ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সৈয়দ ঋয়াদ

যে প্রতিবাদ দেখেনি বিশ্ব

প্রকাশিত: ০৬:০১, ৩০ অক্টোবর ২০১৫

যে প্রতিবাদ  দেখেনি বিশ্ব

পৃথিবীর যে কোন বিপ্লব বা গণআন্দোলনে পুরুষের সমান্তরালে দাঁড়িয়েছেন নারী। আবার কখনও বা কোন কোন ইতিহাস শুধু তাদের হাতেই সূচনা হয়েছে। এমন বিপ্লবী নারীর সংখ্যা নিছকই কম নয়। এইত আমাদের দেশের প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার কথাই ধরুন না। এই বিপ্লবী নারীর কথা তো এদেশের কারও অজানা নয়। সত্যিকার অর্থে প্রীতিলতারা হারিয়ে যান না কালের গহ্বরে। তারা যুগে যুগে ফিরে আসেন। ফিরে আসেন নতুন বেশে, আর বেঁচে থাকেন মানুষের হৃদয়ে। আসলে এসব কথা বলার পেছনে একটা বড় কারণও আছে। চলতি বছরের অক্টোবরের শুরুতে ভারতে একটি বড় নীরব প্রতিবাদ হয়ে গেছে। আর এই নীরব প্রতিবাদটি কড়া নেড়ে গেছে সব বিবেকবান মানুষের হৃদয়ে। যে আন্দোলনটি বিশ্ববাসীকেও অবাক করেছে। আসলে এমন একটি প্রতিবাদ প্রথমবারই দেখেছে সবাই। একই সঙ্গে এত লেখকের সম্মাননা ফেরত দেয়ার মতো ঘটনা পৃথিবীতে এটিই প্রথম। সার্বিকভাবে ভারতের অসহিষ্ণুতা বেড়ে যাওয়া, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর বর্বরোচিত হামলা ও একের পর এক যুক্তিবাদী লেখক হত্যার প্রতিবাদে ৪১ লেখক তাদের সম্মাননা ফেরত পাঠান। আর মানবিক এই আন্দোলনের শুরু থেকেই ছিলেন নারী লেখকরা। মূলত এই আন্দোলনের নেতৃত্বেই ছিলেন তারা। সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার জয়ী যুক্তিবাদী লেখক এম এম কুলবর্গী গত ৩০ আগস্ট নিজের বাড়ির কাছে খুন হন। এর আগে খুন হয়েছেন যুক্তিবাদী লেখক নরেন্দ্র দাভোলকর ও গোবিন্দ পানসার। গরুর মাংস খাওয়ার অপরাধে খুন হন ইখলাক। লেখকদের অনেকেই সার্বিকভাবে ভারত অসহিষ্ণু হওয়ার পেছনে বিজেপির দিকেই আঙুল তুলছেন। তাদের মতে, বিজেপি সরকার ভারতের ক্ষমতায় আসার পর থেকে বিভিন্ন রাজ্যে সংখ্যালঘু ধর্মীয় সম্প্রদায় ও যুক্তিবাদী লেখকদের বিভিন্নভাবে কোণঠাসা করে রেখেছে। সাধারণ মানুষসহ একের পর এক যুক্তিবাদী ও প্রগতিশীল লেখকদের হত্যা, সাহিত্য একাডেমির এ বিষয়ে উদাসীনতা ও প্রতিবাদ না করায় লেখকরা সাহিত্য একাডেমিতে তাদের এসব সম্মাননা ফেরত পাঠিয়েছেন। পাঁচ-ছয়দিনে এই প্রতিবাদে একাত্মতা জানিয়ে ৪১ লেখক তাদের সম্মাননা ফেরত পাঠিয়েছিলেন। লেখক ও সাহিত্যিকদের বাক-স্বাধীনতার ওপর আক্রমণ সত্ত্বেও সাহিত্য একাডেমি এ বিষয়ে কোন প্রতিবাদ না করায় লেখকরা সরকারী ও বেসরকারীভাবে পাওয়া সম্মাননা ফেরত পাঠানোর মাধ্যমে তাদের প্রতিবাদ জানান। সম্মাননা ফেরতের মধ্য দিয়ে লেখকরা প্রতিবাদের এক নতুন ভাষার জন্ম দিয়েছে। আর বৃহৎ এই আন্দোলনকে নারী লেখকরাই এগিয়ে নিয়ে গেছেন। যদিও এর জন্য তাদের ওপর দিয়ে অনেক হুমকি ধমকি গেছে। তা সত্ত্বেও এই নারীরা আন্দোলন থেকে পিছিয়ে যাননি। সাহিত্য একাডেমির এ ধরনের অন্ধ আচরণে বিস্মিত হয়েছেন বিশিষ্ট লেখক জওহরলাল নেহরুর ভাগনি নয়নতারা সায়গল। সাহিত্য একাডেমি পুরস্কারের সঙ্গে এর সমমূল্যের অর্থ এক লাখ রুপীও ফেরত পাঠান নয়নতারা। তিনি আরও বলেন, ‘সহিংসতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ভাষা হিসেবেই আমরা আমাদের সম্মাননা সাহিত্য একাডেমিতে ফেরত দিয়েছি।’ তার মতে, যে কোন শাসন ব্যবস্থায় একজন নাগরিকের প্রতিবাদ করার অধিকার থাকা উচিত। কোন কোন ক্ষেত্রে কিন্তু নাগরিকের সে অধিকার হরণও করা হয়। তবে প্রতিবাদীরা কোন না কোনভাবে তার প্রতিবাদ করার প্রয়াস ঠিকই পান। পাঞ্জাবি কবি দিলীপ কৌর তিওয়ানা সরকারের ব্যর্থতা ও অসহিষ্ণুতার প্রতিবাদে তার পদ্মশ্রী খেতাবটি ফেরত পাঠান। তিওয়ানা সংবাদমাধ্যমে সরকারের ব্যর্থতার কঠোর সমালোচনা করে বলেন, ‘এখন যা হচ্ছে তা মানবজাতির ইতিহাসের জন্য দুঃখজনক, একই সঙ্গে লজ্জারও।’ এই প্রতিবাদের সঙ্গে আরেক নারী লেখক একাত্মতা ঘোষণা করেন। তিনি পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার জয়ী কবি মন্দাক্রান্তা সেন। তরুণ মন্দাক্রান্তারা মানবিক আন্দোলনের জন্য যে সাহসিকতা দেখিয়েছেন তা অনেকাংশেই ভারতীয় পুরুষ লেখকরা দেখাতে পারেননি। কলকাতার শীর্ষ লেখকদের মধ্যে কেবল মন্দাক্রান্তা একাই যোগ দিয়েছেন এই প্রতিবাদে। শীর্ষেন্দু, সমরেশের মতো লেখকরা যে সাহসিকতা দেখাতে ব্যর্থ হয়েছেন ঠিক সেই কাজটাই করেছেন এই নারী লেখক। পৃথিবীর প্রভাবশালী অনেক সংগঠন তাদের এই মানবিক প্রতিবাদের জন্য সাধুবাদও জানিয়েছে। বৃহৎ ভারত যে বহুজাতির রাষ্ট্র এই মূলমন্ত্র থেকে সরে এসে হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্র কায়েম করতে চাইছে। তাও খোলামেলাভাবে সমালোচনা করেছেন নারী লেখকরা। ভারতের একই সঙ্গে বিপুল সংখ্যক নারী লেখকদের এই আন্দোলন অনেক সুশীল সমাজের নাগরিকদের নীরব থাকার ভূমিকাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। অনেকের কাছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে তাদের প্রতিবাদের এই অভিনব ভাষাও দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। বরং পৃথিবীর যে কোন সচেতন নাগরিকের কাছেই ভারতীয় নারী লেখকরা তাদের এই প্রতিবাদের জন্য অনুকরণীয় হয়ে থাকবেন। নারী লেখকদের প্রতিবাদী আন্দোলনে যোগ দেয়ার পর থেকে নানাভাবে ভয় দেখানোর পরও আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছিলেন তারা। বরং আঙুল তুলে সরকার প্রধানকে সাবধান করে দিতে পিছপা হচ্ছেন না এই লেখকরা। আমাদের ইতিহাসও তার ব্যতিক্রম নয়। বরং আমাদেরটা শুরু হয়েছে অনেক আগে থেকেই। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে প্রীতিলতা আর ’৭১ এর বীরাঙ্গনা থেকে শুরু করে দেশের সব বড় আন্দোলনেই ছিলেন নারী শক্তি। আর ভারতীয় নারী লেখকদের এই প্রতিবাদ তো আমাদের এই শিক্ষাই দেয় যে, যে কোন বিপ্লব ও সংগ্রামে নারীদের ভূমিকাও তুচ্ছ নয়। আসলে ভারতীয় নারী লেখকদের এই প্রতিবাদের আরেকটি বড় বিষয় ছিল মানবিক মূল্যবোধ। নারী কিংবা পুরুষ সবার ভেতরে মানবীয় মূল্যবোধের সৃষ্টি। আর পরিচয় সবার একটাই, সেটি হলো মানুষ। বৃহৎ এই আন্দোলনে নারীদের সম্পৃক্ততা আগামী পৃথিবীর জন্য সুখবরই বটে। একটি দেশ বা জাতি-গোষ্ঠীর সার্বিক উন্নয়নের অনেকটাই নির্ভর করে নারীদের ওপর। যে জাতি নারীদের যত সহজে বুঝতে পেরেছে সে জাতিই ইতিহাসে নিজেদের স্থান করে নিয়েছে। দুর্ভাগা ভারতবাসী বুঝতে না পারলেও নয়নতারা সায়গল, দিলীপ কৌর তিওয়ানা, সারা জোসেফ ও মন্দাক্রান্তা সেনরা হয়ত সেটা বুঝতে পেরেছেন এবং শতভাগই প্রমাণ করতে পেরেছেন।
×