ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

সাব্বির খান

যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষায় এ্যামনেস্টির ওকালতি!

প্রকাশিত: ০৩:৫৯, ৪ নভেম্বর ২০১৫

যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষায় এ্যামনেস্টির ওকালতি!

মানবধিকার প্রশ্নে যে বা যারাই ওকালতি করুক না কেন এজন্য প্রথম শর্তই হচ্ছে নিরপেক্ষতা বজায় রেখে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া। নিরপেক্ষতার সংজ্ঞা নিয়ে নানাবিধ মতভেদ থাকতে পারে। কিন্তু সেক্ষেত্রে কোন ধরনের ‘ইজম’কে প্রশ্রয় দিলে নিরপেক্ষতা চর্চাই বরং প্রশ্নবিদ্ধ হয়, যা কাম্য নয়। তবে কেউ কি কখনও সম্পূর্ণভাবে নিরপেক্ষ হতে পারেন? সম্ভবত না। যারা মানবধিকার নিয়ে চর্চা করেন বা মানবধিকার সুরক্ষার পক্ষে কাজ করেন তারা স্বভাবতই মানবাধিকার হরণকারীর বিপক্ষে যাবেন, এটা সবাই মনে করেন। আর সেক্ষেত্রে মানবাধিকার লঙ্ঘনকারীর কৃতকর্ম, ঘটনার লোমহর্ষকতা, ভুক্তভোগীদের রক্তক্ষরণ অনুভব করা এবং সময়-কালকে বিচার্যবিষয় ভেবেই মানবাধিকারের পক্ষে এ্যাডভোকেসি বা ওকালতি করতে হয়। এর কোন একটার সামান্যতম ব্যত্যয় ঘটলে মানবধিকার রক্ষার যেকোন এ্যাডভোকেসিকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ক্রিয়াকর্ম হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে। বিশ্বের স্বনামধন্য এবং সম্মানিত স্বায়ত্তশাসিত সংগঠন এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সাউথ এশিয়া রিসার্চ ডিরেক্টর ডেভিড গ্রিফিথের দেয়া ২৭ অক্টোবর, ২০১৫ তারিখের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তি প্রচলিত ধারায় নিরপেক্ষতা বজায় রেখেছিল কি-না এবং সংগঠনের পক্ষে গ্রিফিথের বিবৃতি কোন ধরনের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কি-না, বাংলাদেশের সচেতন জনগণের কাছে এটাই এখন মুখ্য প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিবৃতির মূল অংশ পড়ার আগে শুধু শিরোনামের দিকে চোখ রাখলেই যেকোন সচেতন ব্যক্তির পক্ষে বোঝা অসম্ভব হবে না যে, জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের বিবৃতিটি শুরুতেই একটি পক্ষ নিয়ে ফেলেছে। তারপর বিবৃতির মূল কথাগুলো যে শিরোনামের সরল রেখা ধরেই এগিয়েছে তা যেকোন ব্যক্তির পক্ষেই বোঝা সম্ভব। মানবাধিকার রক্ষার ওকালতি কাজে নিয়োজিত এ্যামনেস্টির মতো আন্তর্জাতিক সংগঠনের পক্ষে কি এটা তাৎক্ষণিক একটা ভুল, না-কি এর পেছনে কোন উদ্দেশ্য কাজ করেছে, বোদ্ধা সমাজে এটা নিঃসন্দেহে একটা বিস্ময়কর প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের বিবৃতির শিরোনামে লিখেছে- Bangladesh : Two opposition leaders face imminent execution after serious flaws in their trials and appeals। সোজাসাপ্টা বাংলায় যার অর্থ দাঁড়ায়- ‘বাংলাদেশ : গুরুতর ত্রুটিপূর্ণ বিচার এবং আপীলের রায়ের কারণে দুজন বিরোধীদলীয় নেতা মৃতু্যুদ-ের সম্মুখীন হতে যাচ্ছেন।’ (https:/ww/w.amnesty.org/en/latest/news/2015/10/bangladesh-imminent-executions/) এই শিরোনামে যে ভুল হয়েছে তা নিঃসন্দেহে অজ্ঞতার বহির্প্রকাশ এবং একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের বিচার ব্যবস্থার প্রতি তাচ্ছিল্য প্রকাশের শামিল। ২০১০ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের জন্য গঠিত ট্রাইব্যুনাল সারাবিশ্বের কাছে বিভিন্ন প্রশ্নের শুধু কৈফিয়তই দেয়নি, সেইসঙ্গে আইনের ব্যাখ্যা তুলে ধরাসহ প্রয়োজনে আইনের পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করেছে, যা নজিরবিহীন। পর্যায়ক্রমে এই ট্রাইব্যুনাল সারাবিশ্বে