ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী

এই হত্যা-সন্ত্রাস প্রতিরোধের উপায়

প্রকাশিত: ০৪:০০, ৪ নভেম্বর ২০১৫

এই হত্যা-সন্ত্রাস প্রতিরোধের উপায়

জেলহত্যার মাসে ব্লগার হত্যা এবং মাঝে মাঝেই তাদের হত্যা প্রচেষ্টা নিয়ে লিখতে হচ্ছে এটা কলামিস্ট হিসেবেও আমার জন্য এক গভীর মর্মপীড়ার বিষয়। চল্লিশ বছর আগের নবেম্বর হত্যাকা- নিয়ে লিখতে চেয়ে লিখতে হচ্ছে চার তরুণ বুদ্ধিজীবীর সাম্প্রতিক হত্যা প্রচেষ্টা নিয়ে। তাদের মধ্যে তিনজন গুরুতর আহত হয়ে এখনও চিকিৎসাধীন অবস্থায় বেঁচে আছেন এটাই সম্ভবত কিছুটা সান্ত¡না। টার্গেটের কিলিং বন্ধ করা যায় না, গোয়েন্দা পুলিশের এক কর্মকর্তার এই মন্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করি না। কিন্তু যা পারা যায় তা হচ্ছে, এই কিলারদের খুঁজে বের করা, শাস্তি দেয়া এবং তাদের পেছনে আসল কলকাঠি কারা নাড়ছে, তাদেরও ধরে ফেলা। একমাত্র তা হলেই এই বর্বর হত্যাকা- বন্ধ করা সম্ভব। এই কিলারদের ধরার জন্য সরকার যে তৎপর তা আমরা জানি। অভিজিত ও নীলাদ্রি হত্যার কয়েক সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে নাকি গ্রেফতার করা গেছে। তিনটি মসজিদের তিনজন ইমামকে নজরদারিতে রাখা হয়েছে। গোয়েন্দা পুলিশ কর্মকর্তা মনিরুল ইসলাম সাংবাদিকদের জানিয়েছেন আরও একটি বড় খবর। বিদেশ থেকে টাকা আসছে বাংলাদেশে ব্লগার হত্যার জন্য। এই অর্থদাতারা বাংলাদেশী এবং তারা বাইরের বিভিন্ন দেশে রয়েছে। গোয়েন্দা কর্মকর্তারা যদি এতটাই জানেন, তাহলে দ্রুত এদের শনাক্ত করে এই বীভৎস চাপাতি-হত্যাকা- বন্ধ করার উদ্যোগ নিতে পারছেন না কেন? এই ব্লগার হত্যাকারীদের ধরা এবং বিচারের সম্মুখীন করার জন্য সরকার অবশ্যই আন্তরিকভাবে আগ্রহী। পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোরও তৎপরতার অন্ত নেই। কিন্তু প্রশ্ন হলো এই হত্যা তদন্ত ও দোষীদের ধরার ব্যাপারে এত দীর্ঘসূত্রতা কেন? অভিজিত হত্যাকা-ের পর আরও কয়েকটি নৃশংস হত্যাকা- পর পর সংঘটিত হলো। আমাদের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এখন পর্যন্ত অভিজিত হত্যাকা-ের তদন্ত নিয়েই বসে আছেন। তাহলে অন্য হত্যাকা-গুলোর তদন্তের অগ্রগতি হবে কখন? ইত্যবসরে আরও কিছু হত্যাকা- কি ঘটতে দেয়া হবে? একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে হুমায়ুন আজাদ থেকে শুরু করে বর্তমানের ব্লগার হত্যা প্যাটার্ন একই ধরনের। অর্থাৎ চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা। এই হত্যাকা-ের টার্গেটরাও একই ধরনের ব্যক্তি। অর্থাৎ যারা ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে লেখেন এবং বিজ্ঞানের সত্য ও যুক্তি তুলে ধরেন। তাদের মধ্যে অবশ্যই এক ধরনের ব্লগার আছেন, যারা নিজস্ব স্বার্থে ও অন্য উদ্দেশ্যে ধর্মপ্রাণ মানুষের মনে আঘাত দেয়ার মতো লেখা লেখে। এই দ্বিতীয় শ্রেণীর ব্লগারদের ওপর আঘাত আসছে কমই। আঘাত আসছে ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি ও সংস্কৃতির যারা সমর্থক এবং ধর্মান্ধতা ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে যারা লড়ছেন তাদের ওপর। উদ্দেশ্য, রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক