ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

সুন্দি কাছিম

হলুদ ফোঁটার ছানা তুখোড় শিকারি কেউ বলে জলখাসি

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ৩১ অক্টোবর ২০১৫

হলুদ ফোঁটার ছানা তুখোড় শিকারি কেউ বলে জলখাসি

শরীফ খান টিপটিপ বৃষ্টি পড়েই চলেছে, মাঠের কিনারের একটি ছোট্ট পুকুরের উত্তর পাড়ে বসে বড়শি বাইছে তিন দুরন্ত শিশু। বয়স ওদের ৮-৯ বছর করে হবে। পাটকাঠির ছিপ। নায়লনের সুতো। মুরগির পালকের ডাঁটির ফাৎনা। চেলা-পুঁটি-টেংরা ওরা পেয়েছে কয়েকটি। সকাল বেলায় এসব মাছ বড়শি বেশি গেলে। মাছ ধরা তো নয়, এদের কাছে এটা একটা ‘মাছধরা মাছধরা’ খেলা। পুকুরে শাপলা-রক্তশাপলা আছে। হরেক রঙের গঙ্গাফড়িং উড়ে-ঘুরে বেড়াচ্ছে। শাপলার উপরে বসলেই ওদেরকে টার্গেট করেছে ভেসে থাকা স্কিপার ব্যাঙেরা। তুখোড় শিকারি ওরা। জলে ভেসে তাক করে এক লাফে শূন্যে উঠে শিকার মুখে পুরে পড়ে গিয়ে বিপরীত দিকে। দু’ফুট উচ্চতার গঙ্গাফড়িং অনায়াসে শিকার করে ওরা। ছোট একটা পুঁটিমাছ তুলল এক বালক, মাছটিকে বড়শিমুক্ত করার সময় তার নজর আটকে গেল বিপরীত পাড়ের ঢালুর দিকে- হলুদ বর্ণের কিছু একটা যেন পিলপিল করে নেমে আসছে ঢালু বেয়ে পুকুরের জলের দিকে। ওইতো! আরও দুটো! চিৎকার দিল সে, দেখাল অন্য দু’জনকে। তারপর দে দৌড়-ঘুরপথে এসে হুমড়ি খেয়ে পড়ে একজনেই দু’মুঠিতে ধরল দুটিকে, বাকি দুজন অনেক চেষ্টা করে অন্যটিকে পাকড়াও করতে পারল না। ক্রিকেট বলের মতো আউট সুইং করে নেমে গেল পুকুরের জলে। দুজনেই দিল জলে ঝাঁপ। গেল কোথায়! চারপাশে হাত চালালো; নেই। ওদের লম্পঝম্প দেখে এগিয়ে এলেন এক মধ্যবয়সী লোক। নিজের হাতে নিয়ে দেখলেন-বহুদিন পরে দেখলেন তো! তাই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে বললেন, পাড়ের ওপর খোঁজ, আরও পাবি। পাওয়াও গেল, সাহায্য করলেন ভদ্রলোকই, আরও পাঁচটি মিলল। শিশুরা ভুলে গেল ছিপ-বড়শির কথা। ওরা এগুলোকে ভাগ করে নেবে, মাটির পাত্রের জলে রেখে পুষবে। খেতে দেবে ছোট ছোট মাছ। কী সুন্দর যে এগুলো! কী চমৎকার চোখ! ঘাড়-মাথা-পিঠে কী সুন্দর গোল গোল হলুদ ছোপ! ওখানে হাজির হয়ে গেল আরও কিছু ছেলে-বুড়ো। সবাই দেখতে চায়। ওই দেখার জন্যই এলেন কাছের হাই স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক মুস্তাহিদ সুজা। সঙ্গে তার প্রাণিপ্রেমী এক তরুণ ফাহিম। সৌখিন ওয়াইল্ড লাইফ ফটোগ্রাফার। সে বাংলাদেশ ওয়াইল্ড লাইফ ক্লাবের সদস্যও। সে ছবি তুলল। মাপজোক ও ওজন রেকর্ড করল। রঙের বর্ণনা টুকে নিল। তারপর মুস্তাহিদ সুজা, কবির, তরুণ ও অন্য একজন মিলে ওই শিশুদের অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে পাশের সাতশৈয়া হাই স্কুলের কৃত্রিম লেকটিতে অবমুক্ত করে দিলেন। মোবাইলে সব তথ্য টুকে নিলাম আমি। ছবি পাঠালো ফাহিম। সদ্য ডিম থেকে বেরিয়ে যে পাঁচটি প্রাণী ঢালু বেয়ে পানির দিকে আসছিল, ওরা হলো সুন্দি কাছিমের ছানা। মা তো পুকুর পাড়ের নরম দোআঁশ মাটি খুঁড়ে ডিম পেড়েই চলে গিয়েছিল জলাশয়ে। প্রকৃতির নিয়মেই বাচ্চারা ডিম থেকে বেরিয়ে নরম মাটি ফুঁড়ে উপরে উঠেছিল, তারপর বংশগতির ধারায় জলের দিকেই নেমে আসছিলÑ তখনই নজরে পড়ে গিয়েছিল বড়শিবাওয়া শিশু তিনটির। এক্ষেত্রে এদের অন্য বিপদও থাকে। বেজি বা গুইসাপের সামনে পড়লে উপায় নেই। গুইসাপে টুপুস করে গিলে ফেলে। বেজিরা প্রথমে খেলায় মাতে, হয়রান করে, তারপর মেরে ফেলে। এই বয়সী ছানারা বড়দের মতো শক্ত খোলের ভেতর মাথা টেনে নিতে পারে না, বা বিপদ বোঝে না। শিকারি পাখিরাও তুলে নেয়। ঘটনাটি গত আগস্টের প্রথম সপ্তাহের, বাগেরহাটের ফকিরহাট উপজেলার বারাশিয়া গ্রামের। বহু বছর বাদে আমি সুন্দি কাছিমের সদ্য ডিম থেকে বেরুনো বাচ্চার ছবি দেখে নষ্টালজিয়ায় আক্রান্ত হয়েছিলাম। শৈশব-কৈশোরে আমাদের বাড়ির দুটি পুকুর পাড়েই প্রতিবছর ৫-৬ জায়গায় ডিম পাড়ত। বেজি ও গুইসাপেরা অনেক সময় মাটি খুঁড়ে ডিম খেয়ে ফেলত। পুকুরের জলের ভাসমান বাঁশ-কাঠ বা তালের ডোঙ্গার উপরে শীতের সকালে রোদ পোহাত। যে বাচ্চাটির মাপজোক-ওজন নেয়া হয়েছিল, সেটি লম্বায় ছিল সাড়ে পাঁচ সেমি (ওটির ছবিই এই লেখার সঙ্গে ছাপা হলো) চওড়া পাঁচ সেমি, গলা সাড়ে চার সেমি, ওজন ১৭ গ্রাম। প্রতিটি পায়ে পাঁচটি করে আঙ্গুল। আঙ্গুলের রঙ কালচে। পেট হলুদ। পা ধূসর-কালো। ধূসর-কালো পিঠের উপরে ৩৪টি হলুদ গোলাকার ফোঁটা। ঘাড়-মাথা জোড়া হলুদ ফোঁটা ১৯টা। চোখের মণি কালো। মনির বর্ডার সাদা। পিঠের উপরের খোলটার কিনারা জোড়া হলুদ রঙের বর্ডার। পূর্ণবয়স্ক কাছিমের শুধু খোলসটা লম্বায় হয় ২৪-৩৭ সেমি। গলা-মাথা তো বাদই রইল। অর্থাৎ ডিম ফুটে সদ্য বেরুনো বাচ্চার চেয়ে ৪-৬ গুণ বড়। সুন্দি কাছিমের ইংরেজী নাম ঝঢ়ড়ঃঃবফ ঋষধঢ়ংযবষষ ঞঁৎঃষব. বৈজ্ঞানিক নাম খরংংবসুং ঢ়ঁহপঃধঃধ. সারাদেশের খাল-নদী-পুকুর-বিল-জলাশয়ে ৫০ বছর আগেও যথেষ্ট পরিমাণে ছিল। এমন কমে গেছে নানান অনিবার্য কারণে। মূল খাদ্য এদের জলজ ছোট পোকা, মাছ ব্যাঙসহ কচি উদ্ভিদের ডগা-পাতা ইত্যাদি। আবার এদের খায় কিছু সম্প্রদায়ের মানুষ। এরা জলখাসি নামেও পরিচিত। বড়শি গিলে এরা বড়ই হেনস্থা হয়। এরা ডিম পাড়ে ১০-১৩টি। একেবারেই আগের দিনের খেলায় মার্বেলের মতো গোলাকার সাদা ডিম। এদের ডিম ও আস্ত প্রাণী ছাত্রজীবনে আমরা হিন্দু স্যারদের উপহার দিতামÑ তাতে পিঠে যে বেত কম পড়ত, সেটা তো আর বলার অপেক্ষা রাখে না। রুই কাতলা মৃগেল ধরার হুইল বড়শিসহ পুঁটিমাছ ধরা বড়শিতেও বাঁধতো এরা। খেডাজাল দিয়ে মাছ ধরার সময়ে তো বাঁধতই। খুবই অত্যাচার করা হতো এদের উপর। খোলের ভেতর থেকে গলা-মাথা বের যাতে করে, সেজন্য এদের পিঠে দাঁড়িয়ে লাফালাফি করত ছেলে-বুড়োরা। ইটের বেঝা চাপিয়ে দেয়া হতো পিঠে। তবুও কী বের করে গলা-মাথা! এটা একটা মজার(!) খেলা ছিল ছেলেপুলেদের কাছে। এখন খুব কষ্ট বাজে বুকের ভেতরে। না বুঝে কতবড় অন্যায় না করেছি প্রকৃতির বিরুদ্ধে, একটি নিরীহ ও উপকারী প্রাণীর ওপরে। বাগেরহাটের চিতলমারী উপজেলার ‘চিত্রা সুন্দরীবনে’ এ বছরের মধ্যভাগে আমি একটি পূর্ণবয়স্কা সুন্দি কচ্ছম দেখি। বৃহত্তর খুলনা জেলার বহু হাটবাজারে এরা ও এদের জাতভাইয়েরা প্রতিকেজি ৫০০-১২০০ টাকা দরে বিক্রি হয়। আইনত দ-নীয় অপরাধ এটা। কিন্তু শত বছরের ঐতিহ্যবাহী খাবার (কিছু কিছু সস্প্রদায়ের) বাগেরহাটে সেগুলো জলখাসি (ছাগল) নামে পরিচিত। সেটাকে কী শুধু আইন দিয়ে রক্ষা করা যাবে। অনেক ভদ্রলোক আমাকে বলেছেন, শোল, টাকি, (দু’প্রজাতি), টেংরা-পুঁটি ইত্যাদি মাছের ছোট ছোট বাচ্চারা বাজারে বিক্রি হয়, সেটাতো অন্যায় এবং বংশবৃদ্ধির অন্তরায়। ডিমওয়ালা যে কোন দেশী মাছও বাজারে বিক্রি হওয়া উচিত নয়। কচ্ছপ তো বিক্রি হয় বড় হলে। আমি আমাদের ‘উত্তরের হাওড়ের’ বহু হিন্দু জেলে মাছচাষীদের সঙ্গে কথা বলছি এ প্রসঙ্গে। তাদের বক্তব্য একটাইÑ এটা আমাদের খাবার। বিপন্ন বলে নিষিদ্ধ হলে দেশের বহু ধরনের দেশী মাছও তো বিপন্ন; সেগুলোও নিষিদ্ধ করা হোক।
×