ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বাটিকের গ্রাম বান্টি

সাদা কাপড়ে রঙের মিশেল, হরেক রকম ছাপ

প্রকাশিত: ০৫:২৬, ৩ নভেম্বর ২০১৫

সাদা কাপড়ে রঙের মিশেল, হরেক রকম ছাপ

মোঃ খলিলুর রহমান ॥ রাজধানী ঢাকা থেকে ৩৫ কিলোমিটার পূর্ব-উত্তরের গ্রাম বাণ্টি। ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের পাশের এই গ্রামটি এক সময় ছিল চরম অবহেলিত। কৃষিকাজ ছাড়া এখানকার মানুষের কিছুই করবার ছিল না। কিন্তু এখন এ গ্রামের মানুষের ভাগ্য বদলেছে। সুনামের সঙ্গে তারা উপার্জন করছে টাকা। কুটির শিল্পের আওতায় বাণ্টিতে সাদা কাপড় রং করে স্থানীয়রা কাপড় তৈরি করছে। এ কাজে এসেছে তাদের যশ-খ্যাতি। গ্রামটি এখন বাটিকের গ্রাম বললে সকলেই চেনে। স্বল্প পুঁজিতে বেশি মুনাফা এবং ব্যাপক চাহিদা থাকায় অনেকেই ঝুঁকে পড়ছে এ পেশায়। বাণ্টিতে এখন কেউ বেকার নেই বললেই চলে। পাশাপাশি অন্য জায়গা থেকে কাজের সন্ধানে অনেকে বাণ্টিতে ছুটে আসছেন। কাকডাকা ভোর থেকে রাত পর্যন্ত এ গ্রামে চলে শুধু কাজ আর কাজ। কেউ সাদা কাপড়ে রঙের কাজ, কেউ ব্লকের কাজ, কেউ ভেজা কাপড় রোদে শুকানোর কাজ করছেন। রাস্তা, বাড়ির উঠোন, ঘরের ছাদসহ ফাঁক-ফোকরে বাটিকের থ্রি-পিস (ওড়না, সালোয়ার-কামিজ), বিছানার চাদর ও বালিশ কভারের কাপড় রোদে শুকানোর জন্য ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাখা হয়েছে। গ্রামের পথে পথে উড়ছে রং বে-রঙের কাপড়। বাটিক তৈরির জন্য এ গ্রামে ছোটবড় মিলে অর্ধশত কারখানাও গড়ে উঠেছে। গ্রামটির বাসিন্দা ও কারিগর মাফি মিয়া (২২)। তিন বছর ধরে তিনি এ কাজ করছেন। এতে স্বাচ্ছন্দ্যও বোধ করেন তিনি। শুধু মাফি মিয়াই নয়, তার মতো নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলার দুপ্তারা ইউনিয়নের বাণ্টি গ্রামের পাঁচ শ’ থেকে সাত শ’ পরিবার বাটিকের কাজ করে আরাম-আয়েশেই জীবন কাটাচ্ছে। এসব কাপড় বিক্রির জন্য বাণ্টি বাজারে গড়ে উঠেছে কয়েকটি বহুতল মার্কেট। বাটিকের থ্রি-পিস (ওড়না, সালোয়ার, কামিজ), বিছানার চাদর ও বালিশের কাপড় কিনতে দূর-দুরান্ত থেকে ছুটে আসছেন পাইকাররা। তারা এ গ্রাম থেকে বাটিকের কাপড় কিনে ট্রাকযোগে রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় বিক্রির জন্য নিয়ে যাচ্ছেন। মাফির পাশাপাশি শরীফ, নিশাদ, রাকিবুলও এ কাজ করছেন দীর্ঘদিন। এ কাজে মাসে ১৪-১৬ হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করে তারা। রুকিয়া বেগম (৩৫) এই কাপড় ভাঁজ করার কাজ করছেন। রুকিয়া গত দুই বছর এ কাজে এসেছেন। বাণ্টি গ্রামের পাশের গ্রামে তার বাড়ি। প্রতিদিন সকালে স্বামীসহ কাজে আসেন তিনি। এ কাজ করে ৮ থেকে ৯ হাজার টাকা আয় করেন রুকিয়া। দুজনের আয় দিয়েই তিনি ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া করাচ্ছেন। তার ২ মেয়ে ১ ছেলে। ছেলে কাউসার ৯ম শ্রেণীতে পড়ছে। মেয়ে সুমাইয়া ৬ষ্ঠ ও সোহানা ২য় শ্রেণীতে পড়ছে। আবু বকর ছিদ্দিক। এক সময় দুবাই থাকতেন। বর্তমানে দেশেই বাটিকের ব্যবসা শুরু করছেন। নিজেই সাদা কাপড়ে নানা রং