আবু ইসহাক (১৯২৬-২০০৩) এমনই একজন সাহিত্যিক যে প্রথম একটি উপন্যাস ‘সূর্যদীঘল বাড়ী’ (১৯৫৫) রচনা করেই আলোচনার শীর্ষে আহরণ করেন। সেই খ্যাতি এতোটাই প্রবল ছিল, তার অন্য আর রচনার দিকে তাকানোর কোন সময় হয়নি বাংলাভাষাভাষী পাঠকের। গল্পকার হিসেবে আবু ইসহাক চল্লিশ দশকে উত্থান হলেও নিজেকে সর্বদা অন্তরালে রেখেছিলেন, তার সাহিত্য পরিধি বিবেচনা করলেই বাস্তবতা ধরা পড়ে, তবে সাহিত্যের জন্য ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করেছিলেন, সেই অভিজ্ঞতাপুষ্ট সাহিত্যসমগ্র আজ আমাদের হস্তগত, উপন্যাসের যেভাবে খড়-কুটো পুড়িয়ে একেকটি বাক্য-কাহিনী-চরিত্র নির্মাণ করেছেন, ‘পদ্মার পলিদ্বীপ’ উপন্যাসেও পদ্মার চর দখলকে কেন্দ্র করে সংগ্রামমুখর আরেক জীবনের চিত্র অবলোকন করি, মানুষ যে সর্বদা জীবনযুদ্ধে সংগ্রামরত, সে কাউকে ছাড় দেবে না, এই ছাড় দেয়া মানে যে জীবন থেকে হেরে যাওয়া, সামনে যত জড়াজীর্ণ কাঁটা-বাঁধা আসুক না কেন যুদ্ধ একমাত্র বেঁচে থাকার আশ্বাস। ঠিক একইভাবে তিনি ছোটগল্পের ক্ষেত্রেও সমান দক্ষতা দেখিয়েছেন, শ্রেণী-পেশা সম্প্রদায় নির্বিশেষে আবু ইসহাক সাধারণ মানুষের খুব কাছাকাছি তার গল্প আখ্যানকে নিয়ে গিয়েছিলেন, উল্লেখযোগ্য বেশ কিছু গল্প তার সাহিত্যভা-ারে সে’সময় যোগ হতে পারত কিন্তু ওই একটা উপন্যাসই তাকে চরম সাফল্য দিয়ে অন্য রচনাগুলোকে আড়াল করে ফেলেছে বলতে দ্বিধা নেই। যেভাবে ‘সোনালী কাবিন’-এর কবি আল মাহমুদ বাংলাসাহিত্যে শক্তিধর-প্রজ্ঞাসম্পন্ন কবি হিসেবে এতখানিই খ্যাতি লাভ করেছেন যে তার উপন্যাস বিশেষ করে ছোটগল্পের দিকে দৃষ্টিপাত করবার সময় কেউই পায়নি অথবা সেগুলো সেভাবে আলোচনায় স্থান লাভ করেনি। যেমন বাংলাভাষী পাঠকমাত্রই জানে, কাজী আবদুল ওদুদ একজন প্রথমশ্রেণীর প্রাবন্ধিক কিন্তু তিনি ‘নদীবক্ষে’ নামে শ্রেষ্ঠ একটা উপন্যাসের জনক এবং কবি হুমায়ুন কবীরকে দার্শনিক-রাজনীতিবিদ-প্রাবন্ধিক-শিক্ষাবিদ হিসেবে জানলেও তিনি যে ‘নদী ও নারী’ নামে একটা বিখ্যাত উপন্যাসের রচয়িতা সে তথ্য ক’জনইবা রাখে।
