ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

নৌ সিল্ক রুটে যুক্ত হতে চলেছে বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ০৫:৫১, ৩১ অক্টোবর ২০১৫

নৌ সিল্ক রুটে যুক্ত হতে চলেছে বাংলাদেশ

তৌহিদুর রহমান ॥ চীনের প্রস্তাবিত নৌ সিল্ক রুটে যুক্ত হতে চলেছে বাংলাদেশ। নৌ সিল্ক রুটে যুক্ত হওয়ার জন্য বেজিংয়ের প্রস্তাব খতিয়ে দেখছে ঢাকা। দেশটির ওই প্রস্তাব ইতিবাচক হিসেবে দেখা হচ্ছে। আগামী ডিসেম্বরে চীনের প্রেসিডেন্টের ঢাকা সফরকালে এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়া হতে পারে। আর নৌ সিল্ক রুটে যোগ দেয়ার ফলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে একটি নতুন মাত্রা যোগ হবে বলে আশা করা হচ্ছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র এসব তথ্য জানায়। সড়কপথে সিল্ক রুটের পাশাপাশি সমুদ্রপথে সিল্ক রুট পুনরুদ্ধারের ঘোষণা দিয়েছে চীন। বিশ্বের প্রায় ৫০ দেশের কাছে নৌ সিল্ক রুটে যুক্ত হওয়ার জন্য প্রস্তাব দিয়েছে দেশটি। চীনের এই প্রস্তাবে ইতোমধ্যেই সাড়া দিয়েছে বিভিন্ন দেশ। চীনের দক্ষিণ সাগর থেকে ভারত মহাসাগর, আরব সাগর, ভূমধ্যসাগর হয়ে ইউরোপে যুক্ত হবে চীনের এই সিল্ক রুট। চীনের এই সিল্ক রুটে যুক্ত হওয়ার জন্য প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমার, ভারত, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপও রয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মেরিটাইম অনুবিভাগের মহাপরিচালক রিয়ার এ্যাডমিরাল (অব) এম খুরশেদ আলম জনকণ্ঠকে বলেন, চীনের প্রস্তাবিত সিল্ক রুট বাস্তবে চালু রয়েছে। তবে চীন এই রুট আনুষ্ঠানিকভাবে চালু করতে চায়। সে কারণে তারা বিভিন্ন দেশের কাছে তাদের এই প্রস্তাব পেশ করেছে। বাংলাদেশ-ভারত-মিয়ানমার-চীনের মধ্যে যে বিসিআইএম উদ্যোগ তা বাস্তবায়ন হলে, এটাও সিল্ক রুটের আওতায় পড়বে। আসলে নৌপথে যোগাযোগ বাড়ালে সব দেশেরই লাভ হবে। সূত্র জানায়, বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে। এছাড়া মংলা ও চট্টগ্রাম বন্দরকে ঢেলে সাজানো হচ্ছে। অপরদিকে পায়রায় সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করা হচ্ছে। এসব সমুদ্রবন্দর পুরোপুরি সচল রাখতে হলে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সমুদ্রপথে পণ্য আনা-নেয়া বাড়াতে হবে। সে কারণে বাংলাদেশ নৌ সিল্ক রুটে যুক্ত হতে চায়। এছাড়া নৌ সিল্ক রুটের মাধ্যমে ভারতের উত্তর-পূর্ব প্রদেশের সাত বোনখ্যাত রাজ্যগুলো ও ল্যান্ডলক কান্ট্রি হিসেবে পরিচিত নেপাল-ভুটানও লাভবান হবে। আর এ ক্ষেত্রে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবে বাংলাদেশ। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, চীনের প্রেসিডেন্টের ঢাকা সফরের প্রস্তুতি চলছে। এই সফরের তারিখ এখনও নির্ধারিত হয়নি। তবে চলতি মাসের শেষেরদিকে অথবা ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে তার এই সফর হতে পারে। চীনা প্রেসিডেন্টের ঢাকা সফরকালে নৌ সিল্ক রুটে যুক্ত হওয়ার বিষয়ে ঘোষণা আসতে পারে। উল্লেখ্য, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত বছর চীন সফরকালে অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে নৌ সিল্ক রুট নিয়েও আলোচনা হয়েছে। সে সময়ে চীনের ওই প্রস্তাবের ভূয়সী প্রশংসা করে নীতিগতভাবে সমর্থনও দেয় বাংলাদেশ। চীনের প্রেসিডেন্ট ইতোমধ্যেই ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ (একই সড়কে একই বাঁধনে) উদ্যোগ ঘোষণা করেছেন। এই উদ্যোগের অংশ হিসেবে সড়কপথে সিল্ক রুট ও মেরিটাইম সিল্ট রুট চালু করতে চায় চীন। দুটি রুটই প্রাচীনকালে চালু ছিল, তবে এখন আর ওই নামে চালু নেই। সিল্ক রোডের চেয়ে সিল্ক রুটই বেশি কার্যকর হবে বলে আশা করা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের অভিমত, সড়কপথে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানোর চেয়ে সমুদ্রপথে যোগাযোগ বাড়ানোর উদ্যোগটি বেশি সহজ। আর সমুদ্রপথে পণ্য আনা-নেয়ার খরচও কম। একটি জাহাজে যত বেশি পণ্য আনা-নেয়া করা সম্ভব, সড়ক বা বিমানপথে তত বেশি পরিমাণ পণ্য আনা-নেয়া সম্ভব নয়। সে কারণে নৌ সিল্ক রুটই বেশি কার্যকর হবে। কূটনৈতিক সূত্র জানায়, সমুদ্রপথে সিল্ক রুট চীনের একটি কৌশলগত উদ্যোগ বলেও মনে করা হয়। এই উদ্যোগের শুরু হয় দুই বছর আগে। এর মাধ্যমে চীন ঐতিহাসিক সিল্ক রুটের দেশের মধ্যে বিনিয়োগ ও সহযোগিতা বৃদ্ধি করতে চায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত বছর বেজিং সফরের সময় বিষয়টি নিয়ে চীনের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করেছেন। চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং গত বছর নবেম্বরে এ উদ্যোগ বাস্তবায়নের জন্য ৪০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের একটি তহবিল গঠনের ঘোষণাও দিয়েছেন। প্রাচীন নৌ সিল্ক রোড পুনরুদ্ধারের জন্য বেজিংয়ের পক্ষ থেকে দুই বছর আগেই ঘোষণা দেয়া হয়। সে সময় চীনা প্রেসিডেন্ট ইন্দোনেশিয়া সফরকালে বিষয়টি আলোচনায় আনেন। এরপর গত বছর চীনা প্রেসিডেন্ট মালদ্বীপ ও শ্রীলঙ্কা সফর করেন। সে সময় শি জিনপিং তার সফরকালে নতুন নৌ সিল্ক রুট খোলার বিষয়ে শ্রীলঙ্কা ও প্রতিবেশী মালদ্বীপের কাছ থেকে সমর্থন লাভ করেন। এদিকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নিষ্পত্তি হওয়ার পর বাংলাদেশ এখন সমুদ্র অর্থনীতি জোরদার করতে চায়। বঙ্গোপসাগর ঘিরে অর্থনীতিতে মনোযোগী এখন বাংলাদেশ। সমুদ্র সম্পদ আহরণের পাশাপাশি সমুদ্রবন্দরকেও সর্বোচ্চ পর্যায়ে ব্যবহার করতে চায় সরকার। সে কারণে চীনের নতুন নৌ সিল্ক রুটে যোগ দিতে চায় বাংলাদেশ। চীন প্রস্তাবিত নৌ সিল্ক রুটে যোগ দিলে বাংলাদেশ লাভবান হবে বলে মনে করেন মেট্রোপলিটান চেম্বারের প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর। সম্প্রতি রাজধানীর বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল এ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের (বিআইআইএসএস) উদ্যোগে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, বাংলাদেশ চীনের এই প্রস্তাবে নীতিগতভাবে সম্মত হয়েছে। এটা ব্যবসায়িক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একজন ব্যবসায়ী হিসেবে আমি মনে করি, নৌ সিল্ক রুটে আমাদের প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে। সূত্র জানায়, দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের সঙ্গে চীনের যোগাযোগের উন্নয়ন ঘটিয়ে নতুন অর্থনৈতিক বেল্ট গড়ে তুলতে চায় চীন। এই উদ্যোগের অংশ হিসেবে ৫ হাজার কোটি ডলারের এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক (এআইআইবি) গঠন করা হয়েছে। তার পরই ৪০ বিলিয়ন ডলারের একটি তহবিল গঠন করা হয়। এই তহবিল সিল্ক রুট ও একুশ শতকের নৌ সিল্ক রুট গঠনে ব্যয় করা হবে। সূত্র জানায়, প্রাচীনকালে চীন থেকে সমুদ্রপথে দক্ষিণ এশিয়া হয়ে ইউরোপে যাওয়ার জনপ্রিয় বাণিজ্যপথ ছিল এই সিল্ক রুট। চীনে মিং রাজবংশের প্রতিষ্ঠার পরে বাণিজ্য প্রসারের জন্য এই রুট চালু করা হয়। কেননা, সে সময় কৃষি ও হস্তশিল্প উন্নত ছিল, পণ্য-অর্থনীতিরও দ্রুত প্রসার হয়। মিং রাজবংশের প্রথমদিকে চীনের নৌ চলাচল শিল্প পৃথিবীর শীর্ষস্থানে ছিল। বিখ্যাত নৌ পরিব্রাজক ঝেং হে সাতবার নৌবহর নিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, ভারত, আরব অঞ্চল ও পূর্ব-আফ্রিকা অঞ্চল চষে বেড়ান। ২৮ বছর প্রশান্ত মহাসাগর থেকে ভারত মহাসাগরে চীনা পণ্য নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছিলেন ঝেং হে। তৎকালীন বাংলার রাজধানী সোনারগাঁওয়ে তিনি দু’বার এসেছিলেন। তিনি প্রথমবার আসেন ১৪২১ ও দ্বিতীয়বার আসেন ১৪৩১ সালে। তার পরিচালিত রুটই সিল্ক রুট নামে অভিহিত। চীন এ নৌরুটটি নতুন করে আবার চালু করতে চায়।
×