প্রশংসা পেয়েছে এবং বিভিন্ন দেশ বাংলাদেশে গঠিত ট্রাইব্যুনালকে আধুনিক যুগের আদর্শ মডেল হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। বিচারকার্যের শুরু থেকেই বাংলাদেশের আইন বিভাগ এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সংগঠন ও সংস্থা বলে আসছে, ‘এই বিচারের আওতায় যাদেরই আনা হচ্ছে তাদের সবাই একাত্তরে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের দায়ে অপরাধী। এই আদালতে কোন রাজনীতিবিদের বিচার হচ্ছে না। আইনের চোখে একজন অপরাধী, সমাজের যে কেউ হোক না কেন, শুধুই অপরাধী হন।’ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর গঠিত ন্যুরেমবার্গ আদালতে শুরু থেকে আজ অবধি কোন জেনারেল, মন্ত্রী, আমলা বা রাজনীতিবিদের বিচার হয়েছে বলে শোনা যায়নি। এটা শতসিদ্ধ এবং পুরনো আমল থেকেই অনুশীলিত যে, বিশ্বে বিজয়ীরাই বিজিতের বিচার করে থাকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে কি মিত্রবাহিনী কাউকে হত্যা করেনি? যুগোসøাভিয়ার যুদ্ধে কি ন্যাটোর গুলিতে কেউ মরেনি? কিন্তু তাদের কারোই বিচার হয়নি। কারণ যারা আক্রান্ত হয়েছিল তাদের আত্মরক্ষার অধিকার থেকে পাল্টা আক্রমণ করায় শত্রু মারা গেলে নিশ্চয়ই সেজন্য আত্মরক্ষাকারীর বিচার হয় না। অথচ হাস্যকরভাবে এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের বিবৃতিতে সে দাবিই জানানো হয়েছে। অপরাধীর ভিন্ন কোন পরিচয় থাকে না। অথচ এ্যামনেস্টির বিবৃতিতে এটা স্পষ্ট যে, বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে কোন যুদ্ধাপরাধী বা অপরাধীর বিচার হচ্ছে না। যা হচ্ছে তা বিরোধীদলীয় রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে একচেটিয়া বিচার নামের প্রহসন হচ্ছে। এখানে স্বভাবতই প্রশ্ন তোলা যেতে পারে, এই শিরোনামের দ্বারা কি এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরোধিতা করছে? যুদ্ধাপরাধীদের বিচার না করে তাদের সুরক্ষা দেয়াটা কি মানবধিকার রক্ষা? যদি তাই হয় তাহলে অবশ্যই বুঝতে হবে, কোথাও কোন ঘাপলা হচ্ছে। সেক্ষেত্রে সন্দেহ থাকা উচিত নয় যে, বিশ্বে মানবাধিকার রক্ষার একচেটিয়া ঠিকাদারী নেয়া সংগঠন এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ‘এতদিনের চেনা ঘোড়া নয়, তা শুধুই খচ্চরের দেহে ঘোড়ার খোলস মাত্র।’ মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী এবং আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদকে বিচার প্রক্রিয়া থেকে মুক্তি দিয়ে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাকামীদের বিচার চেয়েছে মানবাধিকার সংগঠন এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। তাদের বক্তব্য, “সরকারবিরোধী রাজনৈতিক নেতা হিসেবেই সাকা চৌধুরী বা আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ এবং অন্যদের মানবতাবিরোধী অপরাধে বিচারের আওতায় আনা হয়েছে। তাদের বিচার হলে ‘একই রকম অপরাধে’ কেন মুক্তিযোদ্ধাদের বিচারের আওতায় আনা হবে না” সেই প্রশ্নও তুলেছে এ্যামনেস্টি (m~Î : http:/ww/w.sylhettoday24.com/news/details/National/11059) তাদের এই বক্তব্য এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিচার ব্যবস্থার প্রতি তাদের উদ্বিগ্নতাকে যদি আমলে নেই তাহলে অবশ্যই তাদের এই চর্চার অনুশীলন সর্বক্ষেত্রেই দেখতে পাওয়া উচিত বলে আমি মনে করি। কিন্তু তা না হলে এটা ভাবা কি অমূলক হবে না যে, বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের বিরুদ্ধে এ্যামনেস্টির দেয়া বিবৃতি বা সংবাদ বিজ্ঞপ্তি একটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কাজই শুধু