আবু ইসহাক বাংলাভাষী পাঠকের সামনে উজ্জ্বল একজন উপন্যাসিক হিসেবে অধিষ্ঠিত হলেও ছোটগল্পের একটা ভূগোল তার সবসময় আলোকিত করে আছে কোমলমতি পাঠকের পাঠ্যতালিকায়। আমাদের স্মরণ রাখা আবশ্যক, ‘সূর্যদীঘল বাড়ী’ আবু ইস্হাক-এর প্রথম ও সার্থক উপন্যাসই নয়, বিশেষ করে আঞ্চলিক ভাষায় তা ফুটিয়ে তুলে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছেন তিনি, আমরা তার এই উপন্যাসটিকে বাংলাসাহিত্যের একটা দলিল, গ্রামীণ মুসলিম সমাজ বিশেষ করে নিম্নবিত্ত শ্রেণীর পরিবারের পর্যুদস্ত জীবন যাপন সংগ্রামী চেতনা এবং যুদ্ধের বাস্তব করুণালেখ্য হিসেবে গণ্য করতে পারি। উপন্যাসে দুর্ভিক্ষপীড়িত নিম্নবিত্ত ও বিত্তহীন জনজীবনের হতাশ-ব্যর্থতা, দুর্দশা, লাঞ্ছনা, আশা-আকাক্সক্ষার টানাপড়েন, বিভাগোত্তর কালের স্বাধীনতায় প্রাপ্ত সাধারণ মানুষের কাক্সিক্ষত সুখ সচ্ছলতার অচরিতার্থতা ইত্যাকার চালচিত্র।
তার প্রথম গল্পসঙ্কলন ‘হারেম’ (১৯৬২) এবং ‘মহাপতঙ্গ’ (১৯৬৩) ছাড়াও বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় আরও বেশ কিছু ছাপা গল্প ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে, বাস্তবধর্মী গল্পকার তিনি, তার গল্পে সহজ-সরল জীবনাচারণের যে ইঙ্গিত বা চিত্রপট লক্ষ্য করি তা প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের মানুষেরই চিত্ররূপ। বাংলাসাহিত্যে খুব বেশি ভাল গাল্পিক নেই বললেই চলে, সেখানে দাঁড়িয়ে আবু ইসহাক ভোরের প্রথম সূর্যের মতো আলো ঢেলে দিয়েছেন, প্রথমে উপন্যাস দিয়ে সাহিত্যাঙ্গনকে ভরিয়ে তুললেও পরবর্তী সময়ে বোধগম্য সিরিয়াসধর্মী ছোটগল্প দিতে থাকেন বাংলাভাষী পাঠককে, এ যেন না চাইতেই অনাকাক্সিক্ষত বৃষ্টিজল। তার ছোটগল্পে দর্শন, মানুষ-প্রকৃতি এবং কুসংস্কারের বিরুদ্ধে, সবচেয়ে বড় কথা তিনি ধর্মান্ধতার সঙ্গে আপোস করেননি, সচেতনভাবে লিখেছেন, লিখেছেন এবং দেখেছেন মানুষের ভেতরের আরেক মানুষ, যারা প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করে, জীবনযাপনের প্রয়োজনে এই আন্দোলনের শরিক ছিলেন তিনিও।
‘দাদীর নদী দর্শন’ গল্পে এক প্রৌঢ় নারীর জীবন দর্শন ফুটে উঠেছে, পর্দা প্রথার কড়াকড়ির একটা দিক এ গল্পে সুস্পষ্টভাবে দেখানো হয়েছে, পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় নারীকে রুদ্ধ-অচ্ছুত করে রাখার যে কৌশল দীর্ঘসময় বলবত ছিল, যার ফলে সে তার নিজের স্বাধীনচেতনাকেই হারিয়ে ফেলে, রয়ে যায় সবার কাছ থেকে অনেক দূরে, দাদীর ভেতরে এভাবে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে ধর্মীয় ভীতি, সে সুর করে কোরআন পড়তে পারলেও