ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ভাড়া বৃদ্ধির প্রথম দিনেই নৈরাজ্য ॥ মোবাইল কোর্টের জরিমানা

সিএনজি অটো চলছে না মিটারে, ইচ্ছেমতো ভাড়া আদায়

প্রকাশিত: ০৫:২৯, ২ নভেম্বর ২০১৫

সিএনজি অটো চলছে না মিটারে, ইচ্ছেমতো ভাড়া আদায়

স্টাফ রিপোর্টার ॥ রাজধানীর বনশ্রীর বাসিন্দা হারুন হাবিব নিয়মিত কমলাপুর অফিস করেন। রিক্সা না পেলে মাঝে মধ্যে সিএনজি অটোরিক্সায় চাপতে হয় তাকে। ভাড়া মোটামুটি ১২০ টাকার মধ্যেই ছিল। সরকারের ভাড়া বৃদ্ধির ঘোষণার পর সিএনজি চালকরা ১২০ টাকায় আর যেতে রাজি হচ্ছিল না। দিন কয়েক আগে একজন সিএনজি চালক হারুন হাবিবকে বলেছিলেন আর মাত্র ক’টা দিন এই ভাড়া আপনি নিজেই ২০০ টাকা দেবেন সে ব্যবস্থা হচ্ছে। রবিবার সিএনজি ভাড়া বৃদ্ধির প্রথম দিনে সেই হারুন হাবিব অসহায় হয়ে পড়লেন সিএনজি চালকদের কাছে কেউই ২০০ টাকার নিচে যেতে চাইল না। সিএনজি চালকদের দৌরাত্ম্যের কাছে অসহায় হয়ে পড়লেন তিনি। শেষ পর্যন্ত রফা হলো ১৮০ টাকায়। তিনি জানতে চেয়েছিলেন মিটারে চলবে তো? সিএনজি চালক উল্টো জানতে চাইল কিসের মিটার। ভাড়া বৃদ্ধির পর শহরজুড়েই এই নৈরাজ্য চলছে। এমনিতেই সিএনজিচালিত অটোরিক্সাগুলো মিটারে যাত্রী বহন না করে তিনগুণ ভাড়া আদায় করে আসছিল। এর ওপর সরকার সিএনজির দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্তের সঙ্গে সঙ্গে সিএনজি মালিকরা ভাড়া বাড়ানোর আব্দার করল। সরকারও তাদের আব্দার রক্ষা করল। কিন্তু যাত্রীর নিরাপত্তা বলতে গুটিকয়েক মোবাইল কোর্ট ছাড়া কিছু নেই। তাও আবার চলে ঘড়ি মেপে। এমনও দেখা গেছে সিএনজিতে ওঠার পর যাত্রীকে জিম্মি করে ফেলে চালক। আর নারী হলে তো কথাই নেই। তাকে বাধ্য করা হয় বলতে তিনি মিটারেই যাচ্ছেন। রাজধানীতে গণপরিবহনের নৈরাজ্যের মধ্যে মোবাইল কোর্টের কাছে বাহন হারালে কিভাবে গন্তব্যে পৌঁছাবেন সেই আশঙ্কায় প্রতিবাদটুকুও করতে পারেন না যাত্রীরা। যাত্রীদের অনেকেই বলছেন এই প্রথার তো ব্যতিক্রম নেই। আরেকজনের কাছে গেলেও একই অবস্থা। আর চালকরা যত সংগঠিত এবং শক্তিশালী যাত্রীরা তা কোথায়? এর পরও রবিবার ভাড়া বৃদ্ধির প্রথম দিনে ৬টি স্পটে বিআরটিএর ভ্রাম্যমাণ আদালতের পাশাপাশি ঢাকা জেলা প্রশাসন পরিচালনা করে আরও ৩টি ভ্রাম্যমাণ আদালত। তাছাড়া চালক, মালিক, বিআরটিএ ও ট্রাফিক পুলিশের সমন্বয়ে মনিটরিং টিমও কাজ করছে। রাজধানীর মানিক মিয়া এ্যাভিনিউ স্পটে সিএনজি চালিত অটোরিক্সায় মিটার সংযোজন না করা ও অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে। বিআরটিএর ম্যাজিস্ট্রেট মোবাশ্বের আলম জানান, রবিবার সকাল থেকে মানিক মিয়া এ্যাভিনিউয়ে দুটি ভ্রাম্যমাণ আদালত ছাড়াও রামপুরা, খিলক্ষেত, কলাবাগান ও কাওরানবাজারে অভিযান পরিচালনা করে বিআরটিএ। এর মধ্যে মানিক মিয়া এ্যাভিনিউয়ে দুপুর একটায় অভিযান শেষ হয়েছে। দুপুর একটা পর্যন্ত এ অভিযানে মানিক মিয়া এ্যাভিনিউয়ে দশটি মামলা, ৮ হাজার ৫০০ টাকা জরিমানা এবং তিনটি সিএনজি চালিত টোরিক্সা ডাম্পিংয়ে পাঠানো হয়েছে। মোবাশ্বের আলম আরও জানান, বিআরটিএ আইন অনুযায়ী সিএনজি চালিত অটোরিক্সার বিরুদ্ধে দুই হাজার টাকার ওপরে জরিমানা করার বিধান নেই। এ জন্য মিটার অনুযায়ী ভাড়া না নিলে এবং নিয়ম ভঙ্গ করলে কোন কোন ক্ষেত্রে পাঁচ শ’, এক হাজার এবং সর্বোচ্চ দুই হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা করা হচ্ছে। তিনি জানান, সকাল থেকে তারা সিএনজি চালিত অটোরিক্সাগুলোর ওপর নজরদারি করছেন। অটোরিক্সার ভাড়া বাড়ার পর কেউ যাতে আর অতিরিক্ত ভাড়া না নিতে পারেন এবং চালকরা যাতে মিটারে চলেন সে জন্য এ অভিযান ও কড়া নজরদারি অব্যাহত থাকবে। এর আগে সকাল সাড়ে দশটায় মানিক মিয়া