ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

সরকারকে বিব্রত করার নীলনক্সা ॥ হিটলিস্ট অনুযায়ী গুপ্তহত্যা চলছে

প্রকাশিত: ০৫:২৯, ৩ নভেম্বর ২০১৫

সরকারকে বিব্রত করার নীলনক্সা ॥ হিটলিস্ট অনুযায়ী গুপ্তহত্যা চলছে

মোয়াজ্জেমুল হক/হাসান নাসির ॥ একের পর এক গুপ্তহত্যা ঘটেই চলেছে। খ্যাতনামা ব্লগার লেখকসহ ৫ জনকে এ পর্যন্ত চাঞ্চল্যকর ঘটনার পর হত্যাকারীদের কেউ ধরা যেমন পড়েনি। হত্যার ক্লুও উদ্ঘাটন করা যায়নি। ফলে মুক্তমনা লেখক মহলে এক ধরনের অনিশ্চিত উৎকণ্ঠার দিন দিন ভারি হচ্ছে। সরকার পক্ষে এ সমস্ত গুপ্তঘাতকদের আইনের আওতায় আনার কথা বলা হলেও রহস্যজনক কারণে সফলতা দৃশ্যমান নয়। কিন্তু হত্যাকা- ঘটাচ্ছে কারা? এই প্রশ্নের সুনির্দিষ্ট উত্তর এখনও মিলেনি। তবে নিঃসন্দেহে বলা যায়, এরা ইসলামের পক্ষের শক্তির দাবিদার হলেও মূলত বর্তমান সরকারবিরোধীদের সম্মিলিত একটি শক্তি। এরা হিটলিস্ট করে একের পর এক তাদের টার্গেট পূরণ করে চলেছে। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে মানুষ যাতে তাদের মনের ভাব লেখনীর মাধ্যমে প্রকাশ করতে না পারে এবং প্রগতিশীল শক্তিতে এগিয়ে নিতে সফল না হয় সেই লক্ষ্যে মৌলবাদী গোষ্ঠী জামায়াত-শিবির, জঙ্গীসহ বিভিন্ন ধর্মান্ধ শক্তিগুলো এখন এক হয়ে একদিকে সরকারকে অস্থিতিশীল করে তোলার প্রচেষ্টায় যেমন লিপ্ত তেমনি মুক্তমনা ব্লগার ও লেখকদের হত্যার মাধ্যমে প্রগতিমনাদের রুদ্ধ করে দিতে অপতৎপরতায় লিপ্ত রয়েছে। এর প্রমাণ হিসেবে ব্লগার হত্যা শুরু হয়েছে এবং তা গুপ্তপ্রক্রিয়ার মাধ্যমে। বিষয়টি ইতোমধ্যে চিন্তাশীল ও সাধারণ মানুষকে ভাবিয়ে তুলেছে। সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলো বিভিন্নভাবে সফলতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেও ব্লগার ও মুক্তমনা লেখকদের গুপ্তহত্যার ব্যাপারে কোন কিছু করতে পারছে না তা নিয়ে উদ্বেগ উৎকণ্ঠার বিস্তৃতি লাভ করছে। উল্লেখ্য, অসহিষ্ণুতা বেড়ে যাওয়ায় প্রতিবেশী দেশ ভারতে অতি সম্প্রতি প্রায় অর্ধশত লেখক ফেরত দিয়েছেন মর্যাদাপূর্ণ সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার। অথচ বাংলাদেশে একের পর এক লেখক ও প্রকাশক হত্যা এবং আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা ঘটে চললেও খ্যাতিমান লেখক ও বুদ্ধিজীবীদের তৎপরতায় এক ধরনের কঠোর ভূমিকা দৃশ্যমান নয়। বাংলা একাডেমিসহ রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখকদের যেন কিছুই বলার নেই। তারা রয়েছেন অনেকটা প্রতিক্রিয়াহীন অবস্থায়। কোন বক্তব্য কিংবা ভূমিকা দেখা যাচ্ছে না বাংলা একাডেমিরও। বিষয়টি সাহিত্যপ্রেমীদের হতবাক যেমন করেছে তেমনিভাবে ক্ষোভের জন্ম হয়েছে পাঠককুলে। তাছাড়া দেশের পুলিশ বাহিনী কেন যে বিজ্ঞানমনস্ক লেখক ও ব্লগার হত্যাকারীদের ধরতে পারে না সেটিও একটি প্রশ্নবোধক চিহ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের পুলিশের সক্ষমতা নেই এমনটি মনে করেন না সাধারণ মানুষ। বরং সফলতার সঙ্গে দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে সরকারের আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন সকলের। প্রচলিত একটি ধারণা হলোÑ সরকার চাইলে পুলিশ পারে, সরকার না চাইলে পুলিশেরও করার কিছুই নেই। অর্থাৎ পুলিশের পারা না পারা নির্ভর করে অনেকটা সরকারের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপরও। মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার দাবিতে ঢাকার শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের উত্থান এবং সেখানে লাখো মানুষের সমাগমের পর পুরো বিষয়টিকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার জন্য পরিকল্পিতভাবে আনা হয় ‘নাস্তিক’ ইস্যু। এর আগে শব্দটি বাংলাদেশে এত বেশি পরিচিত ছিল না। এক্ষেত্রে অপবাদটা শতভাগ গেছে ব্লগারদের ওপর। শিক্ষার দিক থেকে পিছিয়ে থাকা এদেশে ব্লগার ও নাস্তিক অনেকটা সমার্থক হয়ে দাঁড়িয়েছে। অবস্থায় এমন যে, এখন ব্লগার মানেই নাস্তিক। ব্লগার শব্দটি বেশির ভাগ মানুষের কাছে শোনায় গালাগালের মতোই। একজন ব্লগার খুনকে অনেকেই মনে করেন নাস্তিক হত্যা হিসেবে। এতে