ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সাবেক ছিটের অর্থনীতি ২;###;সহজ শর্তে ঋণ ও কর্মসংস্থানের চিন্তাভাবনা সবার মনে

উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন অনেকেই

প্রকাশিত: ০৫:২২, ৬ নভেম্বর ২০১৫

উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন অনেকেই

রহিম শেখ, দহলা খাগড়াবাড়ী, পঞ্চগড় থেকে ফিরে ॥ এখন স্বপ্নটা অনেক বড়। এতদিন নিজের সঙ্গে সঙ্গে স্বপ্নটাও বন্দী ছিল। সেই বন্দী জীবন থেকে আজ অনেক বড় উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখেন নূর বানু। তার এই স্বপ্ন পূরণের সারথী হয়েছে একটি সেলাই মেশিন। যা তিনি ক’দিন আগে একটি বেসরকারী ব্যাংকের সহায়তায় পেয়েছেন। বছর দুয়েক আগে দর্জির কাজে প্রশিক্ষণও নিয়েছিলেন তিনি। আর পেছনে নয়, এবার সামনের দিকে এগিয়ে যেতে চান তিনি। পঞ্চগড় জেলার দেবীগঞ্জ উপজেলার ১নং দহলা খাগড়াবাড়ী গ্রামের বাসিন্দা নূর বানুর মতো অনেকেই এখন স্বপ্ন দেখেন উদ্যোক্তা হওয়ার। অধুনালুপ্ত ছিটমহলে নারীদের পাশাপাশি অল্প বয়স্ক তরুণ-তরুণীরাও উদ্যোক্তা হতে চান। সহজ শর্তে চান ব্যাংক ঋণ, কেউ চায় কর্মসংস্থান। গ্রামের বাসিন্দারা বলছেন, এখানকার ছিটমহলগুলোর উন্নয়ন ঘটাতে হলে সবার আগে শিক্ষিত বেকার যুবক-যুবতীদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। তাদের উদ্যোক্তা হওয়ার সুযোগ করে দিতে হবে। দেশের সর্ব উত্তরের প্রান্তিক ও তিন দিক থেকে ভারত বেষ্টিত জেলা পঞ্চগড়ে রয়েছে ৩৬টি ছিটমহল। পঞ্চগড় জেলার সদর উপজেলা, বোদা, দেবীগঞ্জ তিন উপজেলায় গাড়াতি, শিংগীমারী, নাটকটোকা, বেহুলাডাংগা, বালাপাড়া খাসবাড়ি, কোট ভাজনি, দহলা খাগড়াবাড়ি, কাজলদিঘি, পুটিমারী, নাজিরগঞ্জ, দৈখাতা ও শালবাড়িসহ ছোট বড় ৩৬টি ছিটমহল। ১১ হাজার ৯শ’ ৩২ দশমিক ৮০ আয়তনের এসব ছিটমহলের জনসংখ্যা প্রায় ১৯ হাজার ৪৩ জন। এর মধ্যে ১০ হাজার ৯ জন পুরুষ ও ৯ হাজার ৩৪ জন মহিলা বাসিন্দা রয়েছে। লোকসংখ্যার হিসাব ২০১১ সালে বাড়িতে উপস্থিত জনগণনা অনুসারে পাওয়া। গত ৬৮ বছর ধরে ছিটমহলগুলোর বাসিন্দাদের জীবন কেটেছে মূলত কৃষির ওপর নির্ভর করে। সবার আবার কৃষিজমিও ছিল না। তারা মূলত দিনমজুরি করেই জীবন নির্বাহ করতেন। যাদের জমি ছিল, তারাও অভাবের কারণে বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয়েছেন। এখন দেবীগঞ্জ উপজেলার ৬টি ছিটে ৪০ শতাংশের বেশি জমি ছিটের বাইরে থাকা ধনী লোকদের। কোন কোন ছিটে সেখানকার বাসিন্দাদের তুলনায় বাইরের লোকের জমির পরিমাণ বেশি। ভারত-বাংলাদেশ ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটি পঞ্চগড়-নীলফামারী জেলা শাখার সভাপতি মফিজার রহমান জানান, ১৯৮৫ সালের পর থেকে