাদের আপ্রাণ চেষ্টার ফলে এবং ম্রো সম্প্রদায়ের শিক্ষিত কিছু নেতৃস্থানীয়দের সহায়তায় শেষ পর্যন্ত ম্রো সন্ত্রাসীরা আত্মসমর্পণের পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়। আত্মসমর্পণের পূর্বে সেনা প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ম্রোদের পক্ষে ২ জন প্রতিনিধি সর্বক্ষণিক প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে তাদের স্বার্থ সংরক্ষণের চেষ্টায় তৎপর থাকবে। ফলাফল ইতিবাচক হলে একপর্যায়ে তারা এমএনপির বিলুপ্তি ঘোষণা করা হবে।
×