মেশাচ্ছেন। তিনি জানান, এখানে সাদা কাপড়ে বিভিন্ন রং ব্যবহার করা হয়। দৈনিক ৮০-১০০টি বাটিক কাপড় তৈরি করতে পারেন একজন শ্রমিক। আবু বকর ছিদ্দিক জানান, প্রথমে সাদা কাপড় কিনে আনতে হয়। পরে সাদা কাপড়ে ব্লক (ছাপ) করতে হয়। ব্লকের পর কাপড়ে রং দিতে হয়। এরপর আবারও ব্লক (ছাপ) করতে হয়। পরে কাপড়টি রোদে শুকোলেই বাটিকের কাপড়ে তৈরি হয়। ছানাউল্ল্যাহ জানান, তিনি বাটিকের ব্যবসা করে নিজেই এখন স্বাবলম্বী হয়েছেন। বাটিকের আয় দিয়ে তিনি ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া করাচ্ছেন। আরেক বাটিক ব্যবসায়ী শফিকুল ইসলাম জানান, তাদের তৈরি বাটিকের কাপড় রাজধানী ঢাকাসহ পাশের নরসিংদীর মাধবদী, শেকেরচর-বাবুরহাট, খুলনা, টাঙ্গাইল, চট্টগ্রাম, যশোর, রাজশাহী, কুষ্টিয়া, বরিশাল ও দিনাজপুরসহ বহু এলাকায় বিক্রি হচ্ছে। পাইকাররা স্থানীয় বাজার থেকে এসব কাপড় কিনে নিয়ে যান। বাটিকের এ কাপড় দিন দিন সমগ্র বাংলাদেশেই ছড়িয়ে পড়ছে। তিনি আরও জানান, বাটিকের একটি থ্রি-পিস (ওড়না, সালোয়ার, কামিজ) ২২০-৭২০ টাকায় ও বিছানার চাদর ৪০০-৮০০ টাকায় বিক্রি হয়। বাটিক ব্যবসায়ী মাজাহারুল ইসলাম মোল্লা জানান, ১৫ বছর আগে বাণ্টি গ্রামে তার বাবা মরহুম হাজী মোঃ নূরুল ইসলাম মোল্লা বাটিকের ব্যবসা শুরু করেন। ধীরে ধীরে তার সুনাম ও কাজ ছড়িয়ে পড়ে পুরো গ্রামে। এখন গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে কমবেশি বাটিকের কাপড় তৈরি হচ্ছে। তিনি আরও জানান, বর্তমানে পাঁচ শ’ থেকে সাত শ’ পরিবার বাটিকের এ ব্যবসায় জড়িত। বাণ্টি গ্রামের বাটিক ব্যবসাকে কেন্দ্র করে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের বাণ্টি বাসস্ট্যান্ডে গড়ে উঠেছে বড় বড় বেশ কয়েকটি বাটিক কাপড়ের মার্কেট। গড়ে উঠেছে ৩শ’ থেকে ৪শ’ বাটিকের শো-রুম। বাণ্টি গ্রামে ছোট-বড় মিলে অর্ধশত বাটিক তৈরির কারখানা রয়েছে। কারখানাগুলো বাড়ির ভেতরেই অবস্থিত। তাই এসবের মধ্যে পরিবারের সদস্যরাই বেশিরভাগ কাজ করে থাকেন। তবে অন্য গ্রাম থেকেও এ গ্রামে বাটিকের কাজ করতে ছুটে আসছেন অভাবী লোকজন। বাটিকের গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, কেউ সাদা কাপড়ে সুতো দিয়ে গিঁট দিচ্ছেন, কেউ কাপড়ে ব্লক (ছাপ) দিচ্ছেন, কেউবা রং মেশানো পানিতে সেগুলো ডুবিয়ে দিচ্ছেন, কেউ সেগুলো পানি থেকে তুলে রোদে শুকাতে দিচ্ছেন। আবার কেউ বাটিক করা কাপড় ভাঁজ করছেন। পুরুষের পাশাপাশি নানা বয়সের নারীরাও বাটিক কাপড় তৈরিতে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। সাদা কাপড়ে বাটিকের কাজ করে গ্রামের লোকজনের জীবন-যাত্রা পাল্টে গেছে। পরিবারের যে সকল নারী ও পুরুষ কোন কাজ করার সুযোগ পেত না, সংসারে অভাব-অনটন লেগেই থাকত, তারা এখন সারাদিন ব্যস্ত থাকেন বাটিকের কাজে। বাটিকের কাজের আয় দিয়েই চলছে তাদের পুরো সংসার। হয়ত বাটিকের ব্যবসায়ই বাণ্টি গ্রামের চেহারাই একদিন পাল্টে দেবে। টিনের তৈরি বাড়িঘরের স্থলে গড়ে উঠবে বহুতল ভবন। সম্ভবত বাণ্টি গ্রামের মানুষের জন্য সে দিন আর বেশি দূরে নয়।
×