ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

আবুল মাল আবদুল মুহিত

ছেলেবেলা ও ছাত্রজীবন

প্রকাশিত: ০৩:৩৫, ১ নভেম্বর ২০১৫

ছেলেবেলা ও ছাত্রজীবন

(৩১ অক্টোবরের পর) মুকুলমেলা তখনই আমার বেশি আদরের প্রতিষ্ঠান হয়ে দাঁড়াল। ১৯৪৭-এর পর আমাদের সংঘের মূল খেলার মাঠ হাসান রাজার মাঠে একটি কারখানা গড়ে উঠল। হাসান রাজার মাঠটি হয়ে গেল আসলাম কোম্পানির কারখানা। আমাদের বাড়ির পেছনের লাল মাটির মাঠই হয়ে উঠল আমাদের পাড়ার খেলার মাঠ। এখানেই কৌশিক দার কুচকাওয়াজ হতো আর আমাদের সব রকমের খেলা চলত। কয়েক বছর পর ১৯৫৩ সালের শেষ দিকে আমার আম্মা আমাদের লাল মাটিতে একটি বন সৃষ্টি করে ফেললেন এবং চৌহদ্দিতে দেয়াল তুলে খেলার মাঠের উচ্ছেদ হলো। সেখানটা আমার উদ্যোগে এবং আম্মার পরিচর্যায় একটি আনারসের বাগান বনে গেল। পাড়া থেকে খেলার মাঠ প্রায় সব কটিই বিদায় হলো। ধোপা পাড়ায় একটি ছোট মাঠ ছিল। সেটা এখন হয়েছে মা কম্যুনিটি কেন্দ্র। নাইওরপুলে ছিল উত্তম ফুটবলের মাঠ। সেটিও সেচ বিভাগের জারিজুরিতে খেলার মাঠ থেকে রেস্ট হাউসে পরিবর্তিত হলো, সম্ভবত পঞ্চাশের দশকের শেষ দিকে। সিলেট শহরে এভাবে যেমন খোলা মাঠ সব বিদায় হতে থাকল, ঠিক তেমনি সে সব জায়গায় যেসব স্থাপনা হলো সেগুলো সবই হয়ে গেল দোকানপাট অথবা ছোট শপিং মল। এই পরিবর্তন সবচেয়ে প্রকট হলো চৌহাট্টা রিকাবিবাজার এলাকায়। বর্তমানে যেখানে শহীদ মিনার আছে সেখান থেকে শুরু করে রিকাবিবাজার পর্যন্ত এলাকা ছিল খেলার মাঠ। মাঝখানে ছিল শুধু সিভিল হাসপাতালের একটি ছোট স্থাপনা, রাস্তার অন্য পাশে আলিয়া মাদ্রাসার পরেই ছিল অনেক বড় মাঠ। এর পরে ছিল দরগা মহল্লা এবং তারপর পুলিশ লাইন পর্যন্ত মাঠ। দেশ বিভাগের কিছু আগে সেই মাঠে কতগুলো ব্যারাকের মতো স্থাপনা হলো। বলা হলো এখানে মেডিক্যাল কলেজ হবে। এখানে এখন ওসমানি মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষকরা বসবাস করেন। সম্ভবত ১৯৪৮ সালে এখানেই মেডিক্যাল স্কুল স্থাপিত হয় যা, ১৯৫৬ সালে কলেজে রূপান্তরিত হয়। বাগবাড়ীতে কলেজের বর্তমান স্থাপনা ১৯৭৪ সালে নির্মিত হয়। ষষ্ঠ অধ্যায় কৈশোর থেকে উত্তরণ ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের সিদ্ধান্তের পর আমি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় সক্রিয় ভূমিকা পালনে অবতীর্ণ হই। সেই উপলক্ষেই হয় আমার জীবনে জনসভায় প্রথম বক্তৃতা। সিলেটের গণভোটের তারিখ নির্ধারিত হয় ৬ এবং ৭ জুলাই। আগেই বলেছি যে, ৮ জুনে সিলেট মুসলিম লীগ গণভোট বোর্ড প্রতিষ্ঠা লাভ করে এবং সেই বোর্ডের সাধারণ সম্পাদক হন আমার আব্বা। প্রতিটি মহকুমায় অর্থাৎ করিমগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জেও তেমনি বোর্ড গঠিত হয় এবং এদের সমন্বয় ও দিক-নির্দেশনার দায়িত্ব পড়ে সিলেট বোর্ডের