ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

হোটেল কর্মচারী হত্যাকাণ্ড

রিয়াদের ভাইকে মামলা তুলে নেয়ার হুমকি সোহেলের ভাইয়ের

প্রকাশিত: ০৫:৫১, ৩১ অক্টোবর ২০১৫

রিয়াদের ভাইকে মামলা তুলে নেয়ার হুমকি সোহেলের ভাইয়ের

গাফফার খান চৌধুরী ॥ চাঁদাবাজ ধরতে নিজের পাতা সিসি ক্যামেরার গোপন ফাঁদে, খুনী হিসেবে নিজেই ধরা পড়েছে ঘরোয়া হোটেলের মালিক আরিফুল ইসলাম সোহেল। সিসি ক্যামেরার ফুটেজ প্রমাণ দিচ্ছে, সোহেলই গুলি চালিয়ে হোটেল কর্মচারী কিশোর রিয়াদকে হত্যা করেছে। মাত্র দেড়হাজার টাকা ও একটি মোবাইল ফোন চুরির অভিযোগে নির্মম নির্যাতনের পর মুখে পিস্তল ঠেকিয়ে গুলি চালিয়ে রিয়াদকে হত্যার পর ইতোমধ্যেই ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে সোহেল। সিসি ক্যামেরা ৩টি সোহেল নিজ উদ্যোগে নির্মাণাধীন ১০ তলা নিজস্ব বাড়িতে লাগিয়েছে। চাঁদাবাজ ধরতেই তার এই গোপন তৎপরতা। টাকার জোরে বেশিরভাগ সময় মাতাল হয়ে বেপরোয়া জীবন যাপনে অভ্যস্ত ছিল সোহেল। একটি শটগানের লাইসেন্স থাকলেও সোহেলের গাড়িতে অন্তত সব সময় চারটি আগ্নেয়াস্ত্র থাকত। অন্যগুলো অবৈধ। হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত পিস্তলের বৈধতার কোন কাগজপত্র মেলেনি। শুক্রবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত অপর দুই আসামি গ্রেফতার হয়নি বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দাবি করেছে। এ মামলায় তিন আসামির মধ্যে গ্রেফতারকৃত জসীমকে ৭ দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। হোটেলের ম্যানেজারসহ ৫ সাক্ষী ঢাকার সিএমএম আদালতে রিয়াদ হত্যাকা-ের বর্ণনা দিয়েছেন। বর্ণনায় সোহেলই গুলি চালিয়ে রিয়াদকে হত্যা করেছে বলে সাক্ষীরা তাদের জবানবন্দীতে জানিয়েছেন। এদিকে রিয়াদ হত্যা মামলার বাদী নিহতের বড় ভাই রিপন হোসেনকে ঢাকায় এসে একলাখ টাকা নিয়ে দ্রুত মামলা তুলে নেয়ার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। এমন প্রস্তাব দেয়া হয়েছে রিয়াদের হত্যাকারী সোহেলের বড়ভাই রাসেলের নামে। মামলা তুলে না নিলে বড় বিপদ হতে পারে বলেও আশঙ্কার কথা জানানো হয়েছে। এমন প্রস্তাবের পর ঢাকায় আসার সাহস হচ্ছে না বলে জনকণ্ঠের কাছে আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন রিপন। যদিও সত্যি সত্যিই রাসেল ফোন করে এমন হুমকি দিয়েছেন নাকি তার পরিচয়ে অন্য কেউ দিয়েছে তা নিশ্চিত করে বলতে পারেননি নিহতের বড়ভাই রিপন। চলতি বছরের ২৭ অক্টোবর মঙ্গলবার দিবাগত রাত ১টায় রাজধানীর ওয়ারী থানাধীন স্বামীবাগের ৭৩ নম্বর নির্মাণাধীন ১০ তলা বাড়ির দ্বিতীয় তলায় ঘরোয়া