ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

একে মোহাম্মাদ আলী শিকদার

পুলিশের ওপর আক্রমণ কেন এবং কারা করছে

প্রকাশিত: ০৩:৩৪, ১ নভেম্বর ২০১৫

পুলিশের ওপর আক্রমণ কেন এবং কারা করছে

২২ অক্টোবর ২০১৫, বৃহস্পতিবার। স্থান, ঢাকার ব্যস্ততম জায়গা গাবতলীর পর্বত সিনেমা হলের সম্মুখ চত্বর। রাত ৯টা পেরিয়ে ঘড়ির কাঁটা আরও প্রায় ১৫ মিনিট এগিয়ে সোয়া নয়টা ছুঁই ছুঁই করছে। অস্থায়ী পুলিশের তল্লাশি চৌকিতে প্রহরায়রত ঢাকা মহানগরের কয়েকজন পুলিশ সদস্য। দায়িত্ব ও কর্তব্যের সঙ্গে নিষ্ঠা ও আনন্দ থাকলে কোন কষ্টই আর কষ্ট মনে হয় না। খোলা আকাশের নিচে হেমন্তের মৃদু শীতল বাতাসের স্পর্শে তাদের ব্যস্ততম কর্মদিনের ওই সময়টা হয়ত ভালই লাগছিল। এরপর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে যা ঘটে গেল তা হয়ত ঘুণাক্ষরেও তাদের চিন্তা ও কল্পনায় আসেনি। বগুড়া থেকে আগত একটা আন্তঃজেলা বাস থেকে সারি ধরে একের পর এক নামছেন যাত্রীরা। সন্দেহভাজন এক যুবক যাত্রীকে তল্লাশি শুরু করে পুলিশ। ক্ষণিকের মধ্যে ওই যুবক পকেট থেকে ছুরি বের করে উপর্যুপরি আঘাত করতে থাকে তল্লাশিকারী পুলিশ সদস্য এএসআই ইব্রাহিম মোল্লাকে। অন্যরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই দৌড়ে পালিয়ে যায় ওই যাত্রীবেশী সন্ত্রাসী যুবক। অন্য পুলিশ সদস্যরা আটক করে দৌড়ে পালানো যুবকের সঙ্গী মাসুদ রানা ওরফে সুমনকে। হাসপাতালে নিলে কর্তব্যরত ডাক্তার এএসআই ইব্রাহিম মোল্লাকে মৃত ঘোষণা করেন। একমাত্র উপার্জনক্ষম ছেলেকে এমন নৃশংস ও নির্মমভাবে হারিয়ে ইব্রাহিমের মা-বাবা পাগলপ্রায় অবস্থা। অল্প বয়সে বিধবা হলেন আমাদেরই কারও বোন খায়রুন নেছা। ইব্রাহিমের পাঁচ বছরের মেয়ে জান্নাতুল ফেরদৌস ও দেড় বছরের ছেলে পরাগ দুনিয়ার হালচাল বোঝার আগেই পিতৃহারা হলো। এই নির্মমতার ক্রন্দন কি আমরা সবাই অনুধাবন করতে পারছি? এক পুলিশ সদস্য ইব্রাহিম চলে গেছে, তার জায়গায় আরও অগণিত পুলিশ সদস্য আমরা পাব। কিন্তু, দুটি এতিম ছেলে-মেয়ের কি হবে? তারা তো বাবাকে আর কোন দিন ফিরে পাবে না। সন্তানের কাছে বাবার স্থান অন্য কেউ পূরণ করতে পারে না, সে যতই যা করুক না কেন। এই দুই এতিম আগামীতে জীবনের প্রতিটি ঘাতে-প্রতিঘাতে বাবার অভাবে ক্ষতবিক্ষত হবে। এত বড় মর্মঘাতী অমানবিক পাষ- বর্বরতার জন্য আমরা কাকে দায়ী করব? শুধু কি ওই দুইজন শিবিরের সন্ত্রাসীকে, যারা ইব্রাহিমকে সরাসরি হত্যা করেছে? রাষ্ট্র, সরকার, রাজনীতিক, রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ, কেউ কি এই দায় এড়াতে পারে? হয়ত আমরা আশা করতে পারি খুনীর সহযোগী যখন ধরা পড়েছে তখন মূল খুনীও ধরা পড়বে। কোন