ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

শিকদার ওয়ালিউজ্জামান

বই ॥ প্রেম, দ্রোহ ও বিবর্তনের খসড়া

প্রকাশিত: ০৬:১৫, ৩০ অক্টোবর ২০১৫

বই ॥ প্রেম, দ্রোহ ও বিবর্তনের খসড়া

শূন্য দশকের কবিগণ কেউ নগরায়নের হাহাকার ও যন্ত্রণাক্লিষ্ট, কেউ সর্বেশ্বরবাদ, বাউল ও সুফিবাদে দীক্ষিত, কেউ বাংলাদেশের জনজীবনের অনুভব ও চেতনা দ্বারা প্রভাবিত। কারো কবিতা আবার যৌনতা-সর্বস্ব, কঠিন শব্দ ভারাক্রান্ত, অতি উপমা-প্রতীকে আক্রান্ত। কারো কবিতা প্রকৃতি ও চিত্রকল্প সর্বস্ব। তবে অনেকের অভিযোগ রাজনৈতিক চেতনা খুব কমই উঠে এসেছে শূন্যের কবিতায়। কবিতাগুলো অতিমাত্রায় উত্তরাধুনিক। তাই এ সময়ের কবিতা চিরকালীনতা পাচ্ছে না খুব একটা। শূন্যের কবিরা শব্দ ভাঙা-গড়ার নিপুণ কারিগর। কিন্তু কবিতাকে তো পাঠকের কাছে পৌঁছুতে হবে। সে দায় যেমন কবির, তেমনি পাঠকও এ দায় এড়াতে পারেন না। বিবর্তনকে ধারণ করার সামর্থ্য তাদেরও থাকা আবশ্যক। কবিতা বিবর্তিত হয়, না কবিতার মধ্য দিয়ে কবির বিবর্তন ঘটে বিষয়টি বেশ দ্বান্দ্বিক। অনেকের কাছে প্রশ্নটি একেবারেই ফালতু বিষয়। একশবিংশ শতাব্দী শুরুতে যারা কবিতাকর্মী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছেন তাদের কবিতায় বিশেষ বিবর্তন লক্ষ করা যায়। কবি মিজানুর রহমান বেলাল তাদেরই একজন। শূন্য দশকের কবি। তার কবিতায় বিবর্তনের ধারাটা কতটা উঠে এসেছে; কতটা গুণমানের সেটা পাঠকের বিবেচনার বিষয়। শূন্যের কবি মিজানুর রহমান বেলাল চল্লিশটি কবিতার পসরা সাজিয়েছেন তার ‘বেদনবৃত্তের বনখাগড়া’ কাব্যগ্রন্থে। কবিতাগুলোতে চিত্রকল্প ও উপমা সৃষ্টির প্রয়াস বেশ নান্দনিক। নীরবতাময় নাটোর ট্রেন স্টেশন, ট্রেন, জীবনানন্দ, ধাতব ধূসর রেল স্টেশন আর চাকার যাবজ্জীবন চিৎকার বেশ ব্যঞ্জনাময়। বিবর্তনের ধারায় জীবনানন্দের মগ্নচোখ একাকী হাঁটে। বনলতা এখনও পাঠকের হৃদপ্রাসাদে শাদা আলোর মহর হয়ে বসবাস করে। ‘ফেরা’ কবিতাটি উপমায় বেশ সমৃদ্ধ। ‘জীবন’দা এখনও নাটোরে মগ্নচোখে একাকী হাঁটে/তাই বনলতা সবার হৃদপ্রাসাদে শাদা আলোর মহর’- ফেরা। বনের দৃশ্যকল্প পাই ‘হুর’ কবিতায়। অরণ্য তার সবুজ চাদরে আমাদেরকে কাছে ডাকে। দুরন্ত পাখির সমাবেশে অরণ্য তার সবুজ পালকে কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। অরণ্যেই লজ্জাবতির হাসি, বেতফল আর জ্যোৎস্নার প্রণয় একাকার। শ্রাবণহীন ঘাসের কঙ্কাল এখানে বিদ্রোহের সেøাগান তোলে না। কবি অরণ্যপ্রেমী তাই তার চোখে ভাসে প্রকৃতির এই প্রাচীন প্রাসাদ। ‘অন্ধ’রা বলে অরণ্য বহুদূর/তারা জানে না- অরণ্যই প্রকৃতির সবুজ হুর... হুর কবির অনুভব যেন গভীর-ভেতর। এটা তরল বা বায়বীয় ব্যাপার নয়। এই গভীরতা থেকেই জন্ম হয় বোধের সত্তা। সেই বোধতাড়িত কবি বেলাল মনে করেন স্মৃতি চর্চা আজকাল আশ্চর্য উপহাস, ছোট হয়ে আসছে শ্রদ্ধার জগত। পশুত্ব আর স্বৈরাচারী অবহেলা ক্রমশ আয়ু পাচ্ছে আমাদের সমাজে। প্রতীকবাদী কবি হিসাবে তিনি হলুদকে বিবর্তনের অনুলিখন হিসাবে দেখেছেন। বিবর্তনের এই যুগে মানুষ হলুদপ্রিয়। ‘কী আশ্চর্য! কংক্রিটবনের প্রাণীগুলো সব তবুও হলুদপ্রিয়।’- অনুভূতির অধিবেশনে হলুদ পাঞ্জাবি লোভ, অস্থিরতা, রাজনীতি, ক্ষমতা, ভ-ামি জন্ম দেয় হতাশা, বঞ্চনা, ব্যর্থতা আর অন্ধকার। ছলাকলার এই যুগে মাকড়সাও রক্তচোরা; নানান রঙে রঙিন ঠকবাজ। এমন নৈরাশ্যের অধিবেশনে কবি বিপ্লবী চেতনায় দুর্বলকে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদের মশাল জ্বালিয়ে আগুনের খামার গড়ার পরামর্শ দিয়েছেন। তবেই গড়ে তোলা যাবে জোছনার বাড়ি। ‘তুমি কী কান পেতে শুনতে পাও-/ডাস্টবিনের উঠোনে ক্ষুধার্ত চিৎকার?/মানুষ ও নেড়িকুকুরের অসহায় খাদ্যযুদ্ধে শুধুই রাত দীর্ঘ হয়/গুড়গুড় মেঘ ভাঙে বিবেকের আকাশে- পুঁতে দিবো সভ্যতা...- অনুভূতির অধিবেশনে খোঁপাখোলা সখি সত্তাসন্ধানের তীব্রতায় মানুষ কেবল মাটিকেই বেছে নেয়, হয়ে ওঠে আকাশচারী। এজন্যই তো মানুষ উড়ালপ্রিয়। পায়ের পৃথিবীজুড়ে মানুষ গড়তে চায় উড়ন্ত বাইপাস। এখানে দর্শন নেই, আত্মসন্ধান নেই, আত্মভূগোলও নেই। সে শুধুই উচ্চাভিলাষী, ঐশ্বর্যকাতর; তবে জ্ঞানের ঐশ্বর্য নয়। তাইতো মিজানুর রহমান বেলাল লিখেছেন : ‘এখানেই নাকি স্বপ্ন যাপনের আকাশ;/নেমে আসে গোত্রহীন নক্ষত্র/বিবেক বিসর্জনের লুকোচুরি মেঘ/আর দরদেও দক্ষিণা হাওয়ার পাল পেরিয়ে/মানুষ নির্মাণ করে কংক্রিটের প্রজাপতি।’- উড়ন্ত বাইপাস সাম্প্রতিক দশকগুলো মূলত বিজ্ঞান ও যন্ত্রনির্ভর। তাই মানুষের আবেগ, নিসর্গ, মানবপ্রকৃতি কেড়ে নিচ্ছে অস্থিরতা। বিবর্তনের ধারা থেকে লোকজ শিল্পও বাদ যায়নি বেলালের কবিতায়। বিবর্তিত ক্রেতা তাঁতীর শিল্পবোধ দেখে না। তারা তো নগরপ্লাজার কাচের ক্যানভাসে আর রঙ বদলের খেলায় নিজেকে খাপ খাইয়ে নিয়েছে। তাই ভূঁইচাঁপা সেলাইকলের বেদনায় আমাদের ঐতিহ্যের সূতো হারিয়েছে নিজস্ব রঙ। বিবিদের ফ্যাশনে তাঁতশিল্প শুধুই ফ্যাকাশে তারা ফোটায়। ‘সেই কবেই সূঁচ ও সুতো ছেড়েছে তাঁতপাড়া/তাই ক্লিনিকগুলোতে ভিড় করে সেলাইশিল্পের আলপনা...’ - সেলাইশিল্পের পাড়া বদল মিজানুর রহমান বেলালের কবিতগুলো শব্দ, ধ্বনি ও চিত্রকল্পের বিন্যাস নতুনত্বেও বিন্যাস সুস্পষ্ট। ‘বেদনবৃত্তের বনখাগড়া’ গ্রন্থের অনেক কবিতার সুর একই প্রতীয়মান হয়েছে। তাছাড়া পাঠকের দৃষ্টিতে শূন্যের অনেক কবির কবিতায় যৌনতার আবেশ খুঁজে পাওয়া যায়। মিজানুর রহমান বেলাল এই অভিযোগমুক্ত নন বলে আমার কাছে মনে হয়। ‘সুগন্ধি সুনামি’, ‘বাঁশিওয়ালা’, ‘অন্ধ বিশ্বাস’, ‘দুষ্টু দেবতা’, ‘শোধ’, ‘৫০০ এমজি কবিতা’, ‘নুনের নামতা’ ‘আবহাওয়ার পূর্বাভাস’, ‘সাঁতার বিষয়ক কবিতা’, ‘গল্প নয় সত্যি’, ‘কুয়াশার ফাঁদ‘, ‘অনুভূতির অধিবেশনে বৌদির নকশিকাঁথা’ কবিতাগুলো প্রেম ও যৌনতাগন্ধি। পাঠকরা পাঠকালে ভালোলাগার আবেশে হারিয়ে যাবেন।
×