হোটেলের কর্মচারী রিয়াদ হোসেনকে (১৬) গুলি চালিয়ে হত্যা করে হোটেল মালিক আরিফুল ইসলাম সোহেল (৩৩)। এমন ঘটনায় সারাদেশে তোলপাড় চলছে। প্রসিদ্ধ এই হোটেল আর হোটেলের মালিক সম্পর্কে মানুষের চরম ঘৃণা প্রকাশ পেয়েছে। এ ব্যাপারে আলাপকালে অনেকেই বলেছেন, যে পাষ- সামান্য কিছু টাকার জন্য একজন দরিদ্র কর্মচারীকে নির্মমভাবে গুলি চালিয়ে হত্যা করতে পারে, আর যাই হোক সেই হোটেলে আর কোনদিন যাওয়ার প্রশ্নই আসে না। মতিঝিলজুড়ে ছি ছি পড়ে গেছে। অনেকে ঘৃণায় হোটেলে থুথু পর্যন্ত ছিটিয়েছেন। ঘটনার পর থেকেই মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকার ৪ নম্বর হোল্ডিংয়ে অবস্থিত ৩ তলা হোটেলটি বন্ধ। মানুষের রোষানলের মুখে রয়েছে হোটেলটি। জানা গেছে, ঘটনার সূত্রপাত হোটেলটির গ্লাসবয় (টেবিলে টেবিলে গ্লাস সরবরাহকারী) শফিকুলের চুরি যাওয়া দেড়হাজার টাকা ও একটি মোবাইল ফোনকে কেন্দ্র করে। নিহত রিয়াদ টাকা ও মোবাইল ফোন চুরি করেছে বলে শফিকুল সরাসরি হোটেল মালিকের কাছে অভিযোগ করে। এমন অভিযোগে মঙ্গলবার সন্ধ্যা পৌনে ৬টার দিকে রিয়াদের হাত-পাসহ হোটেলের দ্বিতীয় তলায় জানালার গ্রিলের সঙ্গে পিঠমোড়া দিয়ে বেঁধে রাখা হয়। পাশাপাশি তাকে শারীরিকভাবে মারধরও করা হয়। খবর পেয়ে রিয়াদের ভাই রিপন সেখানে যান। তিনি ছোট ভাইয়ের অবস্থা দেখে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলেন। ম্যানেজার শফিকের হাতে-পায়ে ধরে ভাইকে ছেড়ে দিতে বলেন। ক্ষতিপূরণ দিয়ে হলেও তিনি ভাইকে ছাড়িয়ে নিতে মরিয়া হয়ে পড়েন। কিন্তু ম্যানেজারের বক্তব্য, বিষয়টি মালিক না আসা পর্যন্ত সমাধান হবে না। এরপর মালিকের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন। রাত আটটায় আবার রিপন ভাইকে ছাড়িয়ে আনতে হোটেলে যান। কিন্তু তখনও মালিক আসেনি। রাত সাড়ে ১২টার দিকে পল্টন থানাধীন ৮৮ নম্বর শান্তিনগর (পুরনো ৫৯ নম্বর) চামেলীবাগের ইস্টার্ন পিয়ারের ২/৬০২ নম্বর ফ্ল্যাট থেকে পাজেরো গাড়ি নিয়ে হোটেলে যান মালিক। রিপন হোটেল মালিককে বিষয়টি বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু তিনি কোন কথাই শুনলেন না। হোটেলের গ্রিল কারিগর জসীমসহ অজ্ঞাত ৩-৪ জনকে রিয়াদকে বাঁধা অবস্থায়ই পাজেরো গাড়িতে তুলে দিতে বলে। তারা তাই করল। রিয়াদকে নিয়ে দ্রুত গাড়িটি চলে যায়। গাড়িতে জসীমও সঙ্গে যায়। হত্যাকা-ের পর জসীম হোটেল মালিকের সঙ্গেই গাড়িতে করে পালিয়ে যায়। পরে জসীমকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয় পুলিশ। জসীমের সামনেই রিয়াদকে হত্যা করা হয়। হত্যাকা-ের রোমহর্ষক বর্ণনা দিয়েছে জসীম। জসীম পুলিশকে