নয়, একই সঙ্গে জামায়াত আদলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করতে আরও একটি সংগঠিত চক্রান্ত! সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী এবং আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদকে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত থেকে ফাঁসির রায় দেয়া হয়, পরবর্তীতে যে রায় উচ্চ আদালতেও বহাল থাকে। এই রায়ে অসন্তুষ্ট হয়ে এবং বিরোধিতা করে এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশলাল বিবৃতি দেয়। তারা মনে করে, ‘মৃত্যুদণ্ড শুধু সন্ত্রাসের দিকে ঠেলে দেবে। ন্যায্য বিচার ছাড়া মৃত্যুদণ্ড আরও বিরক্তিকর’ (সূত্র : সিলেটটুডে২৪.কম)। অন্যদিকে, এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল তাদের রিপোর্টে ৩১ জুলাই ২০১৪-এ উল্লেখ করেছিল যে, বাংলাদেশে ডেথ সেলে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তির সংখ্যা ছিল অন্তত ১১৭২। একই রিপোর্টে তারা আরও বলেছে, ২০১৩ সালে বাংলাদেশে অন্তত ২২০ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে। আমার জানামতে এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল গত দুই বছরে বাংলাদেশে মৃত্যুদ-প্রাপ্তদের গড় একটা তালিকা তৈরি করেছিল শুধু, যা বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে সহজেই সংগ্রহ করা সম্ভব। কিন্তু একবারের জন্যও তারা ‘যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানোর আদলে’ কোন ওকালতি তো দূরের কথা, একটা বিবৃতি পর্যন্তও দেয়নি। তাহলে কেন তাদের এই স্ববিরোধিতা? মৌলবাদী যে সংগঠনটি বাংলাদেশে একাত্তরে লাখ লাখ মানুষ হত্যা করেছে, তাদের বিচারে স্বচ্ছতার প্রশ্ন তুলে অপরাধীদের বাঁচাতে এ্যামনেস্টি যখন বিবৃতি দেয় তখন যুদ্ধাপরাধী, মৌলবাদ এবং জঙ্গীবাদের তল্পিবাহক হিসেবে তাদের ভাবতে কি খুব বেশি অসুবিধা হওয়ার কথা? অথচ ভাবখানা এমন যে, বাংলাদেশে শুধু বিরোধীদলীয় রাজনীতিবিদদেরই ফাঁসিতে ঝুলানো হচ্ছে। আমরা জানি, যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানোর জন্য এবং বাংলাদেশের ট্রাইব্যুনালকে অকেজো করার লক্ষ্যে সারাবিশ্বে যুদ্ধাপরাধী দল জামায়াতে ইসলামী কোটি কোটি টাকা খরচ করছে এবং বিশ্বের শ্রেষ্ঠ লবিস্ট ফার্মগুলোকে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে তাদের সহযোগিতা করতে নিয়োগ দিচ্ছে। কিন্তু এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালকে দিয়ে টাকার বিনিময়ে কি এই ধরনের বিবৃতি দেয়ানো সম্ভব? আমরা জানি, পাবলিকলি এ্যামনেস্টি সম্পূর্ণ স্বায়ত্তশাসিত এবং নিরপেক্ষ একটি সংগঠন। তারা কারও তল্পিবাহক হতে কোন দেশের সরকারের কাছ থেকে কোন ধরনের অনুদান বা সাহায্য-সহযোগিতা গ্রহণ করে না। অন্তত এ্যামনেস্টির ওয়েবসাইটে সে কথাই লেখা আছে। কিন্তু তারপরেও বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা গেছে, এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বিভিন্ন খাত থেকে পাওয়া তাদের বার্ষিক অনুদানের বিশাল একটা অংশ বিভিন্ন দেশের সরকারের কাছ থেকে পাচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে যে, ২০১১ সালে যুক্তরাজ্য সরকারের ডিপার্টমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট থেকে ৮৪২০০০ ইউরো অনুদান হিসেবে গ্রহণ করে। ২০০৯ সালে সংগঠনটির প্রাপ্ত মোট অনুদানের ১% পরিমাণ ছিল ২.