বাংলা অর্থ বোঝার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করত না, যার ফলে ধর্মান্ধতা তাকে গ্রাস করে, আধুনিক শিক্ষা বা বিলেত গমন এবং গান-বাজনাকে কুফরি বলে তীব্র বিদ্বেষপোষণ করত। আবু ইসহাক বাংলার মানুষের এই কূপম-কতা-কুসংস্কারতা- অদৃষ্টনির্ভরতা-পরনির্ভরতা সর্বোপরি ধর্মান্ধতা বিষয়ে সচেতন করার যে প্রয়াস নিয়েছেন, তা এ গল্পে দৃশ্যমান। বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন পিঞ্জরে বন্দী যে সমস্ত অবরোধবাসিনীদের নিয়ে সাহিত্য রচনা করেছেন অর্থাৎ ওইসব কপালপোড়া হতভাগিনীদের তুলে এনে সামনের কাতারে স্থান দিয়েছেন, তেমনি কথাকার আবু ইসহাক গোয়ালের খুঁটিতে বাঁধা সে সমস্ত প্রাণীকূল নিয়ে গল্পের আখ্যান নির্মাণ করেছেন, মানুষকে সচেতন করার এর চেয়ে উৎকৃষ্ট উদাহরণ আর কি হতে পারে। দাদী অনেক জিহাদী পথে অবস্থান করলেও পদ্মানদী যখন ভাঙতে-ভাঙতে মীরহাবেলীর কাছাকাছি আসে, তখন বাধ্য হয়ে দাদীকেও নৌকাযোগে স্থানান্তরিত করা হয়। কিন্তু নতুন বাড়ি প্রবেশ করতে না করতেই দাদী অসুস্থবোধ করে এবং বমি হওয়া, জ্ঞান হারিয়ে ফেলা, তারপর মৃত্যুমুখে পতিত হওয়া। সবই নদী দর্শনের ফলে, অর্থাৎ একটা ভ্রান্ত বিশ্বাসের মৃত্যু পাঠক প্রত্যক্ষ করে গল্পের শেষভাগে।
দেশভাগ যে একটা মারাত্মক পরিণতি তার রেশ দেখা যায় ‘বনমানুষ’ গল্পে, সাম্প্রদায়িকতার ভয়াবহ রূপ দেখেছে মানুষ, সড়ক-মহাসড়ক সবখানেই লাশের মিছিল, প্রতিমুহূর্তে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে যাওয়া, তার ভেতর মানুষ জীবন অতিবাহিত করেছে, বনবিভাগের চাকরি ছেড়ে কলকাতায় চাকরি করতে গিয়ে প্রতিনিয়ত যে বিড়ম্বনা, তার মধ্যে জীবন থমকে যায়, মানুষের মিছিল-ধর্মঘট ভিড়-জ্যাম যেমন আছে, আরও আছে আতঙ্ক পদে-পদে, মানুষের প্রতি মানুষের বিশ্বাস, এই শহরে কেউই নিরাপদ নয়, সবাই নিজেকে নিয়ে ছুটছে, একটা শঙ্কা তাড়া করে ফিরছে কিন্তু তারপরও কেউই বলতে পারছে না কিসে শান্তি আর কিসে বা পরিত্রাণ, একটা জিজ্ঞাসা সবারই মুখে কিন্তু সেই প্রশ্নটাই কারও মুখে আসছে না, অর্থাৎ অস্থিরতা বিরাজমান। শহরের চাকচিক্য ফেলে দিয়ে আবার জঙ্গলে যেতে ইচ্ছে করে। কারণ জঙ্গল আর শহরের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই আর, সবই কেমন সমান হয়ে গেছে, মানুষ বদলে গেছে, কে মানুষ আর কে বা বনমানুষ বোধগম্য নয় এখন।
