ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

তাপস মজুমদার

আত্মহত্যার অর্থনীতি

প্রকাশিত: ০৩:৩৯, ১ নভেম্বর ২০১৫

আত্মহত্যার অর্থনীতি

আত্মহত্যার অর্থনীতির ওপর রীতিমতো গবেষণা করেছেন ২০১৫ সালে অর্থশাস্ত্রে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অর্থনীতিবিদ এ্যাঙ্গাস ডিটন। প্রথামাফিক বিস্তারিত তথ্য-পরিসংখ্যানসহ গ্রাফ-টাফ উপস্থাপন করে দেখিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রে ২০০৮-১৩ সালে নারী- পুরুষের আত্মহত্যার চিত্র। ঢাকায় বসে আমরা এই খবর পেয়েছি বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেনের সৌজন্যে। বোধকরি বিশ্ব ও বিশ্ববহির্ভূত প্রায় সব বিষয় নিয়েই গবেষণা এবং বিচার-বিশ্লেষণসহ করা যায় সেগুলোর চূড়ান্ত ফলাফল ও অর্থনৈতিক সংশ্লেষণ, লাভ-ক্ষতি, ঘাত-প্রতিঘাত ইত্যাদি। সে প্রেক্ষাপটে আত্মহত্যাই বা বাদ থাকবে কেন? নোবেল পুরস্কার তো আর যার তার ভাগ্যে জোটে না। এবারের নোবেলজয়ী এ্যাঙ্গাস ডিটন নিশ্চয়ই সেই বিরল প্রতিভাবানদের একজন। স্কটিশ বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ-আমেরিকান অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক এ্যাঙ্গাস ডিটনের মূল কাজ অবশ্য দারিদ্র্য নিয়ে। নোবেল কমিটির বিবৃতিতে জানা যায়, ‘অর্থনৈতিক নীতিমালার মাধ্যমে অধিকতর কল্যাণ বয়ে আনতে ও দারিদ্র্য দূর করতে হলে ব্যক্তি পর্যায়ে ভোগের প্রবণতাসমূহ অনুধাবন করতে হবে। ... এ ক্ষেত্রে অন্য যে কারও চেয়ে এ্যাঙ্গান্স ডিটনই সবচেয়ে বেশি জোর দিয়েছেন। ডিটনের কাজ তথা গবেষণা ব্যষ্টিক, সামষ্টিক ও উন্নয়ন অর্থনীতিতে রূপান্তরের ক্ষেত্রে খুব সহায়ক হবে।’ যুক্তরাষ্ট্রের আরেকজন অর্থনীতিবিদ টাইলর কোয়েন এ্যাঙ্গাস ডিটনের কাজকে অসাধারণ ও চমৎকার বলে মন্তব্য করে বলেন, ‘তিনি এমন এক অর্থনীতিবিদ, যিনি গরিব মানুষেরা নিজেদের জীবনমান ও আর্থিক অবস্থার উন্নয়নে যে চেষ্টা করে, তা খুব ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন।’ এ্যাঙ্গান্স ডিটন বর্তমানে প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করছেন। উল্লেখ্য, শেষ জীবনে ভুবনবিখ্যাত বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনও জড়িত ছিলেন প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির সঙ্গে। যা হোক, এ্যাঙ্গাস ডিটনের মৌলিক ও মূল কাজ নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যা করবেন অর্থনীতিবিদ ও বোদ্ধারা। সামান্য আদার ব্যাপারী হিসেবে আমরা ফিরে যাই আত্মহত্যার কথকতায়। তার আগে বিদেশী সাহায্য প্রসঙ্গে ডিটনের একটি মন্তব্য তুলে দিই পাঠকের জন্য। ২০১৩ সালে প্রকাশিত