ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আশুলিয়ায় পুলিশ হত্যায় তদন্ত কমিটি

প্রকাশিত: ০৫:১৪, ৬ নভেম্বর ২০১৫

আশুলিয়ায় পুলিশ হত্যায় তদন্ত কমিটি

জনকণ্ঠ রিপোর্ট ॥ বুধবার সকালে সাভারের আশুলিয়ায় চেকপোস্টে ফিল্মি স্টাইলে হামলা চালিয়ে এক পুলিশকে হত্যার ঘাতক এবং ৪ পুলিশকে ছুরিকাঘাতে হত্যাচেষ্টাকারীরা শনাক্ত হয়নি। দায়িত্বে অবহেলার দায়ের উপ-পরিদর্শক হাবিবকে রাজারবাগ পুলিশ লাইনে ক্লোজ করা হয়েছে। এ ঘটনায় অজ্ঞাত আসামিদের বিরুদ্ধে আশুলিয়া থানায় মামলা হয়েছে। ঘটনা তদন্তে গঠন করা হয়েছে ৭ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি। ইতোমধ্যেই কমিটি ঘটনা সম্পর্কে আহত পুলিশসহ স্থানীয়দের জবানবন্দী নিয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক ৭ জনকে ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ততার তথ্য না পাওয়ায় ছেড়ে দেয়া হয়েছে। চাঞ্চল্যকর এ হামলার রহস্য উদ্ঘাটনে বিভিন্ন জেলার ৭ জন চৌকস পুলিশ কর্মকর্তা কাজ করছেন। সারাদেশে বিশেষ তল্লাশি অভিযান চলছে। বুধবার সকালে সাভারের আশুলিয়ার নন্দনপার্ক এলাকায় পুলিশ চেকপোস্টে ফিল্মি স্টাইলে হামলার ঘটনায় ৬ হামলাকারী দুটি মোটরসাইকেলযোগে আচমকা কর্তব্যরত পুলিশের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তারা এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাতে ৫ পুলিশ সদস্যকে আহত করে। হতভম্ব পুলিশ সদস্যরা অস্ত্র ফেলে পাশের শালবনে ও হোটেলে আশ্রয় নেয়। আহত পুলিশ সদস্যদের উদ্ধার করে সাভার এনাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় শিল্প পুলিশের কনস্টেবল মুকুল হোসেনের মৃত্যু হয়। বগুড়ার গ্রামের বাড়িতে নিততের দাফন সম্পন্ন হয়। শত শত মানুষ মুকুলকে একনজর দেখার জন্য ভিড় করেন। নিহতের পরিবারের কান্নায় সেখানকার আকাশ বাতাস ভারি হয়ে আসে। গগন বিদারী আর্তনাদে এক হৃদয়বিদারক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় সেখানে। এদিকে হামলায় আহতদের মধ্যে গুরুতর জখমদের মধ্যে নুরে আলম সিদ্দিকীর অবস্থার ধীরে ধীরে উন্নতি হচ্ছে। তাকে হাসপাতালের আইসিইউতে রাখা হয়েছে। অন্য তিনজন হারুনুজ্জামান, ইমরান ও ইমরান হোসেন প্রায় স্বাভাবিক হয়ে আসছেন। বৃহস্পতিবার এ ঘটনায় আশুলিয়া থানার উপ-পরিদর্শক আজহারুল ইসলাম বাদী হয়ে আশুলিয়া থানায় অজ্ঞাত আসামিদের বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা আশুলিয়া থানার পরিদর্শক (তদন্ত) দীপক কুমার সাহা। তিনি জানান, ঘটনার বিষয়ে জানার জন্য আশপাশের ৭ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে তাদের ছেড়ে দেয়া হয়। এসআই হাবিবকে দায়িত্বে অবহেলার জন্য রাজারবাগ পুলিশ লাইনে ক্লোজড করা হয়েছে। পুলিশ কর্মকর্তা হাবিবের সকাল ৮টা পর্যন্ত সেখানে দায়িত্ব পালনের কথা ছিল। কিন্তু নির্ধারিত সময়েরই আগেই তিনি সঙ্গীয় ফোর্সসহ ঘটনাস্থল থেকে চলে যান। ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি ৭ সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন। এ তদন্ত কমিটির নেতৃত্বে রয়েছেন ঢাকা রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি শফিকুর রহমান এবং সদস্যরা হচ্ছেন নারায়ণগঞ্জ জেলা ডিবি ইন্সপেক্টর আবুল খায়ের, গাজীপুর জেলা ডিবি ইন্সপেক্টর আছাদুর রহমান, নারায়ণগঞ্জ জেলা ডিবি এসআই সাইফুল ইসলাম, আড়াইহাজার থানা ডিবি এসআই আব্দুস সালাম, গাজীপুর জেলা ডিবি এসআই হোসেন, শ্রীপুর থানার এসআই মজিবর রহমান ও এসআই মলয় চক্রবর্তী। আশুলিয়া থানার ওসি মহসিনুল কাদির জানান, নন্দনপার্ক, ওয়ালটন, ট্রাস্ট ব্যাংকসহ ঘটনাস্থলের আশপাশে অবস্থিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সিসি ক্যামেরার ভিডিও ফুটেজ পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে। ফুটেজ থেকে অপরাধীদের শনাক্ত করার কাজ চলছে। পুলিশের যে ৩ সদস্য অস্ত্র ফেলে দৌড়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন, সে বিষয়ে আশুলিয়া থানার উপ-পরিদর্শক আনিসুর রহমান জানান, ওই সদস্যদের ওপরও হামলা হয়েছে। অতর্কিত ওই হামলা থেকে প্রাণ বাঁচাতে ওই ৩ জন অস্ত্র ফেলেই দৌড়ে পালিয়ে আত্মরক্ষা করেন। পুলিশের অস্ত্র ও আহত পুলিশ সদস্যদের উদ্ধারকারী গাড়িচালক অনিল কুমার বিশ্বাস জানান, ওই তিনি সময় নন্দনপার্কে যাওয়ার পথে মহাসড়কের ঢালে দাঁড়িয়ে ছিলেন। হঠাৎ একটি গুলির শব্দ শুনে রাস্তায় উঠে দেখতে পান যে, একজন পুলিশ সদস্য রক্তাক্ত অবস্থায় দৌড়ে রাস্তা পার হয়ে কিনারে পড়ে অজ্ঞান হয়ে গেছে। আরেক পুলিশ সদস্যকে শুভেচ্ছা হোটেলে পড়ে থাকতে দেখেন। আর দুজন সন্ত্রাসী একটি ছাই রঙের মোটরসাইকেলযোগে কয়েক রাউন্ড গুলি ছুড়তে ছুড়তে নবীনগরের দিকে চলে যায়। এমন পরিস্থিতিতে তিনি বিআরটিসি বাসের স্টাফদের সহযোগিতায় আহতদের একটি ভ্যান গাড়িতে উঠিয়ে স্থানীয় একটি হাসপাতালে ভর্তি করেন। এ সময় চায়ের দোকানে সামনে পড়ে থাকা পুলিশের তিনটি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করেন। তবে, ওই সময় তিনি আহত দুজন ব্যতীত অন্য কোন পুলিশ সদস্যকে তিনি দেখতে পাননি। ওই সময় ঘটনাস্থলে ভাই ভাই হোটেল, শুভেচ্ছা হোটেল এ্যান্ড রেস্টুরেন্টে, মায়ের দোয়া হোটেল নামক ৩টি খাবারের দোকান খোলা ছিল। সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার মোস্তফা কামালের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল বৃহস্পতিবার সকালে ঘটনাস্থল পরিদশর্ন করে। এ সময় তারা আশপাশের মানুষের সঙ্গে কথা বলেন এবং কিছু আলামত সংগ্রহ করেন। তবে, ঘটনাস্থল ও আশপাশের এলাকার পরিবেশ এখনও থমথমে। ঘটনাস্থলের আশপাশের সব দোকানপাটও বন্ধ রয়েছে। আশুলিয়াজুড়ে নেয়া হয়েছে ব্যাপক নিরাপত্তা। ঘটনাস্থলসহ আশপাশের এলাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অতিরিক্ত সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। এদিকে ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার মোঃ আছাদুজ্জামান মিয়া ভবিষ্যতে এমন অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে আত্মরক্ষার্থে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে গুলি চালানোর নির্দেশ দিয়েছেন। ঢাকা মহানগর পুলিশ সদর দফতরে বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত ডিএমপির বিভিন্ন জোনের উপ-কমিশনার ও অতিরিক্ত উপ-কমিশনার পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠককালে তিনি এ নির্দেশনার কথা জানান। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, হামলাকারীদের শনাক্ত করতে পুলিশের প্রতিটি ইউনিট সম্মিলিতভাবে কাজ করে যাচ্ছে। যদিও হামলাকারীরা বৃহস্পতিবার রাত আটটা পর্যন্ত শনাক্ত হয়নি। চেকপোস্ট বসানোর সময় অন্তত একটি অস্ত্রের চেম্বারে গুলিভর্তি রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি যেন না হয়। কমিশনার সে নির্দেশ দিয়েছেন। এ ছাড়া নিরাপত্তা জোরদার করতে নজরদারি বাড়াতে বলা হয়েছে। টহল বা চেকপোস্টে পুলিশ গুলিবিদ্ধ হবে এবং সন্ত্রাসীরা গুলি করে চলে যাবে, পুলিশ গুলি করবে না, এটা হতে পারে না। নিজেদের রক্ষায় গুলি চালানোর কথা বলেন তিনি। এ ক্ষেত্রে কারও অনুমতির প্রয়োজন হয় না। আইনগতভাবেও এর বৈধতা রয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। পর্যাপ্ত পুলিশ না থাকলে চেকপোস্ট না বসানোর জন্যও বলা হয়েছে। তল্লাশি চৌকিতে দায়িত্ব পালনকালে পুলিশ সদস্যদের বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট পরিধান করার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। ডিএমপির মিডিয়া বিভাগের উপ-কমিশনার মুনতাসিরুল ইসলাম জানান, গাবতলী ও সাভারের ঘটনার পর চেকপোস্টে দায়িত্ব পালনকালে পুলিশকে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করার পরামর্শ দিয়েছেন ডিএমপি কমিশনার। পরিস্থিতি অনুযায়ী ডিএমপি কমিশনার পুলিশ সদস্যদের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। গত ২২ অক্টোবর রাজধানীর গাবতলীর আমিনবাজারে চেকপোস্টে সন্ত্রাসীদের ছুরিকাঘাতে নিহত হন দারুস সালাম থানার সহকারী উপ-পরিদর্শক ইব্রাহিম মোল্লা। ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক জাভেদ পাটোয়ারী বলেছেন, ঢাকার গাবলীতে পুলিশকে ছুরিকাঘাতে হত্যা এবং আশুলিয়ার বাড়ইপাড়া এলাকায় হামলায় এক পুলিশকে হত্যা ও ৪ পুলিশ আহত করার ঘটনা একসূত্রে গাঁথা। জঙ্গীরাই ঘটনাটি ঘটিয়েছে। হামলাকারীরা প্রশিক্ষীত। র‌্যাব মহাপরিচালন বেনজীর আহমেদ বলেন, অপরাধীদের শক্তি রাষ্ট্রের শক্তির চেয়ে বেশি নয়। অবশ্যই অপরাধীরা গ্রেফতার হবে। সাভারে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, পুলিশ, র‌্যাবসহ গোয়েন্দা সংস্থার উর্ধতন কর্মকর্তারা। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বাধাগ্রস্ত করার পাশাপাশি দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতেই স্বাধীনতাবিরোধীরা এসব ঘটনা ঘটাচ্ছে। এসব পরিকল্পিত নাশকতা। সারাদেশে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বাড়তি সতকর্তা অবলম্বন করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। হত্যাকারীদের গ্রেফতারে সারাদেশে সাঁড়াশি অভিযান পরিচালিত হচ্ছে।
×