ওপর। স্বাভাবিকভাবেই এই গণভোট উপলক্ষে যে প্রচার-প্রচারণা শুরু হলো তাতে আমিও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করি। সিলেট শহরে লালদীঘির পাড়ে গণভোট বোর্ডের দফতরটি স্থাপিত হয়। সেখানে আমি প্রায়ই আমার আব্বার সারাদিনের সঙ্গী থাকি। অন্যদিকে আমাদের ধোপাদীঘির পাড়ের বাড়িতে স্থাপিত হয় ভোটার লিস্টের অতিরিক্ত কপি বানানো এবং ভোটের জন্য ভোটার স্লিপ তৈরি করা। এই কাজের দায়িত্ব নেন আমার বড় ভাই মুহসি। মুসলিম লীগের প্রচারণা কার্যক্রমের প্রধান বিষয়টি ছিল জমিয়তে ওলামা-এ-হিন্দের অখ- ভারত দাবিটিকে নাকচ করা। নির্বাচনী কৌশল নির্মাতারা ঠিক করলেন যে, এই গণভোটে মুসলমানদের ঐক্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মওলানা হোসেন আহমদ মাদানির শিষ্যদের হেদায়েত দেবার জন্য অশীতিপর বৃদ্ধ মওলানা সহুল উসমানীকে সিলেটে নিয়ে আসা হোক। মওলানা সহুল উসমানী সিলেট আলিয়া মাদ্রাসার অধ্যাপক ও অধ্যক্ষ ছিলেন এবং অবসরান্তে তিনি তার দেশ বিহারে চলে যান। তিনি সিলেটে মাঝে মাঝে তার শিষ্যদের আহ্বানে রমজান মাসে এসে কিছুদিন থাকতেন এবং ধর্মীয় নেতা হিসেবে তার অনুসারীর সংখ্যা ছিল বৃহৎ। তাকে গণভোটের সময় সিলেটে আহ্বান করা হয় এবং তিনি সে আহ্বানে সাড়া দেন। সম্ভবত এ কারণেই মওলানা মাদানি সেই সময়ে সিলেটে এলেন না। মওলানা উসমানীর নিরাপত্তা ছিল একটি নাজুক বিষয়। কারণ তাকে হত্যা করা হতে পারে বলে ভয় ছিল। তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সব রকম ব্যবস্থা নেয়া হয় এবং আমি হয়ে যাই তার নিরাপত্তা নিশ্চয়তার পরিচয় চিহ্ন। আমার আব্বার দায়িত্ব ছিল মওলানা সাহেবের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা; তাই তার নিরাপত্তা যে নিশ্চিত করা হয়েছে তার প্রমাণ হিসেবে আমি হই তার সফরসঙ্গী। আশি বছরের বৃদ্ধ মওলানা চরকির মতো নানা গ্রামগঞ্জে যেতেন পাকিস্তানের পক্ষে প্রচারণায়। তিনি ফতোয়া দেন যে, পাকিস্তানের পক্ষে ভোট দেয়া প্রতিটি মুসলমানের জন্য ফরজ, কারণ পাকিস্তান ছিল বায়তুল আমান আর ভারত ছিল বায়তুল র্হব্্। আমার মামাবাড়ি সৈয়দপুর ছিল মওলানা মাদানির প্রভাব বলয়ে। তাই সেখানে ধারণা করা হয় যে, পাকিস্তানের পক্ষে বেশি ভোট পড়বে না। তাই মওলানা উসমানীকে সেখানে যেতে হলো। একদিন সকালে আমরা স্থলপথ ও জলপথ দিয়ে সৈয়দপুরে গেলাম। জোহরের পর জনসভা হলো এবং তারপরই আমরা ফেরত যাত্রা শুরু করলাম। আমি মওলানা সাহেবের বক্তৃতার অনুবাদ করলাম এবং পরে দাবি উঠল যে, আমাকে বক্তৃতা করতে হবে। আমার বয়স তখন মাত্র তেরো বছর। আমাদের আগে-পিছে যুবকরা দু’টি বাইচের নৌকা পূর্ণ করে নদীপথে আমাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করল। এই যুবক দলে একজন নেতা ছিলেন জগন্নাথপুরের তেঘরি গ্রামের ছাত্র, পরবর্তীকালে বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ আখলাকুর রহমান। স্থলপথে অবশ্য মওলানা সাহেবের জন্য নির্দিষ্ট গাড়ি ও দেহরক্ষী বাহিনী ছিল। গণভোটের সময় তাই আমাকে শুধু গতানুগতিক নির্বাচনী এজেন্টের কাজই করতে হয়নি বরং আমি একজন উল্লেখযোগ্য প্রচারকের ভূমিকা গ্রহণ করি। এখানে বলে রাখা ভাল যে, মওলানা সহুল উসমানী পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর আর নিজের বাড়িতে প্রত্যাবর্তন করলেন না। তার পরিবার-পরিজনকে সিলেটেই বসবাসের ব্যবস্থা করে দেন সেখানকার নেতৃবৃন্দ। ইউসুফ নামক এক মুসলিম লীগ ব্যবসায়ী মওলানা সাহেবের পরিবারের জন্য আম্বরখানা এলাকায় একটি বাড়ি নির্মাণ করে দেন। তার উত্তরাধিকারীরা সিলেটের সমাজেই একীভূত হয়ে যান। ৬ এবং ৭ জুলাই সারা সিলেটে গণভোট অনুষ্ঠিত হলো। তখন প্রাদেশিক গবর্নর ছিলেন কংগ্রেস ঘেঁষা স্যার আকবর হায়দরি। মোটামুটিভাবে গণভোট শান্তিপূর্ণভাবেই অনুষ্ঠিত হয়। কিছু এলাকায় সাময়িক গোলযোগ সৃষ্টি হলেও তা সহজেই নিয়ন্ত্রণে আসে। গণভোটের সময় জেলা প্রশাসক ছিলেন মি. ডামব্রেক এবং ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ ছিলেন মি. রিড। সিলেট শহরে ৬ তারিখে বেশ গোলমাল বাধে মহিলা ভোট কেন্দ্র সরকারী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে। সেখানে কংগ্রেস কর্মীরা অশিক্ষিত মুসলমান মেয়েদের ভোট দিতে নানা রকম বাধা সৃষ্টি করে। তার প্রতিবাদ করতে গিয়ে মুসলিম মহিলা লীগের নেতৃবৃন্দ বেগম জোবেদা রহিম, সৈয়দ শাহার বানু চৌধুরী (আমার আম্মা), সৈয়দ লুৎফা চৌধুরী, জেবুন্নেছা খানম প্রমুখ কংগ্রেস কর্মীদের দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে যান এবং তারা সেখানে মারধরের আশঙ্কা করেন। গণভোটে কাজ করার জন্য ক’জন মহিলা কর্মীও কলকাতা থেকে আসেন। তাদের মধ্যে সরকারী কর্মকর্তা, সম্ভবত কলকাতা সচিবালয়ের উপ-সচিব আবদুর রশিদের স্ত্রী বেগম জেরিনা রশিদ ছিলেন উল্লেখযোগ্য। তিনি খুব চটপটে এবং আত্মবিশ্বাসী ছিলেন। তাকে হিন্দু মহিলারা গোলমালের সময় কোণঠাসা করে ফেলেন। তবে তাকে উদ্ধারের জন্য মুসলমান মহিলারা দলবেঁধে যে চাপ সৃষ্টি করেন তাতে হিন্দুদের অনেক ভদ্রমহিলা ভয়ে পালিয়ে যান। কর্মজীবনে বেগম জেরিনা রশিদের একটি প্রিয় পরিবার ছিলাম আমরা স্বামী-স্ত্রী। রশিদ সাহেব ঢাকা সচিবালয়ে ছিলেন ১৯৬২ সাল থেকে ভৌত যোগাযোগ বিভাগে আমার সচিব এবং ইসলামাবাদে ১৯৬৬ থেকে ১৯৬৯ পর্যন্ত আমার সিনিয়র সহকর্মী। জনাব রশিদ তখন কেন্দ্রীয় সরকারে ছিলেন অতিরিক্ত এবং পূর্ণ সচিব। অবরুদ্ধ মুসলিম মহিলাদের উদ্ধার করে অশিক্ষিত মুসলিম মহিলারা। তাদের মারমুখী আক্রমণের সামনে কংগ্রেস নেতৃবৃন্দের বেষ্টনী ভেঙ্গে যায়। সাময়িকভাবে সেখানে নির্বাচন স্থগিত রাখা হয়। পরদিন অবশ্য সেখানে শান্তিপূর্ণ পরিবেশে নির্বাচন সম্পন্ন হয়। চলবে ...
×