জয় বাংলা কোন সেøাগান নয়, এটা যে একটা বুলেট এবং পশ্চিম পাকিস্তানীরা সহ্য করতে পারত না, কারণ তাদের বুক ভেদ করে ছিন্নভিন্ন হয়ে যেত ‘জয় বাংলা’, বাঙালী চিরকালই শান্তিপ্রিয় জাতি, তারা অনেকটা নদীর মতো, কখনো জোয়ারে সে মুক্ত উন্মাদ আবার সে ভাটিতে স্বজনহারা-দিকবিহবল, ‘ময়না কেন কয় না কথা’ গল্পে গাল্পিক প্রতীকস্বরূপ একটা ময়নাকে দাঁড় করালেও বাঙালীর চিত্ররূপ বেশ ভালভাবে ফুটে উঠেছে। বাঙালী চিরকালই অর্ধমৃত জাতি, সে না পারে হাসতে আর না পারে কাঁদতে, আসলে সে হাসি-কান্নাকে গুলিয়ে ফেলেছে একই সুঁতোয়,
একটা ময়না যখন জয়বাংলা সেøাগান দেয় তখন দালাল সোলেমান ভাবে নিশ্চয় কোন মুক্তিযোদ্ধার কাজ, তাই সে সংবাদ জানাতে পাক-আর্মির কাছে যায়, মেজর জানজুয়ার আদেশে একদল সশস্ত্র সিপাই ছুটে আসে, কিন্তু যখন দেখে একটা ময়না তার শেখানো বুলি আওড়িয়ে যাচ্ছে তখন সেটাকে সঙ্গে নিয়ে যায়, কিন্তু ময়না সেখানেও ‘জয় বাংলা’ সেøাগান দিয়ে বাতাস ভারি করে তোলে, বাঙালী যে স্বাধীনতার জন্য আপন প্রাণ বলি দিতে কুণ্ঠাবোধ করেনি তা ওই একটা প্রতীকের মধ্য দিয়ে গাল্পিক বোঝাতে চেয়েছেন, ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়ার পরও ময়না কিন্তু তার সেøাগান থেকে এতটুকু পিছপা হয়নি, তার জন্য তাকে পিচকারি দিয়ে পানি দেয়া হলেও কখনো তাকে বিরত করতে পারেনি, গল্পে যে প্রতীকের আশ্রয় নেয়া হয়েছে তা আসলে পাঠকের বোধের দুয়ারে আঘাত দেয় বৈ কি! আবু ইসহাক পুরানো একটা স্মৃতি বারংবার খুঁটিয়ে তুলে আমাদের বিবেককে নাড়া দিয়েছেন।
‘উত্তরণ’ গল্পে একজন দুধওয়ালার প্রতারণার কাহিনী বর্ণিত হয়েছে, রুস্তমের গাই-বাছুর কিছু না থাকা সত্ত্বেও সে গোয়ালা হয়ে হিন্দুদের বাড়ি দুধ দেয় ভিন্ন প্রতারণা রপ্ত করে, কিন্তু একটা সময়ে তার বিবেকদ্বার উন্মুক্ত হয়, সে তখন নিজের শিশুটির কথা চিন্তা করে পরের শিশুর প্রতি তার যে এই অসদাচরণ, সেখান থেকে সে শুধরে যায়, মানবশিশুর কান্না তার বুকের মধ্যে বাসা বাঁধে অন্য মাত্রা পেয়ে। গাল্পিক এখানে সাদা-কালো রঙের মতো মানুষের রূপের বর্ণনা করেছেন, যার ভেতর দিয়ে পাঠক নিজেকে চিনতে পারবে সহজে। প্রকৃত ঘটনা হলো রুস্তমের গাই-বাছুর ছিল, কিন্তু কে বা কারা তার গাই-বাছুর চুরি করে, তারপর থেকে সে ভাবে সীমান্তের ওপারের মানুষরাই তার সম্পদ চুরি করেছে এবং এই কারণে হিন্দুদের প্রতি তার এই বিদ্বেষ।