এককালে হয়ত শাস্তিও হবে। তখন মানুষ আজকের এতিম দুটি বাচ্চার কথা ভুলে যাবে। এটা আমাদের বিচার প্রক্রিয়ার স্বাভাবিক পরিণতি, কখন বিচার শেষ হবে কেউ জানে না। কারণ, আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে। এএসআই ইব্রাহিম মোল্লা তো ব্যক্তিগতভাবে কারও কোন ক্ষতি করেনি। তাকে এভাবে মরতে হলো কেন? লেখার এ পর্যায়ে হত্যাকারীর প্রকৃত পরিচয় একটু জেনে নিই এ পর্যন্ত যতটুকু তথ্য পাওয়া গেছে তার ভিত্তিতে। যে সন্ত্রাসী এএসআই ইব্রাহিমকে হত্যা করেছে তার নাম এনামুল হক কামাল। সে বগুড়া জেলার আদমদীঘি উপজেলা ছাত্রশিবিরের সভাপতি। আগামীতে সে জেলা পর্যায়ের বড় দায়িত্ব পাওয়ার উচ্চ আকাক্সক্ষায় পুলিশ হত্যা মিশন গ্রহণ করে বলে জানা গেছে। ইব্রাহিমকে ছুরিকাঘাত করে এনামুল পালিয়ে যায়। কিন্তু হাতেনাতে ধরা পড়ে তার সঙ্গী আরেক শিবির কর্মী মাসুদ রানা। মাসুদ রানার প্রদত্ত তথ্যের ভিত্তিতে কামরাঙ্গীরচর থেকে উদ্ধার করা পাঁচটি বোমার সঙ্গে পুরান ঢাকায় তাজিয়া মিছিলে বিস্ফোরিত বোমার মিল পাওয়া গেছে। তাই দুই ঘটনার মধ্যে যোগসূত্র আছে বলেই তদন্তকারীদের সন্দেহ হচ্ছে। আটক হওয়া মাসুুদ রানাকে জিজ্ঞাসাবাদ করছেন গোয়েন্দা পুলিশের কর্মকর্তারা। মাসুদ রানার দেয়া তথ্যের বরাত দিয়ে গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, জামায়াত ও শিবিরের বেশ কিছু নেতাকর্মী নাশকতার পরিকল্পনা নিয়ে অস্ত্রসহ ঢাকা ও আশপাশের বিভিন্ন স্থানে অবস্থান করছে। ঘটনার বিবরণ ও গ্রেফতার হওয়াদের পরিচয় দেখে এটা ভাবার কোন কারণ নেই যে, এই ঘটনা শিবিরের নিচু স্তরের সদস্যদের পরিকল্পনায় ঘটেছে। দেশব্যাপী অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করার জন্য জামায়াতের টপ লিডারদের পরিকল্পনার অংশ হিসেবে এএসআই ইব্রাহিমকে হত্যা করা হয়েছে। বিষয়টি পরিষ্কার, এখানে এএসআই ইব্রাহিম না হয়ে পুলিশের অন্য যে কোন সদস্যও হতে পারত। তবে মিরপুরে ওই স্পটটি তারা বেছে নিয়েছে পূর্ব পরিকল্পনার অংশ হিসেবে। সব কিছু দেখে ও শুনে মনে হয় হত্যাকারী এনামুল ঘটনার আগে ওই স্পটে এসেছে। পরখ করেছে ওই সময়ে চারপাশের পরিস্থিতি কেমন থাকে। কর্তব্য পালনকালে পুলিশ কতখানি ঢিলেঢালা থাকে সেটিও ভাল করে লক্ষ করেছে এবং কর্তব্যরত অন্যান্য পুলিশ সদস্যের দুর্বলতাগুলোকে চিহ্নিত করেছে। তা না হলে অন্যান্য পুলিশের সামনে ইব্রাহিমকে এভাবে হত্যা করে হত্যাকারী কিছুতেই নির্বিঘেœ পালিয়ে যেতে পারত না। নিরাপত্তা বাহিনীতে কাজ করার পূর্ব অভিজ্ঞতায় একটি বিষয় কিছুতেই আমার মাথায় আসছে না, তাহলোÑ শিবিরের সন্ত্রাসী এনামুল যখন এএসআই ইব্রাহিমকে ছুরিকাঘাত শুরু করল তখন অন্য পুলিশ সদস্যরা