এ্যাভিনিউয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালতের কার্যক্রম পরিদর্শন করেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তিনি আজ রাজধানীর শাহবাগ এলাকায় ভ্রাম্যমাণ আদালতের কার্যক্রম পরিদর্শন করবেন। প্রাইভেট নাম দিয়ে মিটার ছাড়াই সিএনজি চালিত অটোরিক্সার অতিরিক্ত ভাড়া আদায় নিয়ে প্রশ্ন করা হলে মন্ত্রী বলেন, গত কয়েকদিনে এক থেকে দেড় শ’ প্রাইভেট সিএনজি চালিত অটোরিক্সাকে এ অভিযোগে ডাম্পিংয়ে পাঠানো হয়েছে । ওবায়দুল কাদের সিএনজি চালিত অটোরিক্সার অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানাতে বিআরটিএর ৪টি নম্বরও উল্লেখ করেন। নম্বরগুলো হচ্ছেÑ৯১১৩১৩৩, ৫৮১৫৪৭০১, ৯১১৫৫৪৪, ৯০০৭৫৭৪। অফিস সময়ে এসব নম্বরে ফোন করে যে কেউ অভিযোগ দিতে পারবেন। পুনর্নির্ধারিত ভাড়া অনুযায়ি প্রথম দুই কিলোমিটারের জন্য ভাড়া ঠিক করা হয়েছে ৪০ টাকা, যা আগে ২৫ টাকা ছিল। নিয়ম অনুযায়ী অটোরিক্সায় উঠলে এটাই সর্বনিম্ন ভাড়া হওয়ার কথা, যদিও ওই ভাড়া বা ওই দূরত্বে যেতে কখনই রাজি হন না চালকরা। বর্ধিত ভাড়া হিসেবে এবার প্রথম দুই কিলোমিটারের পরে প্রতিকিলোমিটারের ভাড়া ৭ টাকা ৬৪ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ১২ টাকা করা হয়েছে। যানজট বা অন্য কোন কারণে আটকে থাকলে প্রতি মিনিট বিরতির জন্য যাত্রীকে গুনতে হবে ২ টাকা করে, আগে যা ছিল ১ টাকা ৪ পয়সা। ভাড়া বাড়ানোর সঙ্গে বাড়ছে চালকদের জন্য দৈনিক জমার পরিমাণও। মালিকের জমা বাবদ পহেলা নবেম্বর থেকে প্রতিদিন সর্বোচ্চ ৯০০ টাকা করে দিতে হবে চালককে, যা দিতে হতো ৬০০ টাকা। যদিও বাস্তবে আগে থেকেই মালিকরা আদায় করছিল এক হাজার ২০০ টাকা। চালকদের অভিযোগ এখন তা ১ হাজার ৬০০ করেছে মালিকরা। এদিকে রাজধানীর গণপরিবহনে নৈরাজ্য বন্ধের দাবি জানিয়েছে ১২ সংগঠন। এক যৌথ বিবৃতিতে ঢাকায় চলাচলকারী গণপরিবহনে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় ও যাত্রীদের হেনস্থা করার অভিযোগ করেছেন পরিবেশ ও নাগরিক অধিকার সংরক্ষণকর্মীরা। এই নৈরাজ্য ঠেকাতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ব্যর্থ হচ্ছে বলে তাদের অভিযোগ। রবিবার ১২টি বেসরকারী সংগঠনের এক যৌথ বিবৃতিতে এসব অভিযোগ করা হয়। নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক আশীষ কুমার দে প্রেরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এই তথ্য জানানো হয়। এ ব্যাপারে সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন সংগঠনগুলোর নেতারা। বিবৃতিতে বলা হয়, রবিবার থেকে অটোরিক্সার বাড়তি ভাড়া কার্যকর হযেছে। কিন্তু এই ক্ষুদ্র বাহনের চালকরাও আগে থেকেই বাড়তি ভাড়া আদায় করছেন এবং আজ থেকে এর পরিমাণ আরও বাড়িয়ে দিয়েছেন। বিবৃতিদাতারা হলেন নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির উপদেষ্টা মনজুরুল আহসান খান, গ্রীন ক্লাব অব বাংলাদেশের (জিসিবি) সভাপতি নুরুর রহমান সেলিম, সিটিজেন্স রাইটস মুভমেন্টের সভাপতি মেজর (অব) মোঃ মফিজুল হক সরকার, বাংলাদেশ যাত্রী অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের সভাপতি তুসার রেহমান, নিরাপদ সড়ক ও নৌপথ বাস্তবায়ন জোটের সদস্যসচিব রফিকুল ইসলাম সবুজ, নদী রক্ষা শপথের (নরশ) আহ্বায়ক জসি সিকদার, সম্মিলিত জলাধার রক্ষা আন্দোলনের সদস্য সচিব মশিউর রহমান রুবেল, পীস-এর মহাসচিব ইফমা হুসেইন, পরিবেশসম্মত বাসযোগ্য ঢাকা বাস্তবায়ন পরিষদের সদস্য সচিব হাজী মোহাম্মদ শহীদ, নিরাপদ নৌপথ বাস্তবায়ন আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক মোঃ শহীদুল ইসলাম এবং মিডিয়া ফোরাম ফর হিউম্যান রাইট্স এ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ডেভেলপমেন্টের (মেড) পরিচালক শফিকুল ইসলাম।
×