ভিত্তি ধ্বংস করা। সরকারের তাই উচিত হবে না, এটাকে কেবল টার্গেটেড কিছু ব্যক্তির হত্যা বলে ভাবা। এই হত্যাকা-ের আসল টার্গেট রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রীয় আদর্শ। এটা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস। তাই সরকারকে সর্বশক্তি নিয়ে এই কিলার গ্রুপ এবং তাদের পেট্রনদের খুঁজে বের করে তাদের শাস্তিদানের ব্যবস্থা করা জরুরী। বার বার একই প্যাটার্নে হত্যা করা হচ্ছে এবং টার্গেটরাও একই গোত্রের লোক, এই সূত্র ধরে আমাদের গোয়েন্দা তদন্ত কেন দ্রুত এগুতে পারছে না এটাই আমার প্রশ্ন। সাম্প্রতিক হত্যা প্রচেষ্টাটি ঘটেছে দিনে দুপুরে এবং ঢাকায় আজিজ সুপার মার্কেটের মতো জনবহুল এলাকায়। লালমাটিয়াও এখন জনাকীর্ণ এলাকা। এই অবস্থায় সশস্ত্র দুর্বৃত্তরা দুটি প্রকাশনা ভবনে ঢুকে চাপাতি হাতে রক্তারক্তি কা- ঘটিয়ে বীরদর্পে চলে গেল আর কেউ তাদের দেখল না এবং তারা তাদের অপরাধের কোন ট্রেস রেখে যায়নি এটা বিশ্বাস করতে আমার কষ্ট হয়। আমার সন্দেহ এই কিলারদের হয়ত কেউ কেউ পালাবার সময় দেখেছেন, কিন্তু ভয়ে মুখ খুলতে চাইছেন না। পুলিশের কাছ থেকে নিরাপত্তার নিশ্চিত আশ্বাস পেলে তারা হয়ত মুখ খুলতে পারেন। সরেজমিনে জোর তদন্ত চালিয়েও পুলিশ কিলারদের খুঁজে বের করার সূত্র আবিষ্কার করতে পারে। কিলাররা রক্তমাংসের মানুষ। তারা হাওয়ায় মিশে যেতে পারে না। বাংলাদেশে আইএস না থাকতে পারে। কিন্তু জামায়াত, হেফাজতসহ বিভিন্ন জঙ্গী গোষ্ঠী আছে। এদের রিক্রুট কেন্দ্র বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয় এবং রিক্রুটও করা হয় শিক্ষিত, অভিজাত শ্রেণীর সন্তানদের। ইংরেজী শিক্ষিত তরুণদের মস্তিষ্ক ধোলাই করে তাদেরও কিলার হিসেবে গড়ে তোলা যায় তার প্রমাণ বাংলাদেশেও পাওয়া গেছে। হালে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশে জঙ্গী সংগঠনগুলো তাদের এই কৌশল কিছুটা পরিবর্তন করেছে। গরিব মাদ্রাসা ছাত্রদের মধ্যে এখন ব্যাপকভাবে রিক্রুটিংয়ের কাজ চলছে এবং তাদের দিয়ে কিলিং স্কোয়াড তৈরি করা হচ্ছে। এই মাদ্রাসা ছাত্ররাও এখন আর টুপিধারী, লম্বা কুর্তা পরিহিত তরুণ নয়; বরং শার্ট-প্যান্ট পরিহিত ক্লিন সেভ্্ড তরুণ। সুতরাং তারা এখন সহজে চিহ্নিত হয় না। জঙ্গীদের এই নতুন কৌশল জানা থাকলে গোয়েন্দা পুলিশের পক্ষে এদের রিক্রুটিং সেন্টার ও আশ্রয় কেন্দ্রগুলো খুঁজে বের করা সহজ হবে। এই কিলিং স্কোয়াডের পেট্রন কারা এবং বিদেশে বসে কারা তাদের অর্থ ও অন্যান্য সাহায্য যোগায় তাদের সন্ধান করার জন্য অবশ্যই বিদেশী গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা এবং একযোগে কাজ করতে হবে। সম্ভবত আমাদের গোয়েন্দা কর্তৃপক্ষ তা করছেন। কিন্তু এই তৎপরতা আরও ব্যাপক ও জোরদার করা দরকার। বাংলাদেশে সামরিক ও স্বৈরাচারী সরকারগুলোর প্রশ্রয়ে দীর্ঘকাল যাবত যে জঙ্গী মৌলবাদী গোষ্ঠীগুলো গড়ে উঠেছে এবং সমাজের ও প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে শক্তিশালী ঘাঁটি গেড়েছে, তাদের সহজে দমন করা যাবে এমন কথা বলি না। এই জঙ্গীদের এখন আন্তর্জাতিক সংযোগ ঘটেছে এবং বিশ্ব¦-সন্ত্রাসের তারা একটি অংশ। পশ্চিমাদের, বিশেষ করে আমেরিকার ভ্রান্ত ও