কি করছিল? তাদের কাছে কি অস্ত্র ছিল, নাকি ছিল না। অস্ত্র থাকলে তাতে কি গুলি ছিল, নাকি ছিল না? আর অস্ত্র গুলি সবই যদি থেকে থাকে তাহলে নিজেদের সঙ্গীর জীবন রক্ষার্থে পুলিশ সেই অস্ত্রের যথোপযুক্ত ব্যবহার কেন করলেন না? আরও অনেক প্রশ্ন এসে যায়। আমরা কি ধরে নেব ওখানে উপস্থিত পুলিশের কেউ অস্ত্রের ব্যবহারে আত্মবিশ্বাসী ও পারদর্শী ছিল না। তাহলে অস্ত্র গুলি দিয়ে কি লাভ, উদ্দেশ্য কি? পুলিশের আত্মরক্ষা ও জনগণের নিরাপত্তার জন্য এই প্রশ্নগুলো ছোট নয়, বড় প্রশ্ন। এর আগেও কয়েকবার আমরা দেখেছি শিবিরের সন্ত্রাসীরা পুলিশের অস্ত্র কেড়ে নিয়ে, সেই অস্ত্রের বাঁট দিয়ে পুলিশকে পিটিয়েছে। অসহায়ের মতো শিবিরের মার খেয়ে পুলিশ মাটিতে পড়ে গেছে। এটা কোন ভাল লক্ষণ নয়। এতে দিনকে দিন শিবিরের স্পর্ধা বেড়ে যাচ্ছে। আগামীতে তারা আরও বড় ধরনের ঘটনা ঘটাতে পারে। ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা সংস্থার জরিপ প্রতিবেদন অনুযায়ী শিবির বিশ্বের তৃতীয় শীর্ষ সন্ত্রাসী সংগঠন। কথাটি সবাইকে মনে রাখতে হবে। ২০১৪ সালের জানুয়ারি মাসের সাত তারিখে রাজশাহীতে হরতাল চলাকালে শিবিরকর্মীরা দুই পুলিশ সদস্যকে ধরে তাদের অস্ত্র কেড়ে নিয়ে বেধড়ক পিটায়। ২০০৮ সালের ১১ এপ্রিল, শুক্রবার বাদ জুমা বায়তুল মোকাররম মসজিদের উত্তর গেটে ধর্মান্ধ জঙ্গী ও জামায়াত-শিবির একত্রিত হয়ে পুলিশের ওপর আক্রমণ চালায়। অস্ত্র কেড়ে নিয়ে পুলিশের ওপর আঘাত করে। ওই সময়ের জরুরী আইনের সরকার জামায়াত-শিবিরের বিরুদ্ধে তখন কোন ব্যবস্থা নেয়নি। ২০১৩ সালে ২৮ ফেব্রুয়ারি দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির দ- ট্রাইব্যুনাল থেকে ঘোষণা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জামায়াত-শিবির দেশব্যাপী ভয়ঙ্কর তা-ব শুরু করে। ওই দিন বিকেলে গাইবান্ধা জেলার সুন্দরগঞ্জ উপজেলায় পুলিশ ফাঁড়িতে আক্রমণ করে বিশ্রামরত তিন পুলিশকে শিবিরের ক্যাডার বাহিনী হত্যা করে। তাই শিবির কর্তৃক পুলিশের ওপর আক্রমণ নতুন ঘটনা নয়। ধারাবাহিকভাবে তারা এটা করছে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে। ২০১৩ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি শাপলা চত্বরের সমাবেশ থেকে জামায়াত নেতারা ঘোষণা দেয়, মুজাহিদ, নিজামী, সাঈদীর কিছু হলে সারাদেশে আগুন জ্বলবে এবং গৃহযুদ্ধ শুরু হবে। তাদের সেই ঘোষণা ও পরিকল্পনা অনুসারে সাঈদীর ফাঁসির রায়ের পর তারা পুলিশকে হত্যা করে, সংখ্যালঘুদের বাড়িঘরে আগুন দেয়, জাতীয় পতাকা পোড়ায় এবং শহীদ মিনার ভাঙ্গে। এরই ধারাবাহিকতায় ২২ অক্টোবর কর্তব্যরত পুলিশ সদস্য এএসাই ইব্রাহিম মোল্লা নিহত