এখানকার জমি রেজিস্ট্রি বন্ধ। তাই একজনের জমি আরেকজন দখল করে মালিক হয়ে যেত। এখন এসব এলাকায় সহযোগিতার হাত নিয়ে বিভিন্ন এনজিও এবং ব্যাংক আসা শুরু করেছে। এ অঞ্চলের মানুষগুলোকে আর্থিক অন্তর্ভুক্তির আওতায় আনতে পারলে উন্নয়ন করা সময়ের ব্যাপার। সরেজমিনে বাংলাদেশে যুক্ত হওয়া দেবীগঞ্জের ছিটমহলগুলো ঘুরে দেখা যায়, বেশিরভাগ ছিটে কাঁচা-পাকা রাস্তা তৈরি করা হচ্ছে। এখন নিজস্ব যানবাহন নিয়েই গ্রামে যাওয়া যাচ্ছে। যা কিছুদিন আগেও দুষ্কর ছিল। বালাপাড়া খাগড়াবাড়ী গ্রামের আবুল হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, এলাকার উন্নয়ন বলতে কাঁচা-পাকা রাস্তাঘাট হয়েছে। কয়েকটি ছিটে বিদ্যুত এসেছে। স্কুলও তৈরি করা হচ্ছে। কিন্তু বেকার তরুণ-তরুণীদের জন্য কিছু করা যাচ্ছে না। তিনি বলেন, ব্যবসা-বাণিজ্য করার মতো পুঁজি তো খুব বেশিজনের হাতে নেই। একই কথা একই এলাকার বাসিন্দা আব্দুর রশিদের। তিনি বলেন, অল্প পুঁজি দিয়ে তো আর ব্যবসা চলে না। তাদেরই একজন বালাপাড়া খাগড়াবাড়ী গ্রামের বাসিন্দা হাসিনুর রহমান। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, একসময় অন্যের জমিতে চাষবাস করেছি। তারপর ছোট মুদিদোকান দিয়েছিলাম। অর্থাভাবে সেটিও ঠিকমতো চালাতে পারেনি। ক’দিন আগে একটি বেসরকারী ব্যাংকের সহায়তায় একটি ভ্যানগাড়ি পেয়েছি। এখন এটিই একমাত্র ভরসা। অধুনালুপ্ত এসব ছিটমহলের বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পড়াশোনা তো দূরের কথা, ভালভাবে জীবনযাপন করতে পারেনি এখানকার ছেলেমেয়েরা। পরিচয় গোপন করে পাশের গ্রামে গিয়ে পড়াশোনা করেছে। তাদেরই একজন দহলা খাগড়াবাড়ী ছিটের বাসিন্দা জবেদ আলীর মেয়ে নূর বানু। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, ছিটমহলের বাসিন্দা বলে স্কুলে ভর্তি নিতে চায়নি। পরে পাশের গ্রামে থাকা চাচা আবেদ আলীকে বাবা পরিচয়ে ওই স্কুলে ভর্তি হই। অর্থাভাবে পড়াশোনাই বন্ধ হলেও বছর দুয়েক আগে সেলাই কাজের প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন লাকী। তিনি বলেন, ঋণের জন্য বিভিন্ন এনজিও এবং সরকারী দফতরে যোগাযোগ করেও ফল পাইনি। হতাশ না হয়ে হাত এবং সুঁই দিয়ে কাজ শুরু করি। অনেক কষ্টে দুটি সেলাই মেশিন কিনি। যেটুকু আয় হয় তার সবটুকুই ব্যয় হয়েছে সংসারের পেছনে। ক’দিন আগে ন্যাশনাল ব্যাংকের সহায়তায় একটি সেলাই মেশিন পেয়েছেন তিনি। দিনভর সেই মেশিনের চাকাই ঘুরছে তার বাড়িতে। এখন তার অধীনে দুজন নারীও কাজ করছে। ১নং দহলা খাগড়াবাড়ী ছিটমহলের নারীরা প্রয়োজনীয় কাপড় সেলাই করে নেন নূর বানুর কাছ থেকে। এখন যেন তিনি নারীদের কাপড় তৈরির কারিগর হয়ে উঠেছেন। নূর বানুর মতো অনেক নারীই