‘গণৎকার’ গল্পে দেখা যায়, মানুষের সরল বিশ্বাসকে কাজে লাগিয়ে একশ্রেণীর মানুষ ফায়দা লুটছে, দুটো পয়সা হাতিয়ে নেয়ার যে এই হীন কৌশল ধরা পড়ে, যখন ইলিয়াস গণকঠাকুরকে বলে, শসার ভেতরে কতগুলো দানা আছে, যেহেতু গণক বলেছে, পুকুরে কতগুলো রুই-কাতলা আছে, কে কতদিন বাঁচবে, কার পেটে কতগুলো কৃমি আছে এমনকি পরীক্ষায় ফার্স্ট হতে পারবে কিনা, ফাঁড়া আছে কি না, তো শসার ভেতর কত দানা আছে, গণকঠাকুর তারপর কোন কথা না বলে তার ঝোলা থেকে একটা ঘটি বের করে পশ্চিমদিকের বাঁশবাগানের দিকে চলে যায়, আর ফিরে আসেনি। মানুষকে এভাবেই ধোঁকা দিয়ে কোনদিন কেউ বড় হতে পারে না, কামিয়াব হতেও পারে না, পদে-পদে তার বিপদ ঘনীভূত হয়, সেই ইঙ্গিত গল্পে স্পষ্ট দেখা যায়।
একগাছের ছাল যেমন অন্য গাছে লাগে না, বিভেদ একটা থেকেই যায়, তেমনি প্রকৃতিতেও একটা বিভাজন লক্ষ করা যায়। ‘আলামত’ গল্পে এভাবেই গল্পকার বলতে চাইছেন দু’অঞ্চলের শিমগাছের বীজ যেহেতু তাই তারা একে অপরের বন্ধু হতে পারে না, ইলিয়াস যেমন অনেক আগে থেকেই বুঝেছিল বারো শ’ মাইলের একটা দেশের দূরত্ব কোনভাবেই এক থাকবে না ভবিষতে এবং তা ঘটে যায় একাত্তরে স্বাধীনতা যুদ্ধের মধ্যদিয়ে। গল্পের ভেতর একটা বাস্তব উপলব্ধি ফুটে উঠেছে চরমভাবে।
‘মহাপতঙ্গ’ সমকালীন জীবনসমস্যার একটা আলোচিত গল্প, পৃথিবীর মানুষ তার সর্বময় বুদ্ধি প্রয়োগ করে সৃষ্টি করছে বিভিন্ন প্রযুক্তি, কিন্তু সেই মানুষই আবার তার বুদ্ধি খরচা করে সেই সৃষ্টিকে ধ্বংস করছে, প্রতিনিয়ত সেই বুদ্ধির প্রতিযোগিতা চলছে বিশ্বব্যাপী। ভয়াবহ যুদ্ধ কিভাবে মানবসভ্যতাকে নিমিষে ধ্বংস করে তা একটি চড়ুই দম্পতির কাহিনীর মধ্য দিয়ে বোঝাতে চেয়েছেন গাল্পিক। বিজ্ঞান যেমন আমাদের অনেক এগিয়ে নিয়ে গেছে আবার এই যুদ্ধবিমান-যুদ্ধের সমরাস্ত্র তৈরি করাও শিখিয়েছে, ফলে মানুষ বড় বেশি শঙ্কায় আছে, কেউই আর সুখে নেই, মানুষের নিজের প্রয়োজনে যেমন বিজ্ঞানকে বুকে টেনে নিয়েছে তেমনি আবার যুদ্ধের মতো খেলাতে মেতেছে মানুষ।