হলেন শিবিরের হাতে। কিন্তু স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন ওঠেÑ জামায়াত-শিবির পুলিশকে টার্গেট করে এভাবে আকস্মিক হত্যাকা- চালাচ্ছে কেন? প্রশ্নটি প্রাসঙ্গিক। কিন্তু উত্তরটা কঠিন নয়। স্বাধীনতার ৪৪ বছর পার হয়ে গেলেও জামায়াত-শিবির বাংলাদেশ মানে না, বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে স্বীকার করে না। আর এজন্যেই তারা প্রকাশ্যে জাতীয় পতাকা পোড়ায় এবং শহীদ মিনার ভাঙ্গে। সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে জাতীয় পতাকা পোড়ায় এমন নজির বিশ্বের কোন দেশে নেই, কখনও ছিল না এবং আগামীতেও এমন দেশদ্রোহীমূলক উদাহরণ বিশ্বের কোথাও সৃষ্টি হবে বলে মনে হয় না। জননিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে এবং রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিধানে রাষ্ট্রেরই অন্যতম একটি প্রতিষ্ঠান পুলিশ বাহিনী। সুতরাং পুলিশবাহিনীর মনোবল যদি ভেঙ্গে দেয়া যায়, আত্মবিশ্বাস নষ্ট করে ফেলা যায়, তাহলে পুরো পুলিশবাহিনী সহজেই অকার্যকর হয়ে পড়বে। বৃহত্তর জনগণ তখন পুলিশের ওপর থেকে আস্থা হারাবে। পুলিশের ওপর নির্ভরশীল না হয়ে তারা স্থানীয় জঙ্গী সন্ত্রাসীদের ওপর নির্ভরশীল হবে। আর তখন সেই সুযোগটাই নেবে জামায়াত-শিবির এবং তাদের বেনামে অগণিত জঙ্গী সংগঠন যেমন, জেএমবি, জেএমজেবি, হরকত-উল-জিহাদ, হিযবুত তাহরীর, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম ইত্যাদি। জনগণকে তখন তারা ভয়ভীতি দেখিয়ে জিম্মি করে ফেলবে। মানুষ ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে নীরব-নিস্তব্ধ হয়ে যাবে। এটাই চায় জঙ্গীরা, এটাই তাদের প্রাথমিক মিশন। জনগণকে একবার নীরব-নিস্তব্ধ করতে পারলে সহজেই তারা আধুনিক, প্রগতিশীল, অসাম্প্রদায়িক ও বিজ্ঞানভিত্তিক রাষ্ট্র ও সমাজকে বিদায় জানাতে পারবে। পূর্বাভাস ও বার্তায় বলে এটা জামায়াত-শিবিরের পরিকল্পনা। তাই এটা শুধু সকলের জ্ঞাতার্থে ও উপলব্ধির জন্য আমরা তুলে ধরছি। একাত্তরে তাদের শক্তিশালী দোসর পাকিস্তানী বিশাল সেনাবাহিনীসহ তারা বাঙালীদের কাছে পরাজিত হয়েছে। এখন তাদের পাকিস্তানী দোসররা চেষ্টা করলেও তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসতে পারবে না। এদেশীয় বড় একটি রাজনৈতিক পক্ষ এখন তাদের দোসর। কিন্তু তাতে কাজ হবে না। মুক্তিযোদ্ধারা এখনও বেঁচে আছে এবং লক্ষ-কোটি তরুণ প্রজন্মের মুক্তিযোদ্ধা ইতোমধ্যে সৃষ্টি হয়েছে। সুতরাং জামায়াত-শিবিরের পরিকল্পনা কোন দিন এদেশে বাস্তবায়িত হবে না। তাদের চূড়ান্ত পরাজয় সমাসন্ন। লেখক : ভূ-রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক
×