ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

চট্টগ্রামে শ্রমিক ও মালিক সংগঠনের স্টিকারে লেখা ‘এএফআর’

অটোরিক্সা চলে গোপন চুক্তিতে

প্রকাশিত: ০৫:৫০, ২ নভেম্বর ২০১৫

অটোরিক্সা চলে গোপন চুক্তিতে

আহমেদ হুমায়ুন, চট্টগ্রাম অফিস ॥ রেজিস্ট্রেশন ছাড়াই বন্দরনগরী চট্টগ্রামে চলাচল করছে প্রায় পাঁচ হাজার সিএনজিচালিত অটোরিক্সা। সড়ক-মহাসড়কে অটোরিক্সা চলাচলে রেজিস্ট্রেশন দেয়ার একমাত্র প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) হলেও অভিযোগ রয়েছে, এখানে ভিন্ন ভিন্ন রঙের স্টিকার লাগিয়ে অটোরিক্সার বৈধতা দিচ্ছে অটোরিক্সা মালিক-শ্রমিকদের তিনটি সংগঠন। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে, সিএমপির ট্রাফিক বিভাগের সঙ্গে অনৈতিক গোপন একটি নির্ধারিত ফি’র বিনিময়ে মালিক-শ্রমিকদের এসব সংগঠন নতুন অটোরিক্সাগুলোকে বৈধতা প্রদান করে থাকে। শুধু বৈধতা প্রদানই নয়, মালিক-ড্রাইভারদের নিকট থেকে নিয়মিত নির্ধারিত মাসিক চাঁদা আদায় করছেন তারা। এদিকে, বিগত দশ বছর ধরে মালিক-শ্রমিকদের এসব সংগঠন রেজিস্ট্রেশন প্রদানের নামে প্রকাশ্যে চাঁদাবাজি করলেও তাদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেন না ট্রাফিক কর্তৃপক্ষ। ট্রাফিক বিভাগের নির্লিপ্ততায় অবৈধভাবে রেজিস্ট্রেশনহীন অটোরিক্সা চলতে দিয়ে কোটি কোটি টাকার মালিক হচ্ছেন শ্রমিক সংগঠনগুলোর নেতারা। অভিযোগ রয়েছে, এই টাকার একটি বিরাট অংশ ট্রাফিক বিভাগের কর্মকর্তারাও পাচ্ছেন। তবে ট্রাফিক বিভাগ বলছে, আদালতের নিষেধাজ্ঞা থাকায় তারা অবৈধ অটোরিক্সার বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করতে পারছে না। জানা যায়, চট্টগ্রাম অটোরিক্সা-অটোটেম্পো শ্রমিক ইউনিয়ন থেকে সিএনজিচালিত অটোরিক্সার রেজিস্ট্রেশন নিতে ওই সংগঠনকে দিতে হয় ১২শ’ ৫০ টাকা। এরপর প্রতি মাসে অটোরিক্সাপ্রতি ৩০০ থেকে ১০০০ টাকা দিতে হয়। এরমধ্যে ড্রাইভার যাদের নিজস্ব সিএনজিচালিত অটোরিক্সা আছে তাদের নিকট থেকে নেয়া হয় ৩০০ টাকা এবং মালিকদের নিকট থেকে নেয়া হয় ১০০০ টাকা। অন্য দুটি সংগঠন চট্টগ্রাম বেবিট্যাক্সি ড্রাইভার-সহকারী ইউনিয়ন ও চট্টগ্রাম বেবিট্যাক্সি-সিএনজি মালিক সমিতিও একই পন্থায় অবৈধভাবে রেজিস্ট্রেশন প্রদান করে প্রতি মাসে লাখ লাখ টাকা আয় করছে। অভিযোগ রয়েছে, চট্টগ্রাম অটোরিক্সা-অটোটেম্পো শ্রমিক ইউনিয়নের ব্যানারে মূলত ওই রেজিস্ট্রেশন প্রদান করেন সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক হারুনুর রশিদ। তিন সংগঠনের ব্যানারে হলেও মূলত এসব অটোরিক্সার অধিকাংশরই রেজিস্ট্রেশন হয় প্রভাবশালী এই শ্রমিক নেতার ইশারায়। সরেজমিন দেখা গেছে, গাড়ির পেছনে লেখা থাকে চট্ট মেট্রো-থ-১২-অ ঋ জ এবং গাড়ির সামনের গ্লাসে লাগানো থাকে হারুনের স্বাক্ষরিত লাল রঙের বিশেষ স্টিকার। এই স্টিকার লাগানো থাকলে বিআরটিএ কিংবা ট্রাফিক সার্জেন্ট তা আটক করেন না। এই বিশেষ স্টিকারের মাধ্যমে হারুন প্রতি মাসে অটোরিক্সা থেকে অর্ধকোটি টাকা হাতিয়ে নেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এই অর্থের বড় একটি অংশ পুলিশ এবং বিআরটিএ কর্তৃপক্ষকেও দেয়া হয় বলে অনুসন্ধানে জানা গেছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম অটোরিক্সা-অটোটেম্পো শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক হারুনুর রশিদ বলেন, ২০০৫ সালের পর চট্টগ্রাম মহানগরীতে আর কোন অটোরিক্সার রেজিস্ট্রেশন প্রদান করা হয়নি। বিগত ১০ বছর ধরে নতুন রেজিস্ট্রেশন না দেয়ায় অটোরিক্সাগুলোর নিবন্ধন করা যায়নি। এ বিষয়ে আদালতে রিট করা হয়েছে। আদালত নিবন্ধনহীন অটোরিক্সা চলাচলে বাধা সৃষ্টি না করতে নির্দেশ দিয়েছে।’চাঁদা নেয়ার বিষয়ে এই শ্রমিক নেতা বলেন, ‘আমাদের সংগঠন থেকে যারা রেজিস্ট্রেশন নেন তাদের নিকট থেকে আমরা মাসিক চাঁদা নেই এটা সত্য। তবে ওই টাকাগুলো আমরা ড্রাইভার, শ্রমিক ও মালিকরা কোন বিপদে পড়লে তাদের পেছনে খরচ করি।’ পরিবহন সূত্রে জানা গেছে, ২০১৩ সালে চট্টগ্রাম অটোরিক্সা-অটোটেম্পো শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক হারুনুর রশিদের করা রিট (১১৫৯৪/২০১৩) হাইকোর্ট গত ২১ মে সম্পূর্ণভাবে খারিজ করে দেয়। এ রিটটি শুনানি না হওয়া পর্যন্ত দীর্ঘ সময় ধরে রাস্তায় চলাচল করে আসছিল অনিবন্ধিত সিএনজি অটোরিক্সা। রিটটি খারিজ করে দিলে পরে পুলিশ রাস্তায় অভিযান চালিয়ে বিপুলসংখ্যক সিএনজি অটোরিক্সা জব্দ করে। পরে হাইকোর্টের এ আদেশের বিরুদ্ধে সুপ্রীমকোর্টের আপীলেড ডিভিশনে একটি আপীল করেন হারুনুর রশিদ। গত ২৮ মে শুনানি না হওয়া পর্যন্ত চার সপ্তাহের জন্য সিএনজি অটোরিক্সাগুলোকে চলাচলের অনুমতি প্রদান করে সুপ্রীমকোর্ট। পরে হারুনুর রশিদ বাদী হয়ে আরেকটি রিট আবেদন করেন। ১২০০ সিএনজিচালিত অটোরিক্সা মালিকের নামে করা ওই রিটের শুনানিতে মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত নিবন্ধনহীন সিএনজিচালিত অটোরিক্সা চলাচলে বাধা সৃষ্টি না করতে নির্দেশ দিয়েছে আদালত। তবে কতটি সিএনজিচালিত অটোরিক্সা এই রিটের অধীনে থাকবে সেটি নির্দিষ্ট করা হয়নি। চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) একেএম শহীদুর রহমান অবৈধ সিএনজি অটোরিক্সা চলাচলের সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, ‘নিবন্ধনহীন অটোরিক্সাগুলোর মালিকদের করা দুটি রিটের কারণে আমরা ওই অটোরিক্সার বিরুদ্ধে অভিযানে যেতে পারছি না। আদালত থেকে নিবন্ধনহীন অটোরিক্সাগুলোর চলাচলে বাধা সৃষ্টি করতে নিষেধ করা হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘রিটগুলোর নিষ্পত্তি হওয়ার পর আমরা অভিযানে যাব। তখন চট্টগ্রাম নগরীতে কোন অবৈধ সিএনজি অটোরিক্সা চলতে দেয়া হবে না।’
×