মানুষের জীবন প্রক্রিয়াটা চলমান থাকে আর্থিক সঙ্গতির ওপর, হানিফ নামক একজন মানুষ, সে ইচ্ছে করলেই অনেক কিছুই পারে না, কারণ মানুষ একটা অবলম্বনের ওপর দাঁড়িয়ে, ম্যাট্রিক পাস সামান্য একজন ছাপোষা পঁয়ত্রিশ টাকার কেরানি, তার আগে ছিল পাঁচ বছর বিশ টাকা বেতনের প্রাইমারী স্কুলের মাস্টার, গ্রামীণ অশিক্ষিত মেয়ে করিমন তার স্ত্রী। একদিন ঢাকায় আনে নর্দমার পাশে নাজিরা বাজারের এক ঘুপচি গলির শেষে কোচোয়ানী কুঁড়েঘরে, দশ টাকা ভাড়ায়। ছেলে-মেয়ে অতিকষ্টে দিনযাপন করলেও নৈতিকতা আর মূল্যবোধকে গলা টিপে মেরে ফেলে, গ্রামে বুড়ো বাবা-মাকে মাসে পনেরো টাকা পাঠাতো সেটাকে বন্ধ করে দেয়, নিজের ছেলে-মেয়েদের জন্য ভাতের ফেন খাওয়ানো শুরু করে, বউ তার খুবই লক্ষ্মী, কোন বাদ-প্রতিবাদ জানে না, জীবন যেন বা একেই বলে, স্বামীভক্তি তার ভেতর এতোটাই গাঢ় যে জীবন-জগতের সব কিছুর ওপরে স্বামী বেচারাকে স্থান দিয়ে বসে আছে, স্বামী শক্তি, স্বামী ভক্তি, স্বামী সুখ, গল্পে যে সহজ-সরল মানুষের জীবন উপলব্ধি করি, সেখানে একটা শ্রেণীর কথা যেমন এসেছে তেমনি শ্রেণী বৈষম্যটাকেও গাল্পিক দেখাতে চেয়েছেন ‘ঘুপচি গলির সুখ’ গল্পে, যা হয়তো সেভাবে উচ্চারিত হয়নি কিন্তু কোথায় একটা বিষাদের সুর বেজে ওঠে আপন খেয়ালে। একই দেশ অথচ কত বৈষম্য, মানুষে-মানুষে এই বিভাজন এই অসঙ্গতি, সবটাই আমাদের জীবনকে পীড়িত করে, কতোটা ব্যথিত তার একটা আলোকোজ্জ্বল উপস্থিতি পে-কমিশন-এর সুপারিশে বিশ টাকা মাইনে বেড়েছে এবং আরও একটা খুশির খবর সংসারে ভাগীদার আরও দুটো এসেছে।
একজন পুলিশের লোক ইলিয়াস, তাকে ঠকিয়েছে দুজন মহিলা ঘি-বিক্রেতা, ভালো ঘিয়ের নাম করে ইলিয়াসকে পোড়া মবিল দিয়ে গেছে, ‘ঠগিনী’ গল্পে আবু ইসহাক ঘি বিক্রেতাকে নিয়ে যে গল্প সাজিয়েছেন তা আসলে আমাদের বিবেকেরই অর্ধপতন। প্রথমে তাকে দেখিয়েছে খাঁটি ঘি এবং তিনি পরখও করেছেন ভাল ঘি, কিন্তু ওরা সবটা ঘি নামক তরল পদার্থ ঢেলে দেয় পাত্রে, তারপর পাঁচ সের, তিন সের এবং সর্বোপরি দুই সের, এভাবে তিন-তিন বার তার পাত্র থেকে ঢেলে সেই ঘিটুকু ওরা ওদের কলসিতে ফেরত নিয়ে নেয়, কারণ মবিল অপেক্ষা ঘি হালকা, নিচে যেটুকু অবশিষ্ট ছিল তা আসলে ঘি নয়, পোড়া মবিল। ঠগ প্রৌঢ়া মেয়ে দুজন আর কোনদিন ফিরে না এলেও ইলিয়াস কোনদিন ভুলতে পারে না ওদের। মানুষের ভেতরে মানুষ যেমন থাকে আবার এই মানুষেরই মধ্যে থাকে দুষ্টপ্রকৃতির অসৎ মানুষ, দুটো চেনা কঠিন, কারণ সবাই যে মানুষ।
