ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

তাহমিন হক ববি

উত্তর জনপদে দিন বদল

প্রকাশিত: ০৫:৩৮, ১ নভেম্বর ২০১৫

উত্তর জনপদে দিন বদল

উত্তরের মঙ্গা অতীত। ফসলের বহুমুখীকরণ দিন বদলে দিয়েছে। এক সময় মঙ্গা নামক এক দুঃসহ কাল কাটাতেন কৃষকরা। ফসল নেই, কাজ নেই, খাবার নেই। এত ‘নেই’ এর সেই মঙ্গাকে তাড়িয়ে দিয়েছে হাইব্রিড ধান, আলু ও সবজি চাষ। আগাম ও স্বল্পমেয়াদী জাতের আমন ধান কর্তনের সঙ্গে সঙ্গেই কৃষকরা আলু রোপণে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। একদিকে চলছে ধানকর্তন, অন্যদিকে চলছে আলু রোপণ। কৃষকরা এখন কোন জমি পতিত ফেলে না রেখে ফসলের বহুমুখীকরণ করছেন। ফলে ফসলের মাঠে কৃষক ও কৃষি শ্রমিকদের বসে থাকার কোন ফুরসতই নেই। হাতে প্রচুর কাজ। কৃষি শ্রমিকদের পোয়াবারো। শ্রমের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। বছরের এই সময়টা যে কৃষি শ্রমিকরা রাজধানী বা অন্যান্য শহরে দিন মজুরি করতে যেতেন, তারা এখন উত্তর জনপদের মাঠেই আছেন। কার্তিকের মরা বা মঙ্গা গত ২০০৫ সাল পর্যন্ত এ দেশে একটি পরিচিত শব্দ ছিল। বিশেষ করে বাংলাদেশের উত্তরে জেলায় আশ্বিনের শুরুতে ধান-বোনার কাজ শেষ হয়ে গেলে গরিব, ক্ষেতে খামারে কাজ করা লোকের হাতে কোন কাজ থাকত না বললেই চলে। অপরদিকে দ্রব্যমূল্যও এই সময়ে বেড়ে যেত। চারদিকে ছড়িয়ে পড়ত হাহাকার। না খেয়ে ঝরে পড়ত অনেক প্রাণ। সেই মরা কার্তিকের দৃশ্য আজ আর নেই। নতুন ধানের জাত, আলু চাষসহ বিভিন্ন ফসলের বহুমুখীকরণে সেই মরা কার্তিক তথা মঙ্গা আছে কেবল ডিকশনারীতে। নীলফামারী, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, রংপুর সদর, গাইবান্ধায় আগাম জাতের হাইব্রিট ধানের চাষ এসব এলাকার তীব্র অভাব দূর করেছে। ধান কর্তনের পর আলুর চাষাবাদ উত্তরের কৃষকদের মাঝে ছড়িয়ে দিয়েছে আশা। সেই সঙ্গে রবি শস্য চাষেরও উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। তবে আলু উৎপাদনে কাঙ্খিত সাফল্যই মূলত উত্তরের কৃষকদের মুখে হাসি ফুটিয়েছে। রংপুর কৃষি আঞ্চলিক অফিসের তথ্যমতে, চলতি বছরে এখনও আলু উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়নি। তবে গত বছরের লক্ষ্যমাত্রাকে সামনে নিয়ে অচিরেই আলু উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ঘোষণা করা হবে। সূত্র মতে, গত বছর রংপুর বিভাগের আটটি জেলায় ১ লাখ ৫৪ হাজার ৯৪৮ হেক্টর জমিতে আলু আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। এর মধ্যে রংপুর