জনমনে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া খুব একটা হয় না। ফলে একের পর এক ঘটে চলেছে হত্যাকা-। সর্বশেষ খুন হয়েছেন জাগৃতি প্রকাশনীর মালিক ফয়সাল আরেফিন দীপন। এছাড়া ধারালো অস্ত্রের কোপে মারাত্মকভাবে জখম হন শুদ্ধস্বর প্রকাশনীর মালিক আহমেদ টুটুল। একই দিনের হামলায় আরও দুই ব্লগার মারাত্মকভাবে আহত হয়ে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন। একের পর এক এতগুলো ঘটনার পরও উল্লেখ করার মতো প্রতিক্রিয়া নেই রাষ্ট্রযন্ত্রের। বরং সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকা মন্ত্রী ও নেতাদের মুখ থেকে শোনা যায় অত্যন্ত আপত্তিকর মন্তব্য। এতে জনমনে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সোমবারও ঢাকার জনসভায় লেখক ও প্রকাশক হত্যাকা-ের জন্য দেশের উন্নয়ন বিরোধীদের অভিযুক্ত করেছেন। দেশ যখন উন্নয়নের পথে এগিয়ে চলেছে তখন তা বাধাগ্রস্ত করতে এবং বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের সুনাম ক্ষুণœ করতে পরিকল্পিতভাবে ষড়যন্ত্র এবং এ ধরনের নাশকতা চালানো হচ্ছেÑ এমনই বক্তব্য বেরিয়ে এসেছে তাঁর মুখ থেকে। এক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর আন্তরিকতার বহিঃপ্রকাশ নিয়ে কোন সন্দেহ থাকার কথা নয়। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এক্ষেত্রে সামান্যতম সফলতাও কেন আনতে পারছে না। তা নিয়ে সকল মহলে নানা প্রশ্নের উদ্রেক করেছে। উপরন্তু নির্লপ্ত ও নির্বিকার ভূমিকায় গুপ্তহত্যাকারীরা প্রশ্রয় পাচ্ছে বলে অভিযোগ নাগরিক সমাজের বিভিন্ন নেতৃবৃন্দের। এদিকে দেশের এমন নাজুক পরিস্থিতিতে নির্বিকার রয়েছেন খ্যাতিমান লেখক, সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীরাও। তাদের অনেকেই বাংলা একাডেমিসহ বিভিন্ন সংস্থার মর্যাদাপূর্ণ পদকের অধিকারী। সম্প্রতি দু’জন স্বীকৃত বিজ্ঞান লেখক অভিজিত রায় ও অনন্ত বিজয় দাশ, প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপন এবং আরও তিন ব্লগার হত্যাকা- ঘটেছে। জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে রয়েছেন আরেক প্রকাশক। কিন্তু সরাসরি লেখক ও প্রকাশক আক্রান্ত হওয়ার পরও দেশের প্রথিতযশা লেখকদের কোন বিবৃতি পর্যন্ত নেই। বাংলা একাডেমিকে বিবেচনা করা হয় বাংলা সাহিত্যের অথরিটি হিসেবে। সেই একাডেমিরও কোন ভূমিকা পরিলক্ষিত হচ্ছে না। এ বিষয়টি যুগোপৎ বিস্মিত ও ক্ষুব্ধ করেছে পাঠকদের। প্রগতিশীল রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মহল বর্তমান সরকারের এহেন নিশ্চুপ ও অকার্যকর আচরণে হতবাক। তাদের অনেকেরই প্রশ্নÑ সরকারের সঙ্গে যারা আছেন তাদের কেউ কেউ কি উগ্র মৌলবাদীদের ভোটও কামনা করেন? কিন্তু তারা কি কখনও আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়েছিল নাকি ভবিষ্যতে প্রগতিশীল শক্তির প্রতীকে ভোট দেবে? উগ্রবাদীরা আগেও কখনও মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তিকে ভোট দেয়নি, ভবিষ্যতেও যে দেবে না তা হলফ করে বলা যায়। বরং উগ্রদের দ্বারা যারা আক্রান্ত হচ্ছে সেই আধুনিক চিন্তা-চেতনার মানুষ এবং ধর্মনিরপেক্ষ চেতনায় বিশ্বাসী জনগোষ্ঠীই সব সময় পাশে থেকেছে এবং থাকবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে ক্ষমতাসীন মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তির জন্য বিষয়টি একটি বিরাট চ্যালেঞ্জ হয়ে অবতীর্ণ হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলোর মতে যারাই এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত, যারাই এদের ইন্ধন যোগাচ্ছে তাদের খুঁজে বের করা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের জন্য খুব বেশি কঠিন বলে সচেতন মহল মনে করে না। সঙ্গতকারণে বলা হচ্ছে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়ে এরা গুপ্তহত্যার পথ বেছে নিয়েছে। যা দেশ ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়েও বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে ব্যাপকভাবে আঘাত হানছে। সঙ্গত কারণে অতি দ্রুততম সময়ে বিষয়টি সর্বাগ্রে মাথায় রেখে সুরাহার পথ বের করা অতি জরুরী বলে সংশ্লিষ্ট সকলের ধারণা।
×