ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

ব্ল্যাক আউট তদন্ত কমিটির বেশিরভাগ সুপারিশই বাস্তবায়ন হয়নি

প্রকাশিত: ০৫:২৭, ১ নভেম্বর ২০১৫

ব্ল্যাক আউট তদন্ত কমিটির বেশিরভাগ সুপারিশই বাস্তবায়ন হয়নি

রশিদ মামুন ॥ এক বছরেও ব্ল্যাক আউট তদন্ত কমিটির বেশিরভাগ সুপারিশ বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেই। আজ পহেলা নবেম্বর গত বছর এই দিন ব্ল্যাক আউটের ঘটনা ঘটে। বেলা ১১টা ২৭ মিনিট ৪১ সেকেন্ডে সারাদেশ বিদ্যুত বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। সারাদেশ টানা ১২ ঘণ্টা বিদ্যুত বিচ্ছিন্ন ছিল। সম্পূর্ণ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে সময় লেগে যায় প্রায় ২৪ ঘণ্টা। অভিযোগ রয়েছে অতীতে ব্ল্যাক আউটের পর তদন্ত কমিটি যে সুপারিশ করেছিল তারও আংশিক বাস্তবায়ন করে বাকিটা ফেলে রাখায় এমন দুর্ঘটনার আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। তদন্ত কমিটি বলছে দেশের কোথাও লোভোল্টেজের কারণে গত বছর ব্ল্যাক আউটের ঘটনা ঘটে। একইভাবে এর আগে ২০০৭ সালের নবেম্বর এবং ডিসেম্বরে দুদফা ব্ল্যাক আউটের ঘটনা ঘটে। ব্ল্যাক আউটের পর তদন্ত কমিটি গঠন করে কারণ উদ্ধার এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের দুর্যোগ মোকাবিলা করতে করণীয় নির্ধারণের চেষ্টা করা হয়। তিনবার ব্ল্যাক আউটের পরই তদন্ত কমিটির প্রতিনিধিরা জানান, জাতীয় গ্রিডের অবস্থা দুর্বল। সঞ্চালন ক্ষমতার বেশি বিদ্যুত প্রবাহের চেষ্টা করা হয়। এতে গ্রিড বিপর্যয়ের আশঙ্কা তৈরি হয়। বিদ্যুত বিভাগের তরফ থেকে বলা হচ্ছে, ভবিষ্যত বিদ্যুত সঞ্চালন ব্যবস্থায় স্মার্ট গ্রিড করা হবে। জাতীয় গ্রিডকে কয়েকভাগে বিভক্ত করে আঞ্চলিক গ্রিড নির্মাণ করা হবে। এতে নির্দিষ্ট কোন এলাকায় সমস্যা হলে ওই এলাকার মধ্যে সমস্যা থাকবে অন্য এলাকায় তা ছড়াবে না। তবে এসব বিষয়ে তেমন কোন অগ্রগতি এখনও পর্যন্ত হয়নি। পরামর্শক নিয়োগ এবং পরিকল্পনা পর্যায় অতিক্রম করতে পারেনি তদন্ত কমিটির এসব সুপারিশ। এক বছরে ব্ল্যাক আউট তদন্ত কমিটির সুপারিশ কতটা বাস্তবায়ন করেছে বিভিন্ন সংস্থা তা জানতে চাইলে কমিটির প্রধান বিদ্যুত বিভাগের অতিরিক্ত সচিব ড. কায়কাউস আহমদ শনিবার বিকেলে জনকণ্ঠকে বলেন, এভাবে এক কথায় বলা যাবে না কতটা সুপারিশ বাস্তবায়ন হয়েছে। বিষয়টি পর্যালোচনা করে দেখতে হবে। তবে বেশকিছু সুপারিশ মানা হয়েছে বলে দাবি করেন তিনি। চূড়ান্ত তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, ভেড়ামারা হাইভোল্টেজ ট্রান্সফরমার ট্রিপ করে ১ নবেম্বর বেলা ১১টা ২৭ মিনিট ২৭ সেকেন্ডে। এর ১৪ সেকেন্ড পর দেশে ব্ল্যাক আউটের ঘটনা ঘটে। তদন্ত কমিটি মনে করে দেশের কোথাও লোভোল্টেজের ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনা ঘটেছে মাত্র ৫ মিলি সেকেন্ডে। যাতে ভেড়ামারা প্রথম ট্রিপ করে। কিন্তু কোথায় আগে ট্রিপ করেছে তা খুঁজে বের করতে পারেনি তদন্ত কমিটি। তদন্ত চলার সময় কমিটির সদস্য সচিব পাওয়ারসেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন জনকণ্ঠকে বলেন, মাঠ পর্যায়ে গেলে কেউই বলতে চায়নি কার বিদ্যুত কেন্দ্র আগে ট্রিপ করায় এ ঘটনা ঘটেছে। বিদ্যুত কেন্দ্রগুলোর ডিজিটাল ডাটা রেকর্ডার না থাকায় কাউকে