জেলায় ৫০ হাজার ২১৮ হেক্টর, কুড়িগ্রামে ৫ হাজার ৫৪২ হেক্টর, লালমনিরহাটে ৪ হাজার ৭৫৬ হেক্টর, গাইবান্ধায় ৯ হাজার ৮৯ হেক্টর, নীলফামারীতে ১৮ হাজার ৯৯৪ হেক্টর, দিনাজপুরে ৩৫ হাজার ৪৭৭ হেক্টর, ঠাকুরগাঁয়ে ২২ হাজার ১৮৬ হেক্টর, পঞ্চগড়ে ৮ হাজার ৬৮৬ হেক্টর জমিতে আলু রোপণ করা হয়। নীলফামারী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মহসীন রেজা বলেন, সবচেয়ে বেশি আগাম জাতের আলু চাষ হয় নীলফামারী, রংপুর ও লালমনিরহাট জেলায়। উত্তর জনপদে গতবারের মতো এবারও আলুর খুব ভাল ফলন হবে, এমন বুকভরা আশা নিয়ে মাটির বুকে আলুর বীজ বুনছেন কৃষক। সেই বীজে মিশে আছে সোনালি দিনের স্বপ্ন। পুরো উত্তরজুড়েই এখন আলু চাষ নিয়ে প্রচ- ব্যস্ততা। কৃষি শ্রমিকরা মহাখুশি। বাড়ি ফিরে সন্তানের ক্ষুধার্ত চোখ দেখতে হবে না, এই ভাবনাতেই তাদের কাজের গতি যেন বেড়ে গেছে। নীলফামারীর জেলা সদরের চাপড়া গ্রামের কৃষক রমজান আলী বলেন, তিনি এবার সাত বিঘা জমিতে ব্রি-৩৩ ধান আবাদ করেছিলেন। ধান বিক্রি করেই আলু আবাদের খরচ বহন করছেন। বেড়াডাঙ্গার কৃষক কামরুজ্জামান ১৭ বিঘা জমিতে আলু আবাদ করছেন। কিশোরীগঞ্জ উপজেলার পুটিমারী, কালিকাপুর ও পানিয়ালপুকুর গ্রামে গিয়ে দেখা যায় অপূর্ব সুন্দর এক দৃশ্য। যতদূর চোখ যায় শুধুই আলুর ক্ষেত। সর্বত্রই চলছে আলু আবাদ। ফলন নিয়ে খুব আশাবাদী পানিয়ালপুকুর এলাকার আলুচাষী মোছারুল। তিনি গতবার পাঁচ বিঘা জমিতে আলু আবাদ করলেও এবার দ্বিগুণ করেছেন। মোছারুলের মতই উত্তরের বেশির ভাগ কৃষক এখন ধানের পর আলু চাষ করছেন। এভাবেই তারা যুদ্ধ করছেন অভাবের বিরুদ্ধে। ইনস্টিটিউশন অব মাইক্রোফিন্যান্স (আইএনএম) ও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হাউসহোল্ড সার্ভের তথ্য অনুযায়ী, উত্তর জনপদে ২০০৭-০৮ সালে ৮০ শতাংশ পরিবারে খাদ্য দরিদ্র থাকলেও এখন তা নেমে এসেছে ৫ শতাংশে। এছাড়া অনাহারে (অকেশনাল স্টারভেশন) থাকা পরিবারের সংখ্যা ৪৫ থেকে প্রায় ৩ শতাংশে নেমে এসেছে। এই সাফল্যের মূল কারণ পতিত জমি দ্রুত হারে চাষযোগ্য করে তোলা এবং ফসলের বহুমুখীকরণ। এখন বসতবাড়ি থেকে শুরু করে মাঠ, সব জমিই আবাদের আওতায় আসছে। এসব জমিতে চাষ করা হচ্ছে হাইব্রিড ধান বি আর- ৩৩, আলু ও সবজি। তাছাড়া স্বল্পমেয়াদী জাত উন্নয়ন, বীজ ও পদ্ধতি সম্প্রসারণ করা, উন্নত প্রযুক্তির সম্প্রসারণ, বিদ্যমান প্রযুক্তির আধুনিকায়ন, বাজার ব্যবস্থার উন্নয়নের ফলেই কৃষিতে সফলতা আসছে। ফলে উত্তরের জনপদের কৃষক আর কৃষি শ্রমিকের মুখে এখন হাসি।
×