সামন্তশ্রেণী চিরদিনই নিচতলার মানুষদের শোষণ করেছে, এরা সেই ‘জোঁক’-এর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে গল্পে, গ্রামীণ এ গল্পে সাধারণ মানুষের প্রতি আবু ইসহাকের যে সহানুভূতি তারই একটা আলোকচিত্র ধরা পড়েছে, জীবন যুদ্ধের সৈনিক যারা তাদের সংবাদ কে বা রাখে, এতো পরিশ্রমের ফসল কিন্তু সেখানে তার অধিকার কতটুকু, অর্ধেক চলে যায় মহাজনের পকেটে, সাধারণ মানুষকে এই যে অন্ধকার তিমিরে রেখে শহরের বাবু-সাহেবরা নতুন কৌশলে তে-ভাগা আইনের ফতোয়া দেয়, ওয়াজেদ চৌধুরীর ছেলে ইউসুফ ভাগচাষীদের কাছ থেকে হেনতেন একটা উপায় বের করে তিনভাগের দু’ভাগ ছিনিয়ে নিয়ে যাওয়ার যে ফন্দি করেছে, তাকেই আবু ইসহাক জোঁক বলেছে, পাট ভেজানোর পচা পানিতে জোঁক থাকে ঠিকই, কিন্তু সে জোঁক মানুষের যত না ক্ষতি করে তার চেয়ে ঢের বিনাশ সাধন করতে তৎপর ওই মানুষরূপী জানোয়ারগুলো, গল্পে যে জীবনের বর্ণনা দেখতে পায়, তা আসলে বাংলাদেশের আবহমান কালের বাংলা, এখানে প্রতিনিয়ত মানুষ পরিশ্রম করে যাকে বলে হাড়ভাঙা পরিশ্রম, কিন্তু ললাটে অবশিষ্ট কিছুই থাকে না। উচ্ছিষ্ট খাদ্যেই তাকে বছরের পর বছর সন্তুষ্ট থাকতে হয়, যেন বা বিধির এই লিখন কে খ-াতে পারে। একজন সাহিত্যিকের কলম যে জনগণের কথা বলে, ‘জোঁক’ গল্পে গাল্পিক আবু ইসহাক সে কথাই আবার স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, এ গল্পের ভেতর দিয়ে দেখা যায় মানুষ প্রকৃতপক্ষে দু’ভাগে বিভক্ত, কেউ শোষণ করে আর কেউ বা শোষিত হয়, আর যে শোষিত হয় চিরকাল ধরেই শোষিত হতে থাকে।
আবু ইসহাকের ছোটগল্পের কাহিনী বা আখ্যান সর্বদা জটিলতা মুক্ত, পাঠককে হাত দিয়ে তার সমস্যার দিকে ইঙ্গিত করিয়ে দেয়, কাহিনীকে অকারণে দীর্ঘ করে পাঠকের ধর্য্যচ্যুতি ঘটান না কখনও, যেটুকু বোঝানোর সেটুকুই বুঝিয়ে দেয়। ভাষায় সারল্য লক্ষ করা যায় সর্বত্র, কাব্যময়তাকে পরিহার করেন, প্রতীকধর্মী গল্পে বর্তমান বিষয়বস্তু বা প্রেক্ষাপট সংযোজিত হয়, চারপাশের জীবনঘনিষ্ঠ চরিত্রগুলো গল্পের বিষয়বিন্যাসে ধরা দেয়, সাধারণ মানুষের জীবনে যন্ত্রণার প্রতিচ্ছবি দেখা যায় গল্পে, আর তাই তো আবু ইসহাকের গল্প পাঠক হৃদয়কে মথিত করে আকর্ষণ করে প্রতিনিয়ত, হয়তো এ কারণে তিনি সকল শ্রেণীর পাঠকের সাহিত্যিক, গ্রাম-নগর যেমন বিষয়ে এসেছে, এসেছে মহানগরের নানাবিধ সমস্যা, যে সমস্যার ভেতর জীবন আটকে থাকে পরিত্রাণের কোন দিকনির্দেশনা পায় না।
শীর্ষ সংবাদ: