অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ সরকারী ক্রয়ে অপচয় রোধ করতে হবে। কেননা কার্যকর ও স্বচ্ছ সরকারী ক্রয় প্রক্রিয়া একটি দেশের কাক্সিক্ষত প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বলা হয়েছে আধুনিক ও কার্যকর সরকারী ক্রয় ব্যবস্থাপনা প্রতিযোগিতার সক্ষমতা বৃদ্ধি করে, সেই সঙ্গে সেবার মান বাড়ায় এবং জনগণের বিশ্বাস তৈরি করে। রবিবার তৃতীয় দক্ষিণ এশিয়া আঞ্চলিক সরকারী ক্রয় সম্মেলনে এ তাগিদ দেয়া হয়েছে। সম্মেলনে কেনাকাটায় সঠিক পরিমাণ, সঠিক সময় ও সঠিক স্থান তিনটিকে বিবেচনা নিয়েই প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নেয়ার কথা বলা হয়েছে, এতে সরকারী ক্রয়ে পেশাদারিত্ব আসবে বলে মনে করা হচ্ছে।
বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) সহযোগিতায় রাজধানীর গুলশানে হোটেল ওয়েস্টিনে তিন দিনের এ সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) সচিব শহীদ উল্লা খন্দকারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী এমএ মান্নান, বিশ্বব্যাংকের ভারপ্রাপ্ত কান্ট্রি ডিরেক্টর মার্টিন রামা ও এডিবির কান্ট্রি ডিরেক্টর কাজুহিকো হিগুচি। বক্তব্য রাখেন সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট টেকনিক্যাল ইউনিটের (সিপিটিইউ) মহাপরিচালক ফারুক হোসেন।
পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, সরকারী কেনাকাটায় শতকরা ১০ ভাগ অপচয় রোধ হলে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি শূন্য দশমিক ৫ ভাগ বাড়বে। তিনি বলেন, সঠিক দামে সরকারী পণ্য কেনার পাশাপাশি পণ্য কতদিন পর্যন্ত টেকসই হবে সেই বিষয়টিও দেখতে হবে। এছাড়াও, ক্রয়কৃত পণ্যটি ব্যবহারের ফলে পুরনো হলে তখন এর বিক্রয়মূল্য কত হবে এ বিষয়টিও বিবেচনায় রাখতে হবে। তবেই পণ্য ক্রয়ে অপচয় রোধ হবে। তিনি আরও বলেন, সরকারী ক্রয়ে যে অর্থ ব্যয় হয় ভুলে গেলে চলবে না তা করদাতাদের অর্থ। কাজেই জনগণের অর্থ তাদের উন্নয়নে সঠিকভাবে ব্যবহারে আমাদের আরও দক্ষতা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা দেখাতে হবে। এই জন্য সরকারী ক্রয়ে ডিজিটালাইজেশনের কোন বিকল্প নেই। মন্ত্রী আরও বলেন, সব মন্ত্রণালয়ের সকল ক্রয় কার্যক্রম পেপারলেস হয়ে যাবে। এবারের সপ্তম-পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় গড় জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৪ শতাংশ ধরা হয়েছে। এই প্রবৃদ্ধি অর্জনে ব্যাপক সরকারী বিনিয়োগ হবে। একে অর্থবহ করতে হলে পণ্য ক্রয়ে ডিজিটালাইজেশনের কোন বিকল্প নেই। সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী এমএ মান্নান বলেন, আমাদের সব সময় একটা কথা শুনতে হয় তাহলো জনগণের অর্থ আমরা কিভাবে ব্যয় করছি। এ জন্যই আমরা সরকারী ক্রয় প্রক্রিয়া ডিজিটালাইজড করেছি যাতে সরকারের জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত হয়। বাংলাদেশে নিযুক্ত বিশ্বব্যাংকের ভারপ্রাপ্ত কান্ট্রি ডিরেক্টর মার্টিন রামা বলেন, দক্ষিণ এশিয়ায় অবকাঠামো ও জ্বালানি খাতে মোট ১ দশমিক ৫ ট্রিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ লাগবে। একইসঙ্গে বাংলাদেশের মোট বাজেটের এক-চতুর্থাংশ ব্যয় হয় ক্রয় কার্যক্রমে। এত বেশি বিনিয়োগে ইলেকট্রনিক প্রকিউরমেন্টের কোন বিকল্প নেই। সেই সঙ্গে প্রকিউরমেন্ট কার্যক্রমে বেসরকারী খাতকেও অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। তিনি আরও বলেন, বিশ্বব্যাংক ক্রয়সংক্রান্ত পলিসি তৈরিতে ২০০২ সাল থেকেই বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করছে। বিশ্বব্যাংক ক্রয়সংক্রান্ত কাজে কমপ্লায়েন্সের পাশাপাশি পারফর্মেন্স বাড়াতেও সরকারের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে। বাংলাদেশে নিযুক্ত এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর কাজুহিগু হিগুইচি বলেন, বাংলাদেশের ক্রয় কার্যক্রম ডিজিটালাইজড্ করতে সরকারকে প্রয়োজনীয় সবরকম সাহায্য দেবে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক। সেজন্য আমরা ইতোমধ্যেই কাজ শুরু করেছি। বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের সচিব শহীদউল্লা খন্দকার বলেন, বাংলাদেশে ই-জিপি কার্যকম সফলতার সঙ্গে পরিচালিত হচ্ছে। ধীরে ধীরে সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে এর আওতায় নিয়ে আসা হবে। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্যে সিপিটিউর মহাপরিচালক ফারুক হোসেন বলেন, এই সম্মেলনের মধ্য দিয়ে পারস্পারিক অভিজ্ঞতা ও নতুন নতুন মেথডসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে মতবিনিময়ের মাধ্যমে পারস্পারিক সহযোগিতা বৃদ্ধি পাবে। ফলে ই-জিপি কার্যক্রম শক্তিশালী হবে।
এবারের তৃতীয় দক্ষিণ এশিয়া আঞ্চলিক সরকারী ক্রয় সম্মেলনের মূল প্রতিপাদ্য হলো টেকসই ক্রয় কার্য সম্পাদনে উদ্ভাবন। দুপুরে সম্মেলনের দুটো কারিগরি অধিবেশনে সরকারী ক্রয়ে সুষ্ঠু সম্পাদনা, পেশাদারিত্ব, সংস্কার ও প্রযুক্তির মাধ্যমে ক্রয় দক্ষতা বৃদ্ধি এবং সেলক্ষ্যে নতুন নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবনের বিষয়ে উপস্থাপনা, আলোচনা ও অভিজ্ঞতা বিনিময় করা হয়। সম্মেলনে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার আটটি দেশের সরকারী ক্রয় কাজে সম্পৃক্ত কর্মকর্তাগণ, ঠিকাদার, সুশীল সমাজের প্রতিনিধিবৃন্দ, বিশ্বব্যাংক ও এডিপির উর্ধতন কর্মকর্তাসহ পঞ্চাশজন দেশী-বিদেশী ব্যক্তি এ সম্মেলনে অংশগ্রহণ করছেন। সরকারী ক্রয়বিষয়ক এ ধরনের বৃহৎ সম্মেলন বাংলাদেশে এটিই প্রথম। এর আগে ২০১১ সালে নেপালে প্রথম ও ২০১৪ সালে পাকিস্তানে দ্বিতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। শুরু হওয়া তৃতীয় সম্মেলনে দক্ষিণ এশিয়া আঞ্চলিক সরকারী ক্রয় নেটওয়ার্কের সভাপতি হিসেবে সিপিটিইউর মহাপরিচালক মোঃ ফারুক হোসেন দায়িত্ব গ্রহণ করেন। আগামী ৩ নবেম্বর রাজধানীর গুলশানের হোটেল ওয়েস্টিনে এ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সরকারী ক্রয়ের ক্ষেত্রে একটি কার্যকরী আঞ্চলিক নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠা এবং সে লক্ষ্যে প্রণীত কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে ঢাকা ঘোষণা গ্রহণের মধ্য দিয়ে শেষ হবে এ সম্মেলন।