এ্যাঙ্গাস ডিটনের সর্বশেষ বই ‘দ্য গ্রেট এসকেপ’ বা মহামুক্তিতে তিনি বলেন, ‘পশ্চিমা সরকারগুলোর দেয়া সাহায্য উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য ভাল করার চেয়ে বেশি দুর্নীতিই বয়ে আনে। ... এ ধরনের বিদেশী সাহায্য গরিব মানুষের কাছে খুবই কম পরিমাণে ও কদাচিৎ পৌঁছায় এবং তা দেশে দেশে সরকারগুলোকে করে তোলে দুর্নীতিগ্রস্ত।’ এ বিষয়ে বাংলাদেশের যথেষ্ট তিক্ত অভিজ্ঞতা রয়েছে এবং আগ্রহী ও কৌতূহলী পাঠকের বহুকথিত বিশ্বব্যাংক ও পদ্মা সেতুর কথা এখানে মনে পড়তে পারে। সর্বাধিক কৌতুকের বিষয় হলো, তথাকথিত দুর্নীতির অভিযোগ তুলে যে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু থেকে ঋণ প্রত্যাহার করে নিয়েছে, সেই তারাই আবার যুক্ত হতে চাইছে সুবিশাল এই কর্মযজ্ঞে যে কোনভাবে। যে কোন দেশের জন্য বৈদেশিক সাহায্য ও ঋণ-নির্ভরতা যত কমানো যায়, ততই মঙ্গল। একেবারে না নিয়ে চলতে পারলে আরও ভাল। আরও একটি সমস্যা, এনজিও বা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার প্রাবল্য ও আধিপত্য। এটিও ধীরে ধীরে কমানোর চেষ্টা করা উচিত। মোট কথা, এ্যাঙ্গাস ডিটনের কাজ উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থনীতিতে দারিদ্র্য এবং আয় ও ভোগের সম্পর্ক নির্ণয়ের পথ দেখিয়েছে। আত্মহত্যার অর্থনীতিটা ঠিক কেমন? তবে তারও আগে প্রশ্ন, মানুষ আত্মহত্যা করে কেন? এক কথায় কিংবা সংক্ষেপে এর উত্তর দেয়া মুশকিল। অথবা, এর সঠিক উত্তর কোনদিনই জানা যায় না। এ ক্ষেত্রে কবি জীবনানন্দ দাশের বহুল উদ্ধৃত, ‘অর্থ নয়, কীর্তি নয়, সচ্ছলতা নয়... আরও এক বিপন্ন বিস্ময়ের’ কথা বলে সহজেই পার পাওয়া যেতে পারে। নোবেলজয়ী এ্যাঙ্গাস ডিটনের আত্মহত্যার অর্থনৈতিক তত্ত্ব অনুযায়ী, মানুষ তখনই আত্মহননের পথ বেছে নেয় যখন তার কাছে মরে যাওয়াই বেঁচে থাকার চেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য মনে হয়। তবে এখানে একটা কথা আছে, মরার আগেই মরার পথে কেন যেতে হবে সে প্রশ্ন অন্য অনেকের মতো এ্যাঙ্গাস ডিটনকেও অবাক করেছে। আমরা ঠিক জানি না, তিনি জীবনানন্দ দাশ পড়েছেন কিনা! অথবা, তার প্রিয় কবি কে? তাহলে হয়ত তার কৌতূহল কিছুটা হলেও মিটত এবং আরও সমৃদ্ধ হতো গবেষণা। ‘আত্মহত্যা, বয়স ও ভাল থাকা : একটি পর্যবেক্ষণমূলক অনুসন্ধান’ শীর্ষক গবেষণাকর্মে এ্যাঙ্গাস ডিটনের সহযোগী ছিলেন এ্যানি কেস। মানুষের আত্মহত্যা, বয়স ও ভালো থাকার মধ্যকার পারস্পরিক সম্পর্ক, তত্ত্বের চেয়ে পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার ওপর বেশি জোর দেয়া হয়েছে এতে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ২০০৮-১৩ সাল পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য-পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, সেখানে পুরুষের তুলনায় নারীর আত্মহত্যার হার বেশ কম। নারীদের চেয়ে পুরুষেরা প্রায় চার গুণ বেশি আত্মহত্যা করে থাকে। এ ক্ষেত্রে ডিটনের মন্তব্য, সম্ভবত নারীরা বেঁচে থাকাটাকে পুরুষদের তুলনায় বেশি সুখের মনে করে। পুরুষ সাধারণত তরুণ ও বৃদ্ধ বয়সে আত্মহত্যা করে। অন্যদিকে নারী বেশি আত্মহত্যা করে থাকে মধ্যবয়সে। এ্যাঙ্গাস ডিটনের মতে, আত্মহত্যার যৌক্তিক কারণ হলো, কখনও কখনও মানুষ ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ব্যাপক চিন্তা না করেই প্রধানত আবেগতাড়িত হয়ে বেছে নেয় আত্মহত্যার পথ। এ ক্ষেত্রে সে ঘটনার পূর্বাপর বা পরিণতি আদৌ ভাবে না। গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফলে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রে সপ্তাহের সব দিনই সমান হারে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে না। সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে সোমবার। সপ্তাহের পরের দিনগুলোতে পর্যায়ক্রমে কমে আসে। উইক এ্যান্ড বা ছুটির দিনগুলোতে আত্মহত্যার প্রবণতা অনেক কম। ডিটনের মতে, এ সময়ে মানুষ সচরাচর ক্লাব বা পার্টিতে যায়, হাসি-ঠাট্টা-আনন্দ, গল্প-গুজবে মেতে ওঠে, খায়-দায়, ভাল থাকে, ফূর্তি করে। রবিবার থেকে কমতে থাকে সুখের মাত্রা। অতঃপর সপ্তাহান্তে আনন্দ ও সুখভোগের পর সোমবার বেছে নেয় আত্মহননের পথ। এ প্রসঙ্গে পাঠকের অবগতির জন্য আরও একটি তথ্য দিই। মেডিক্যাল গবেষণায় দেখা গেছে, সপ্তাহের অন্যান্য দিনের চেয়ে রোগীরা সোমবারকেই বেশি প্রাধান্য দিয়ে থাকে অস্ত্রোপচার বা শল্যচিকিৎসার জন্য। পরে না হয় এ নিয়ে আলোচনা করা যাবে। এ্যাঙ্গাস ডিটন ও এ্যানি কেস উপসংহারে মন্তব্য করেছেন, বেদনা বা যন্ত্রণা নিবিড়ভাবেই আত্মহত্যার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। যে বা যারা দীর্ঘদিন দুরারোগ্য ব্যাধি কিংবা রোগযন্ত্রণায় ভোগেন, তারাও বেছে নেন আত্মহননের পথ। অনেক দেশে অবশ্য প্রবল রোগ-যন্ত্রণার চূড়ান্ত উপশমে আত্মহত্যাকে স্বীকার করে নেয়া হয় আইনগতভাবে। এর পাশাপাশি সামাজিক কলঙ্ক, দুর্নাম, নীতি-নৈতিকতা, বিবেকের পীড়া, ব্যক্তিগত দুঃখ-দুর্দশা-হতাশা, প্রেমে ব্যর্থতা, দাম্পত্য কলহ, পরকীয়া এমনকি যৌন অক্ষমতা অথবা জন্মগত আইডেনটিটি সমস্যাও আত্মহত্যার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কারণ হতে পারে। এ্যাঙ্গাস ডিটনের অপ্রথাগত গবেষণাটি নিঃসন্দেহে ইন্টারেস্টিং ও কৌতূহলোদ্দীপক। তবে অবশ্যই এর বাইরেও আত্মহত্যা ও স্বেচ্ছামৃত্যুর আরও নানা