নির্দিষ্ট করে চিহ্নিত করাও সম্ভব হয়নি। তদন্ত কমিটি তাদের প্রতিবেদনে বলে, ভারত বাংলাদেশে হাইভোল্টেজ সাবস্টেশনে সর্বাধুনিক সয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে। ওই সাবস্টেশনে নির্ধারণ করা রয়েছে ২০৭ কেভির নিচে ২৪০ কেভির উপরে ভোল্টেজ লেভেলে গেলেই সাবস্টেশন ট্রিপ করবে। কিন্তু আমাদের দেশের সামগ্রিক বিতরণ ব্যবস্থা এতটা স্পর্শকাতর নয়। তদন্ত প্রতিবেদনে দেশের সকল বিতরণ ব্যবস্থার সঙ্গে এর সমন্বয়ের জন্য সাবস্টেশনটিকে কিছুটা সহনশীল করার সুপারিশ করা হয়। দেখা যায় এনএলডিসি ২০০৯ সালে কার্যক্রম শুরু করে। কিন্তু এর ডিজাইন ছিল ২০০৬ সালের। তখন বিদ্যুত উৎপাদন ছিল তিন হাজার ৫০০ মেগাওয়াট। এই দীর্ঘ সময়ে দেশে বিদ্যুত উৎপাদন দ্বিগুণের বেশি হয়েছে। দেশের বিদ্যুত কেন্দ্রর স্থাপিত ক্ষমতা এখন ১১ হাজার ৮৭৭ মেগাওয়াট। আর প্রকৃত উৎপাদন ক্ষমতা ১১ হাজার ২৮২ মেগাওয়াট। প্রতিদিন সন্ধ্যায় এখন সর্বোচ্চ চাহিদার সময় উৎপাদন হয় সাত হাজার ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত। দেশে বিদ্যুত ব্যবহারকারীর সংখ্যাও বেড়ে গেছে। কিন্তু এনএলডিসির সফটওয়্যার আধুনিকায়ন করা হয়নি। পিজিসিবির নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কর্মকর্তা জানান, ন্যাশনাল লোড ডেসপাস সেন্টারের (এনএলডিসি) আধুনিকায়নে তেমন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। শুধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মনিটর করার জন্য সেখানে গুটিকয়েক সিসি টিভি বসানো হয়েছে। তদন্ত কমিটির সুপারিশে আন্ডার ফ্রিকোয়েন্সি রিলের উন্নয়ন করা, জেনারেশন ইউনিট এবং ফিডারের ফ্রিকোয়েন্সি রিলের মধ্যে সমন্বয় সাধন করা, ইতোপূর্বে গ্রিড বিপর্যয়ের পর করা সুপারিশ বাস্তবায়ন, এনএলডিসির সফটওয়্যার প্রতি পাঁচ বছর পর পর আধুনিকায়ন করা, সফটওয়্যারে প্রতিটি বিদ্যুত কেন্দ্রকে এক মিলি সেকেন্ডে নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা নির্ধারণ করা, মানবসম্পদ উন্নয়ন, এনএলডিসিতে সিসি ক্যামেরার ব্যবস্থা করা, জিপিএস টাইমারের ব্যবস্থা করা, প্রত্যেকটি বিদ্যুত কেন্দ্রে ডিজিটাল রেকর্ডিং প্রথা চালু করা, প্রত্যেকটি বিদ্যুত কেন্দ্রে খুচরা যন্ত্রাংশ প্রস্তুত রাখা, জোনভিত্তিক বিদ্যুত কেন্দ্রের ব্ল্যাক স্টার্ট (ব্ল্যাক আউটের পর পুনরায় চালু করা) এর ব্যবস্থা রাখা, বিদ্যুত কেন্দ্রগুলোতে অভ্যন্তরীন ব্যবস্থা চালু রাখতে নিজস্ব জেনারেটর রাখার ব্যবস্থার কথা বলা হয়। জানতে চাইলে পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ পিজিসিবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসুম আল বেরুনী জনকণ্ঠকে বলেন, আমরা স্বল্প মেয়াদি সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করেছি। এজন্য আন্ডার ফ্রিকোয়েন্সি রিলে আগে গ্রিডের ৩০টি স্থানে ছিল এখন তা ৭০টি স্থানে বসানো হয়েছে। নতুন ধরনের রিলে বসানো হয়েছে। যাতে প্রথমটা কোন কারণে কাজ না করলেও দ্বিতীয়টা কাজ করে। মধ্য মেয়াদি পরিকল্পনার মধ্যে আইপিপি বিদ্যুত কেন্দ্রগুলোর রিলে সেটিং সহনশীল করা হয়েছে। এছাড়া কিছু কর্মীকে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। আমরা আশা করছি ভবিষ্যতে ব্ল্যাক আউটের ঘটনা ঘটবে না।
×