সাম্রাজ্যবাদী নীতির দরুন এই জঙ্গীবাদ তথাকথিত ইসলামী রাষ্ট্রের নাম ধারণ করে গোটা মধ্যপ্রাচ্যে তার ছায়া বিস্তার করেছে। তার উপছায়া পড়ছে উপমহাদেশেও। বাংলাদেশে হয়ত আইএস নেই। কিন্তু আইএসের বর্বরতার অনুসরণে বাংলাদেশেও ইসলামের নাম ভাঙিয়ে আইএসের ‘ব্রান্ড খেলাফত’ প্রতিষ্ঠায় উৎসাহী ব্যক্তি ও দলের অভাব নেই। কয়েকজন ব্লগার বা তরুণ বুদ্ধিজীবী হত্যা করে বাংলাদেশে তালেবান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা যাবে তা আমি বিশ্বাস করি না। কিন্তু এই হত্যাকা- দ্বারা যে উদ্দেশ্যটি সাধনে ঘাতকের দল সফল হয়েছে, তা হলো সারাদেশে একটা ভীতি ছড়িয়ে দেয়া। মুক্তচিন্তা ও মননে যারা বিশ্বাসী তাদের নীরব করে দেয়া হচ্ছে। ধর্ম নিয়ে সাধারণ আলোচনাতেও অনেকে ভয় পাচ্ছেন। বিশেষ করে গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শে বিশ্বাসী রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক মহল এই ভীতির দরুন ঐক্যবদ্ধ হয়ে কোন প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারছে না। সাধারণ মানুষের মধ্যেও কোন প্রতিরোধ চেতনা তৈরি হচ্ছে না এই ভীতির দরুন। সমর বিশারদরা বলেন, শত্রুপক্ষ যত শক্তিশালী হোক তার মনে যদি একবার ভীতি ছড়িয়ে দেয়া যায়, তাহলে তার যুদ্ধ করার ক্ষমতা আর থাকে না। বাংলাদেশে যারা ব্লগার হত্যার নেপথ্য নায়ক-গোষ্ঠী তারা জানে, সম্মুখ সমরে তারা বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক সেক্যুলার শক্তির সঙ্গে পেরে উঠবে না। কিন্তু এই গণতান্ত্রিক শিবিরে এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে যদি একবার ভয় ঢুকিয়ে তাদের প্রতিরোধ ক্ষমতা নষ্ট করে দেয়া যায়, তাহলে প্রতিরোধশক্তিহীন জনগোষ্ঠীকে কাবু করে তাদের মাথায় মধ্যযুগীয় রাষ্ট্র ব্যবস্থা চাপিয়ে দেয়া সহজ এবং সম্ভব হবে। বাংলাদেশের আওয়ামী লীগ সরকার এবং গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলোর তাই উচিত, জনগণের মন থেকে এই ভীতি দূর করার কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ। এ জন্য শুধু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাগুলোর ওপর নির্ভর না করে ছাত্র, যুব সংগঠনসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবী সংগঠনগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করে এই সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানে নামানো দরকার। অতীতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় দেখা গেছে, জনগণের সম্মিলিত প্রতিরোধ আন্দোলনের মুখে সাম্প্রদায়িকতার দানব হটে গেছে। বর্তমানের সন্ত্রাস ও হত্যাভিযানও অনেকটাই প্রতিরোধ করা সম্ভব, যদি জনগণের মধ্যে ভীতির ভাব দূর করে এই কিলারদের বিরুদ্ধে গণ-চেতনা গড়ে তোলা যায়। সরকারকেই এই গণ-চেতনা গড়ে তোলার দায়িত্বটি গ্রহণ করতে হবে- সেই সঙ্গে এই কিলার এবং তাদের দেশী-বিদেশী পেট্রনদের খুঁজে বের করার ও শাস্তিদানের দায়িত্বটিও। একুশ শতকের উন্নত আধুনিকতার যুগে এই হত্যাকা- অবাধে চলতে দেয়া যায় না। একটা সভ্য দেশে এটা অসভ্য, মানবতাবিরোধী অপরাধ। এই অপরাধ দমনে সর্বাত্মক ব্যবস্থা গ্রহণ দরকার। [লন্ডন ৩ নবেম্বর, মঙ্গলবার, ২০১৫]
×