এখন স্বপ্ন দেখেন উদ্যোক্তা হওয়ার। অধুনালুপ্ত ছিটমহলে অল্পবয়স্ক তরুণ-তরুণীরাও উদ্যোক্তা হতে চান। সহজ শর্তে চান ব্যাংক ঋণ, কেউ চায় কর্মসংস্থান। ভারত-বাংলাদেশ ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটি পঞ্চগড়-নীলফামারী জেলা শাখার সভাপতি মফিজার রহমান জানান, রাষ্ট্রের স্বীকৃতি ও নাগরিকত্ব যখন পাওয়া গেছে, তখন উন্নয়নও হবে নিশ্চয়। তার মতে, সবার আগে প্রয়োজন এতকালের বঞ্চিত ছিটমহলবাসীর জীবনমানের উন্নয়ন ঘটানো। তিনি বলেন, এখানকার ছিটমহলগুলোর উন্নয়ন ঘটাতে হলে সবার আগে শিক্ষিত বেকার যুবক-যুবতীদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। তাদের উদ্যোক্তা হওয়ার সুযোগ করে দিতে হবে। সেই সুযোগ কাজে লাগাতে সম্প্রতি অধুনালুপ্ত ছিটমহলে আর্থিক অন্তর্ভুক্তিমূলক কার্যক্রম শুরু করেছে ব্যাংকিং খাত। বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্যোগে দেবীগঞ্জ উপজেলার দহলা খাগড়াবাড়ী গ্রামে এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ব্যাংকিং সেবার কার্যক্রম উদ্বোধন করা হয়। ব্যাংকগুলোর সিএসআরের আওতায় অধুনাবিলুপ্ত ছিটমহল এলাকায় ৩৩৪টি নলকূপ, ১৯২টি স্যানিটারি ল্যাট্রিন, ১০টি স্পে মেশিন, বিপুল পরিমাণ ওষুধ এবং শিক্ষা কার্যক্রমের আধুনিকায়নে ১৯টি কম্পিউটার, ১৩শ’ স্কুলব্যাগ, ৪২ লাখ টাকা ব্যয়ে প্রার্থমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয় ভবন নির্মাণে, ১৫ রাখ ৫০ হাজার টাকা ব্যয়ে শিক্ষাবৃত্তি প্রদান, ১০০টি স্কুল বেঞ্চ, আত্ম-কর্র্মসংস্থানের জন্য ৯০টি সেলাই মেশিন, ১৮৩টি বাইসাইকেল, ১১০টি ভ্যানগাড়ি, ১৪৬ বান্ডিল ঢেউটিন, ৩০টি গরু, দরিদ্র মানুষের শীত নিবারণে জন্য ৫১০০টি কম্বল বিতরণ করা হয়। এ ছাড়া ব্যাংকগুলোর পক্ষ থেকে ওই এলাকায় সৌরবিদ্যুত স্থাপন, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে কালভার্ট নির্মাণসহ বহুমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নর ড. আতিউর রহমান বলেন, দেশের মানচিত্রে সদ্য অন্তর্ভুক্ত ছিটমহলের বাসিন্দাদের অর্থনীতির মূলধারায় যুক্ত করা হবে। তাদের সম্ভাবনাময় উদ্যোগগুলোকে বিকশিত করতে সাহায্য করা হবে। এ জন্য দেশের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঢেলে সাজানো হচ্ছে। গবর্নর বলেন, কৃষি এসএমইসহ উৎপাদনমুখী ও পরিবেশবান্ধব খাতগুলোতে ঋণের যোগান বাড়ানো হবে। ছিটমহলের কৃষক ও হতদরিদ্রদের ১০ টাকায় ব্যাংক হিসাব খোলার সুযোগ দেয়া, বর্গাচাষিদের জন্য বিশেষ ঋণ, আমদানিনির্ভর ফসল চাষে কম সুদে ঋণ, নারী উদ্যোক্তাদের সহজ শর্তে কম সুদে ঋণের সুযোগ সৃষ্টি এবং দ্রুত ও কম খরচে টাকা পাঠানোর জন্য মোবাইল ব্যাংকিং প্রবর্তন করা হয়েছে।
×