তাৎপর্য ও গভীরতা রয়েছে। কবি-সাহিত্যিক-সঙ্গীতজ্ঞ-চিত্রশিল্পী-দার্শনিক-বিজ্ঞানী ও সৃজনশীল মানুষ তা বিভিন্ন সময়ে ব্যাখ্যা করেছেন ও করবেন। এরপরও বাস্তবতা হলো, মানুষ কেন আত্মহত্যা করে, তার যথাযথ ও সঠিক কারণ সম্পূর্ণ জানা যাবে না কোনদিনই। তীব্র আবেগ ও ঝোঁকের বশবর্তী হয়ে যে পুরুষ বা নারীটি আত্মহত্যা করেন, কেবল তিনিই জানেন এর সঠিক ব্যাখ্যা ও উত্তর। তিনি তো মরেই বাঁচলেন। তবে এর ফলে যে একটি পরিবার তথা ছেলেমেয়ে ও অন্যরা প্রবল একটি অর্থনৈতিক অভিঘাতের সম্মুখীন হয় এবং এর অনিবার্য সামাজিক দায় ও লোকলজ্জাÑতার মূল্যও তো কম নয়। আত্মহত্যা পরবর্তী পরিবার বিশেষ করে ছোট শিশুদের মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা এবং অভিঘাতটিও সুদূরপ্রসারী ও জটিল। মোটকথা, এগুলো মোটেও উপেক্ষণীয় নয়। কুণ্ঠিতচিত্তে লিখছি, এ প্রসঙ্গে মৎলিখিত একটি গল্পের কথা মনে পড়ছে। ‘স্বেচ্ছামৃত্যু ফেরিঅলার স্বীকারোক্তি’ শীর্ষক গল্পটিতে এক ব্যক্তি আত্মহনন কিংবা স্বেচ্ছামৃত্যুতে আগ্রহী ব্যক্তিদের বিবিধ অমূল্য ও দুর্মূল্য আত্মহত্যার উপকরণ সরবরাহ তথা বিক্রি করে থাকে। প্রায় সব ধর্মেই আত্মহত্যা মহাপাপ এবং তারা রৌরব নরক অথবা হাবিয়া দোজখে নিপতিত হবে বলা হলেও ‘স্বেচ্ছামৃত্যু’ বা ‘ইউথ্যানাশিয়া’ (ঊঁঃযধহধংরধ) নিয়ে বোধকরি রাষ্ট্রের একটু লিবারেল দৃষ্টিভঙ্গি থাকা বাঞ্ছনীয়। এ্যাঙ্গাস ডিটনও বিষয়টি উল্লেখ করেছেন। যুক্তরাজ্যের প্রভাবশালী সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্টের ইন্টেলিজেন্ট ইউনিট প্রকাশিত ‘কোয়ালিটি অব ডেথ ইনডেক্স’ অনুযায়ী, মৃত্যুর আগে প্রশমন বা প্যালিয়েটিভ কেয়ারে বাংলাদেশের অবস্থান বেশ শোচনীয়Ñ বিশ্বের ৮০টি দেশের মধ্যে সর্বনিম্ন মানের দিক থেকে ৭৯তম অবস্থানে। সে ক্ষেত্রে কঠিন শারীরিক সমস্যা, রোগ-ব্যাধিতে আক্রান্ত এবং নিশ্চিত মৃত্যুর সম্মুখীন মানুষের স্বেচ্ছামৃত্যুর বিষয়টি অবশ্যই বিবেচনার দাবি রাখে। এর পাশাপাশি দুরারোগ্য ব্যাধির পেছনে বিপুল ব্যয়ের বিষয়টি মোটেও উপেক্ষণীয় নয়। এটা তো মানতে হবে যে, মৃত্যুর আগে মানুষ ভোগান্তি ও যন্ত্রণার হাত থেকে বাঁচতে চায় যথাসম্ভব। তবে পাঠক, লেখাটি শেষ পর্যন্ত গুরুগম্ভীর ও বিষণœ করা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। এ্যাঙ্গাস ডিটনের একটি মন্তব্য দিয়েই বরং শেষ করি না কেন! দীর্ঘ পর্যবেক্ষণে তিনি লক্ষ্য করেছেন যে, বিয়ে করলে মানুষের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা কমে আসে। অতঃপর সকৌতুকে মন্তব্য করেছেন ডিটন, বিয়েটাই তো একটা আত্মহত্যা। সুতরাং দ্বিতীয়বার আত্মহত্যা করার দরকার নেই। লেখক : সাংবাদিক, সাহিত্যিক
×