ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সুযোগ মেলেনি তবু তারা খ্যাত

প্রকাশিত: ০৫:১৬, ৩১ অক্টোবর ২০১৫

সুযোগ মেলেনি তবু তারা খ্যাত

টেলিভিশনের পর্দায় তাদের দেখা মেলে না। বেতার তরঙ্গেও শোনা যায় না তাদের গান। কিন্তু গভীর রাতে নিভৃতপল্লীর খড়ের বিছানায় বসে তাদের সহজিয়া সুরে মুগ্ধ হয় আজও হাজারো মানুষ। এমনই দু’জন লোকশিল্পীর নাম গৌরাঙ্গ আদিত্য ও সিরাজ উদ্দিন পাঠান। একজন যাত্রার বিবেক। আরেকজন সাধক বাউল। দু’জনই বাউল-ভাটিয়ালি, জারিসারি, ঢপ-যাত্রা ও কিসসা-পালা গানের জেলা নেত্রকোনার সন্তান। দু’জনই দু’জনের জায়গায় অদ্বিতীয়। বাংলাদেশের যাত্রাজগতের শ্রেষ্ঠ বিবেক হিসেবে পরিচিত গৌরাঙ্গ আদিত্যের বাড়ি নেত্রকোনার মোহনগঞ্জের দেওথান গ্রামে। বাবা বিশিষ্ট কীর্তনীয় রমেশ আদিত্যের কাছে তার সঙ্গীতে হাতেখড়ি। এরপর গান শেখেন ওস্তাদ বীরেন্দ্র চন্দ্র গোস্বামী, বিজয়কৃষ্ণ ভট্টাচার্য ও গোপাল দত্তের কাছে। কিশোর বয়সেই যাত্রা মঞ্চে পা রাখেন। চট্টগ্রামের নামকরা যাত্রাদল বাবুল অপেরায় তার যাত্রাজীবন শুরু। এরপর নবরঞ্জন, শ্রীকৃষ্ণ, কৃষ্ণাকলি, বুলবুল, ভাগ্যলক্ষ্মী, রয়েল ভোলানাথ, চারণিক, সবুজ ও নবযুগ অপেরাসহ বহু অপেরায় টানা ৫০ বছরেরও বেশি সময় বিবেকের গান গেয়েছেন। কুড়িয়েছেন খ্যাতি-যশ। যাত্রা জগতের যে কেউ তার নামটি অতি শ্রদ্ধায় উচ্চারণ করে। মূলত বিবেকের গান করেই জীবিকা নির্বাহ করতেন। কিন্তু বলাবাহুল্য, সুদীর্ঘকাল যাত্রামঞ্চে গান গেয়ে হাজারো দর্শক মনকে নাড়া দিয়েছেন যে গুণী শিল্পী; উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতে যার দখল অনেকখানিÑ টেলিভিশনের পর্দায় বা বেতার তরঙ্গে তেমন কদর মেলেনি তার। দিনে দিনে যাত্রা যেমন তার শৌর্য-বীর্য হারিয়েছে; তেমনি গৌরাঙ্গ আদিত্যও হারিয়েছেন তার জীবিকা নির্বাহের উৎস। ভক্ত-শ্রোতাদের আমন্ত্রণে এখনও তিনি মাঝে-মধ্যে মঞ্চে ওঠেন। তবে তা দিয়ে আর জীবিকা চলে না। কিছুদিন আগেও গানের টিউশনি করতেন। এখন শরীর সায় দেয় না। বলা চলে অশীতিপর এই শিল্পী আজ প্রায় বেকার। তার কষ্ট দেখার কেউ নেই। এদিকে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী বাউল সিরাজ উদ্দিনের বাড়ি নেত্রকোনার বারহাট্টা উপজেলার সাধুয়ার কান্দায়। জন্মের সাতদিনের মাথায় বাবা ও তিন বছরের মাথায় মাকে হারান। পরে মামার বাড়িতে থেকে তৃতীয় শ্রেণীর পাঠ চুকাতে না চুকাতেই চোখ ওঠা রোগে হারান দুই চোখের দৃষ্টিশক্তি। মাত্র আট বছর বয়সে চাকরি নেন ওষুধ কোম্পানিতে। দিনের বেলা সেখানে কাজ করতেন। আর অবসরে বিভিন্ন জনের বাসাবাড়ি ও দোকানপাটের সামনে দাঁড়িয়ে গ্রামোফোনে শুনতেন আব্বাছ উদ্দিনের গান। বাড়িতে গিয়ে তার অনুকরণ করতেন। এভাবেই গান রপ্ত করেন তিনি। শিশু সিরাজের গান শুনে মুগ্ধ হয়ে কয়েকজন তাকে পরিচয় করিয়ে দেন প্রখ্যাত বাউল চান মিয়ার সঙ্গে। চান মিয়ার তালিম নিয়ে পুরোদস্তুর বাউল হয়ে ওঠেন সিরাজ উদ্দিন পাঠান। বাউলদের তত্ত্ব ও জ্ঞান সম্পর্কে অগাধ পা-িত্যের অধিকারী তিনি। কেবল নেত্রকোনায় নয়, দেশের বেশিরভাগ জেলায়, এমনকি ভারত, পাকিস্তান, ব্রিটেনেও গান করেছেন তিনি। ৭৪’এ ঢাকার টেকের ঘাটে বঙ্গবন্ধুর হাত থেকে গ্রহণ করেন পুরস্কার। দৃষ্টি প্রতিবন্ধী সিরাজ এখনও গান করেন। কিন্তু আগের মতো আর ডাক পড়ে না তার। পেট চলছে না গান গেয়ে। কারণ এখন মানুষ একতারা-ডুগডুগির গান শোনে না। বাজার দখল করেছে কেবল সারেগামা শেখা অখ্যাত শিল্পী। অথচ নিজস্ব কৃষ্টি-সংস্কৃতির গান করেন যে সিরাজ বাউলÑ তার সুযোগ মেলেনি টেলিভিশনের নিয়মিত শিল্পী হওয়ার। এমনকি কেউ এগিয়ে আসেনি তার ক্যাসেট বা এ্যালবাম প্রকাশের জন্য। শুধু কি সিরাজ উদ্দিন? বা গৌরাঙ্গ আদিত্য? এ রকম আরও অনেক শিল্পীই নীরবে-নিভৃতে ছড়িয়ে আছেন মহুয়া-মলুয়ার এই পল্লীতে; যাদের মেঠোসুর আর কণ্ঠ ইদানীংকালের অনেক টেলিভিশন কাঁপানো শিল্পীর চেয়েও কোন অংশে কম নয়। শুধু সুযোগের সীমাবদ্ধতায় আটকে গেছেন এঁরা। Ñসঞ্জয় সরকার নেত্রকোনা থেকে
×