৫ মিলিয়ন ইউরো এবং এই অর্থ তারা পেয়েছিল বিভিন্ন দেশের সরকারের কাছ থেকে। ২০০৮ সালে ১ মিলিয়ন ইউরো, ২০০৭ সালে ১ মিলিয়ন ইউরো এবং ২০০৬ সালে পেয়েছিল ২ মিলিয়ন ইউরো। যুক্তরাজ্য এ্যামনেস্টির দাতা দেশগুলোর মধ্যে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে, যাদের কাছ থেকে এ্যামনেস্টি প্রতিবছর অনুদান নিয়ে থাকে। ২০০৭ সালে ইউরোপীয় কমিশনের কাছ থেকে পেয়েছিল ২৫৯০০০ পাউন্ড। এছাড়াও এ্যামনেস্টি যাদের কাছ থেকে নিয়মিত অনুদান পেয়ে থাকে তাদের মধ্যে নেদারল্যান্ডস, যুক্তরাষ্ট্র, ইসরাইল, সৌদি আরব ছাড়াও আরও বেশ কিছু দেশ রয়েছে। কিন্তু এ্যামনেস্টি বরাবরই অস্বীকার করে কোন দেশের সরকারের কাছ থেকে অনুদান গ্রহণের কথা। এ ক্ষেত্রে শুধু এই অনুদানের কথাটাই যদি আমলে নেয়া হয় তাহলে তারা যে নীতি-নৈতিকতার ধার না ধেরে সম্পূর্ণ অনৈতিক মিথ্যার বেসাতি করছে এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ থাকে না। ঠিক একই যুক্তিতে ধরে নেয়া যেতেই পারে যে, যুদ্ধাপরাধীদের কাছ থেকেও বিশাল অঙ্কের অনুদানের বিনিময়ে এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল তাদের পক্ষ হয়ে বাংলাদেশের আদালতের বিরুদ্ধে জঘন্য মিথ্যা বিবৃতি দিয়েছে! আলোচনার স্বার্থে যুদ্ধাপরাধী দল বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী সম্বন্ধে দুই-একটি কথা বলে নেয়া প্রয়োজন বলে মনে করছি। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী একটি আন্তর্জাতিক সংগঠনের বাংলাদেশী শাখা। এটির সূচনা হয়েছিল উপমহাদেশের বিতর্কিত ধর্মীয় রাজনীতিক আবুল আলা মওদুদীর নেতৃত্বে ১৯৪১ সালের ২৬ আগস্ট। তখন এর নাম ছিল জামায়াতে ইসলামী, হিন্দ। বর্তমানে জামায়াতে ইসলামী শুধু বাংলাদেশে নয়, মিসর ও উত্তর আফ্রিকার মুসলিম ব্রাদারহুড, আফগানিস্তান এবং পাকিস্তানের তালেবান ও আল কায়েদার সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে জঙ্গী মৌলবাদের আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক সৃষ্টি করেছে। জামায়াতে ইসলামী এবং মুসলিম ব্রাদারহুডের এক ও অভিন্ন দর্শন হচ্ছে, ‘ধর্মের নামে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য যে কোন ধরনের হত্যা, নির্যাতন ও সন্ত্রাস ইসলামসম্মত।’ মিসরের মুসলিম ব্রাদারহুড আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একটি সন্ত্রাসী জঙ্গী সংগঠন, যার বলয় মিসর পেরিয়ে সারাবিশ্বেই বিস্তৃত। নামে ভিন্নতা থাকলেও আদর্শগত মিলের কারণে আল কায়েদা, আইএস, আনসারুল্লাহ, মুজাহিদীন, ব্রাদারহুড নামের বিশ্বের তাবৎ জঙ্গী-মৌলবাদী সংগঠনগুলোর সঙ্গেই বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর দ্বিপাক্ষিক সুসম্পর্ক বিদ্যমান। ফিলিস্তিন ইসরাইলের দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে বিশ্বের সব সচেতন নাগরিকই অবস্থান নিয়েছে। মানবাধিকারের অতিমাত্রায় অবমাননা সম্ভবত ইসরাইল ছাড়া বিশ্বের অন্য কোথায় হয় না। তারপরও মানবধিকার রক্ষার নিরপেক্ষ এ্যাডভোকেসির জন্য এ্যামনেস্টিকে সর্বতো সতর্ক থাকাই সবার কাম্য। অথচ সেক্ষেত্রেও দেখা যায় যে, সংগঠনটির এক ধরনের রেডিক্যাল চরমপন্থার দিকেই ঝুঁকে থাকার প্রবণতা। ২০১০ সালে এন্টি-ইসরাইলী, দখলদারিত্ব, ফিলিস্তিনী ও ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ বিষয়গুলোর ওপর গবেষণার জন্য এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল নিয়োগ দেয় ডেবোরা হাইম নামের এমন একজনকে যিনি নিজে একটিভিস্ট। তিনি ইসরাইলী দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে হামাস কর্তৃক প্রেরিত আত্মঘাতী বোমারুদের সঠিক মনে করতেন। তিনি ফিলিস্তিনী চরমপন্থীদের সঙ্গে এক হয়ে ইসরাইলবিরোধী বিভিন্ন একশনেও অংশগ্রহণ করেছেন। অথচ নিরপেক্ষতাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে জঙ্গী ভাবধারার একজনকে নিয়োগ দেয়া কতটুকু নৈতিক ও নিরপেক্ষতা, তা