জানায়, রিয়াদকে স্বামীবাগের নির্মাণাধীন বাড়িতে নেয়া হয। ওই বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, নির্মাণাধীন ১০ তলা বাড়ির ৮ তলা পর্যন্ত ভবন উঠেছে। সামনে স্টীলের গেট। গেটের সামনের দিকে ছোট ছোট ২টি এবং হোটেল কর্মচারীদের থাকার রুমগুলোর সামনে আরও ১টি সিসি ক্যামেরা লাগানো, যা ভাল করে খেয়াল না করলে সহসাই চোখে পড়ে না। ক্যামেরা ৩টি হোটেল মালিক নিজেই লাগিয়েছেন। কারণ সাড়ে ১২ কাঠা জমির ওপর আলীশান বাড়ি নির্মিত হচ্ছে। স্বাভাবিক কারণেই চোখ পড়েছে চাঁদাবাজদের। চাঁদাবাজদের ধরতেই ছোট ছোট সিসি ক্যামেরা লাগানো হয়। ভিডিও ফুটেজ দেখে চাঁদাবাজদের শনাক্ত করে তাদের ধরিয়ে দিতেই এমন গোপন আয়োজন বাড়ির মালিকের। নির্মাণাধীন বাড়িটি মিতালী স্কুল ও স্কুলের পেছনে থাকা কবরস্থান লাগোয়া। তদন্তকারী সংস্থা সূত্রে জানা গেছে, সিসি ক্যামেরার ফুটেজে রিয়াদকে পাজেরো গাড়ি থেকে বাঁধা অবস্থায় নামিয়ে বাড়িটির দ্বিতীয় তলায় তুলতে দেখা গেছে। এছাড়া হত্যার পর লাশ বের করা এবং সোহেলের বের হওয়ার দৃশ্যও ধরা পড়ে ক্যামেরায়। ঘটনার সময় সোহেলের সঙ্গে তার কয়েক সহযোগীও ছিল। সোহেলের কয়েক ঘনিষ্ঠ সহযোগী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, সোহেল জীবনে অনেক বেশি পাপ করেছে। অল্প বয়সে অনেক টাকার মালিক হওয়ায় ধরাকে সরা জ্ঞান করত সোহেল। ক্ষমতা নাকি তার এ হাত সে হাত ব্যাপার মাত্র। এমন ডায়ালগ দিত। বেশি টাকার মালিক হওয়ায় বেশিরভাগ সময়ই মাতাল থাকত। বেপরোয়া জীবন যাপনে অভ্যস্ত ছিল। হোটেলের ভেতরেই অধিকাংশ সময় মাতাল অবস্থায় বসে থাকত। হোটেলে বসেই সব সময়ই মদ সেবন করত। রাতে সোহেল পাজেরো গাড়িতে তার কয়েক সহযোগীকে নিয়ে চলাফেরা করত। যারা সোহেলের মতোই মাতাল। গাড়িতে একাধিক আগ্নেয়াস্ত্র থাকত। একটি শটগানের লাইসেন্স রয়েছে। বাকি সব অস্ত্র অবৈধ। সোহেলের গাড়িতে কমপক্ষে ৪টি আগ্নেয়াস্ত্র থাকত। বিশেষ করে রাতে বা দিনে যখনই নির্মাণাধীন বাড়িতে যেত তখন অবশ্যই সঙ্গে কয়েক সহযোগী রাখত। তাদের সবার সঙ্গেই আগ্নেয়াস্ত্র থাকত। সোহেলের পিতার নাম নজরুল ইসলাম ওরফে নুরু বয়াতি (মৃত)। সোহেলরা দুই ভাই এক বোন। বড় ভাই রাসেল। দ্বিতীয় একমাত্র বোন রূপা। আর সবার ছোট সোহেল। ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা গেছে, বাড়িটির পশ্চিম দিকে হোটেলের কর্মচারীদের থাকার জন্য টিন দিয়ে ৩টি বড় বড় রুম করা। টিনগুলো ভবনের পিলারের সঙ্গে মোটা বাঁশের খুঁটি দিয়ে আটকানো। জসীম পুলিশকে জানায়, রিয়াদকে পশ্চিম দিকের শেষ রুমটির একটি মোটা বাঁশের খুঁটির সঙ্গে পিঠমোড়া দিয়ে বাঁধা হয়। এরপর সোহেল ও তার সহযোগীরা বাঁশ এবং কাঁঠের লাঠি দিয়ে রিয়াদকে বেঁধড়ক মারতে থাকে। রিয়াদের শরীর ফেটে রক্ত বেরিয়ে যায়। রিয়াদ জীবন ভিক্ষা চেয়ে বহু কাকুতিমিনতি করতে থাকে। কিন্তু পাষ- হোটেল মালিকের মন গলেনি। এক পর্যায়ে কোমর থেকে আগ্নেয়াস্ত্র বের করে গুলি চালিয়ে দেয়। প্রথম গুলিটি ডান পায়ের হাঁটুর ওপর লেগে চলে যায়। গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়ায় উত্তেজিত সোহেল আগ্নেয়াস্ত্রের নল রিয়াদের ডান চোঁয়ালে ঠেকিয়ে গুলি চালিয়ে দেয়। বিকট শব্দ হয়। এরপর সব শেষ। বাঁশের খুঁটির সঙ্গে বাঁধা অবস্থায় রিয়াদের নিথর দেহ ঢলে পড়ে। মুখ থেকে গল গল করে রক্ত পড়তে থাকে। পুরো ফ্লোর রক্তে লাল হয়ে যায়। পরে রিয়াদের লাশ হোটেলের ৪-৫ স্টাফকে দিয়ে মৃত অবস্থায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে পাঠিয়ে দিয়ে ছিনতাইকারীদের গুলিতে মৃত্যু হয়েছে বলে প্রচার চালানো হয়। এ ব্যাপারে রিপনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, হত্যাকারী সোহেলের বড় ভাই রাসেল পরিচয়ে তাকে ফোন করে। তাকে ঢাকায় এসে এক লাখ টাকা নিয়ে মামলা তুলে নিতে বলা হয়। অন্যথায় পরিণতি ভাল হবে না বলে হুমকি দেয়া হয়েছে। সত্যি সত্যিই হত্যাকারী সোহেলের ভাই রাসেল তাকে ফোন করে এমন হুমকি দিয়েছে নাকি রাসেলের নামে অন্য কেউ, তা তিনি নিশ্চিত নন। এ ব্যাপারে ওয়ারী থানার ওসি তপন চন্দ্র সাহা জনকণ্ঠকে বলেন, জসীমকে ৭ দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। হোটেল ম্যানেজারসহ ৫ সাক্ষী আদালতে হত্যাকা-ের বর্ণনা দিয়েছেন। সোহেলই রিয়াদকে গুলি চালিয়ে হত্যা করেছে বলে সাক্ষীদের সাক্ষ্যে প্রকাশ পেয়েছে। এছাড়া ৩টি সিসি ক্যামেরার ফুটেজ পর্যালোচনাতেও হত্যাকা-ের সঙ্গে সোহেলের জড়িত থাকার প্রমাণ মিলেছে। শুক্রবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত অপর দুই আসামি গ্রেফতার হয়নি। এ ব্যাপারে র‌্যাবের লিগ্যাল এ্যান্ড মিডিয়া বিভাগের পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান ও ঢাকা মহানগর পুলিশের মিডিয়া বিভাগের উপ-কমিশনার মুনতাসিরুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা জনকণ্ঠকে বলেন, বিমানবন্দর ও বাংলাদেশ-ভারত স্থল সীমান্ত পয়েন্টগুলোতে পলাতক দুইজনের ছবি ও তাদের সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্যসহ বিশেষ বার্তা পাঠানো হয়েছে। হত্যাকা-ে ব্যবহৃত আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধারে চেষ্টা চলছে। হুমকির বিষয়ে মামলার বাদীর অভিযোগের বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
×