বিবেচনার বিষয় বৈকি! ২০১০ সালে অপর এক ঘটনায় লন্ডনের এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের প্রধান কার্যালয়ের জেন্ডার ইউনিটের প্রধান গীতা সায়গালকে বরখাস্ত করা হয়। গীতা সায়গাল লন্ডনের কেজ ইন্টারন্যাশনালের (ঈধমব রহঃবৎহধঃরড়হধষ) প্রধান মোহাম্মদ বেগের সঙ্গে এ্যামনেস্টির বিশেষ সংশ্লিষ্টতার বিরুদ্ধে খোলামেলা সমালোচনার জন্য বরখাস্ত হন। কেজ প্রধান মোহাম্মদ বেগের সঙ্গে বিশ্বের বিভিন্ন জঙ্গী মৌলবাদের, বিশেষ করে আল কায়দার গোপন সংশ্লিষ্টতার কথাই তখন গীতা সায়গাল বলেছিলেন। ২০১৫ সালে এই কেজ প্রধানের আইসিসের কসাই নামে খ্যাত ‘জিহাদী জন’-এর পক্ষে পাবলিকলি ওকালতির কারণে এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল খুবই বিব্রত হয় এবং মোহাম্মদ বেগের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা ত্যাগ করে। অথচ বেগের জঙ্গী মৌলবাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার সমালোচনার কারণে গীতা সায়গালকে অপমানজনকভাবে বহিষ্কার হতে হয়েছিল। অপর এক ঘটনায় এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের ডিরেক্টর অব ফেইথ এ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের ইয়াসমিন হুসেইন ২০১৫ সালে মিসরে এক ভিজিটে সেখানকার ব্রাদারহুডের এক নেতার বাসায় আতিথেয়তা গ্রহণ করেন। এছাড়াও তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন ইসলামিক রেডিকেল গ্রুপের সঙ্গে গোপন যোগাযোগের অভিযোগ রয়েছে। উল্লেখ্য, ইয়াসমিনের স্বামীকে কিছুদিন পূর্বে ব্রিটেনের আদালতে ব্রিটেনে এবং আরব দেশগুলোর ইসলামিস্টদের সঙ্গে গোপন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে (http:/ww/w.thetimes.co.uk/tto/news/uk/article4529234.ece)। অথচ ইয়াসমিন হুসেইনকেই এ্যামনেস্টির শীর্ষ পদে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। উগ্র জঙ্গীবাদে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করে, অথচ তাদের এ্যামনেস্টির শীর্ষ পদে বসিয়ে বিশ্বে মানবধিকার রক্ষা হবে কিভাবে তা আমার বোধগম্য নয়। ওপরের বিভিন্ন এবং খুবই সংক্ষিপ্ত আকারের আলোচনায় এটাই শুধু প্রমাণ হয়, আদর্শবাদী, মানবধিকার রক্ষার একচ্ছত্র অধিকর্তার ভূমিকায় যে সংগঠনটিকে আমরা এতদিন জেনেছি সে নিজে আসলে কতটুকু আদর্শ বা নৈতিকতায় বিশ্বাসী সে ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ আছে। সাদা-কালো অক্ষরে লেখা টেক্সটে যে নৈতিকতার কথা খোদ এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের কাছে বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ জেনেছে, তার সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার সময় নিঃসন্দেহে এখন বর্তমান। ৩০ লাখ বাঙালীর রক্তে কেনা যে স্বাধীনতা তা নিয়ে ‘নুইসেন্স’-এর অধিকার কারও নেই। আদর্শ এবং সততাই যদি বিশ্বাসের মূল ভিত্তি হয় তাহলে এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালকে এক চুল পরিমাণও বিশ্বাস করার কোন নৈতিক অবস্থান নেই। তাদের তৈরি বিবৃতি বা সংবাদ বিজ্ঞপ্তি সে ক্ষেত্রে একেবারেই মূল্যহীন একটা সাদা কাগজে কিছু কথার কথা মাত্র। এ থেকে বাঙালী জাতি তথা সারাবিশ্বের কাছে আরও একবার উন্মুক্ত হলো যে, আরও একটি জামায়াতের অর্থে নিয়োগপ্রাপ্ত লবিস্ট ফার্ম ‘দ্য এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল’। সে কারণেই উপসংহারের ভাষায় বলতে হয়- Shame on you Amnesty International. Stay away from Bangladeshs internal judiciary affairs. লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলামিস্ট [email protected]
×