ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বেসরকারী মেডিক্যালে অতিরিক্ত ফি আদায়

ব্যয় মেটাতে না পেরে ভর্তি হতে পারবে না অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী

প্রকাশিত: ০৫:১৬, ৩০ অক্টোবর ২০১৫

ব্যয় মেটাতে না পেরে ভর্তি হতে পারবে না অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী

নিখিল মানখিন ॥ মেধা স্কোরে এগিয়ে থেকেও বেসরকারী মেডিক্যাল কলেজের উচ্চশিক্ষা ব্যয় মেটাতে না পেরে মেডিক্যালে পড়তে পারবেন না অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী। সরকার নির্ধারিত ফি অনুযায়ী একজন শিক্ষার্থীর এমবিবিএস ডিগ্রী সম্পন্ন করাতে সর্বোচ্চ মোট ১৯ লাখ ৯০ হাজার টাকা নিতে পারবে বেসরকারী মেডিক্যাল কলেজ। গত বছরের অভিজ্ঞতায় অনেক কলেজ কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীপ্রতি ২৫ থেকে ৩০ লাখ টাকা নেয়ার অভিযোগও রয়েছে। ভর্তি পরীক্ষায় ন্যূনতম পাস নম্বর পেয়েও মেডিক্যাল ও ডেন্টাল কলেজে পড়তে পারবেন না প্রায় সাড়ে সাঁত্রিশ হাজার শিক্ষার্থী। এবার পরীক্ষার্থীদের মোট সংখ্যার ৫৮ দশমিক ৪ শতাংশ উত্তীর্ণ হয়েছে। এতে ভর্তির যোগ্য শিক্ষার্থী পাওয়া গেছে ৪৮ হাজার ৪৪৮। সরকারী ও বেসরকারী কলেজে বিদ্যমান আসনসংখ্যা অনুযায়ী ভর্তি হওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন ১১ হাজার ৪৯ শিক্ষার্থী। স্বাস্থ্য অধিদফতর জানায়, আগামীকাল ৩১ অক্টোবর থেকে শুরু হচ্ছে বেসরকারী মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি কার্যক্রম। ভর্তির আবেদন ফরম ১৮ থেকে ২৭ অক্টোবর পর্যন্ত বিতরণ করা হয়েছে। ৩০ অক্টোবরের মধ্যে আবেদনপত্র যাচাই-বাছাই সাপেক্ষে ভর্তি তালিকা প্রকাশ করা হবে। ৩১ অক্টোবর থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত চলবে ভর্তি প্রক্রিয়া। সরকারী মেডিক্যাল কলেজের ভর্তি কার্যক্রম ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে গত ১৭ অক্টোবর। গত ১৮ অক্টোবর সকাল দশটা থেকে এগারোটা পর্যন্ত সারাদেশে ৪৪ কেন্দ্রে এই সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা চলে। গত ২০ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত হয় মেডিক্যাল ও ডেন্টাল কলেজগুলোর সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার ফল। ৮২ হাজার ৯৬৪ পরীক্ষার্থীর মধ্যে উত্তীর্ণ ঘোষণা করা হয়েছে ৪৮ হাজার ৪৪৮ জনকে। সরকারী মেডিক্যাল কলেজে আসনসংখ্যা ৩ হাজার ১৬২, সরকারী ডেন্টালে ৫৩২। বেসরকারী মেডিক্যাল কলেজে ৬ হাজার ও বেসরকারী ডেন্টালে ১ হাজার ৩৫৫ আসন রয়েছে। সরকার নির্ধারিত ফি ॥ দীর্ঘ সমালোচনা ও আলোচনার পর গত বছর বেসরকারী মেডিক্যাল কলেজগুলোতে ভর্তি ফি নির্ধারণ করে দেয় সরকার। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে একটি প্রজ্ঞাপনও জারি করে। বেসরকারী মেডিক্যাল ও ডেন্টাল কলেজগুলোর নিজেদের ইচ্ছামতো বাড়তি অর্থগ্রহণ ঠেকাতেই এ উদ্যোগ নেয়া হয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের জারিকৃত ওই প্রজ্ঞাপনে জানা যায়, বেসরকারী মেডিক্যাল কলেজগুলো ভর্তি ফি বাবদ ১৩ লাখ ৯০ হাজার টাকা নিতে পারবে। ইন্টার্ন ফি নির্ধারণ করা হয়েছে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা। এ ছাড়া পাঁচ বছরে মোট টিউশন ফি বাবদ ৪ লাখ ৮০ হাজার টাকার বেশি গ্রহণ করতে পারবে না। সরকারের পক্ষ থেকে ফি নির্ধারণ করে দেয়ার ফলে বেসরকারী মেডিক্যাল কলেজ থেকে প্রতি শিক্ষার্থীর এমবিবিএস ডিগ্রী সম্পন্ন করতে মোট খরচ হবে ১৯ লাখ ৯০ হাজার টাকা। তবে ইন্টার্ন ফি বাবদ কলেজ কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীর কাছ থেকে যে টাকা গ্রহণ করবে পরবর্তীতে ইন্টার্নশিপ করার সময় তার লভ্যাংশসহ ফেরত দেবে অথচ সরকারী মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি ফি মাত্র ১২ হাজার টাকা (তিন মাসের টিউশন ফিসহ)। নির্ধারিত ফির দ্বিগুণ খরচ ॥ এইচএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হওয়ার পর প্রতিবছরের মতো এবারও ভর্তি ফির বিষয়টি আলোচনায় চলে এসেছে। গত বছর প্রত্যেক শিক্ষার্থীর কাছ থেকে শুধু ভর্তি ফি ১৪ লাখ ২০ লাখ টাকা নেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। আর প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর অনেক কলেজে ভর্তির সুযোগ পেতে অনানুষ্ঠানিকভাবে অনেক শিক্ষার্থীকে দিতে হয়েছে বাড়তি টাকা। যা কাগজে-কলমে লেখা থাকে না। প্রথম শ্রেণীর মেডিক্যাল কলেজগুলোতে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেতে অনেক শিক্ষার্থীকে গোপনে মোটা অঙ্কের টাকা দেয়ার অভিযোগও পাওয়া গেছে। ভর্তি পরীক্ষার পাশাপাশি ভর্তি ফি নিয়ে এবারও আতঙ্ক প্রকাশ করেছেন অনেক মেডিক্যাল ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবক। এ বিষয়ে বিএমএ’র সাবেক সভাপতি এবং ডক্টরস ফর হেলথ এ্যান্ড এনভায়রনমেন্টের সভাপতি রশিদী-ই মাহবুব। তিনি জনকণ্ঠকে জানান, সদিচ্ছা থাকলেই সহনশীল ভর্তি ফি নির্ধারণ করতে পারে সরকার। যত তাড়াতাড়ি বৈষম্য দূরীকরণে সরকারী হস্তক্ষেপ দরকার। আলোচনার মাধ্যমে এ বিষয়টি সুরাহা হতে পারে বলে মনে করেন তিনি। বাংলাদেশে এখনও ভর্তি ফি কম নেয়া হয় বলে দাবি করেছেন বাংলাদেশ প্রাইভেট মেডিক্যাল প্র্যাকটিশনারস এ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব ডাঃ জামাল উদ্দিন চৌধুরী। তিনি বলেন, মেডিক্যাল কলেজ পরিচালনা করা কোনভাবেই লাভজনক নয় বলে এ সেক্টরে বড় বড় ব্যবসায়ীর মুখ দেখা যায় না। জনকল্যাণমূলক উদ্দেশ্যেই মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হয়ে থাকে। তাই ব্যবসায়িক কারণে নয়, প্রতিষ্ঠানগুলোকে টিকিয়ে রাখার জন্যই তা করতে হয়। প্রতিষ্ঠান চালানোর চাহিদা ছাড়া শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে কোন বাড়তি টাকা নেয়া হয় না বলে জানিয়েছেন বেসরকারী কলেজের কর্তৃপক্ষরা। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে ভর্তি ফি হিসেবে ৩০ থেকে ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত নেয়া হয়ে থাকে বলে জানান মহাসচিব ডাঃ জামাল উদ্দিন চৌধুরী। তাঁর সঙ্গে তাল মিলিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক প্রাণ গোপাল দত্ত জানান, একটি মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা করা খুবই ব্যয়বহুল। ভারতে প্রথম শ্রেণীর কয়েকটি কলেজে ভর্তি ফি হিসেবে শিক্ষার্থীপ্রতি এক কোটি টাকাও নেয়া হয়ে থাকে বলে তিনি দাবি করেন। অনেক মেডিক্যাল কলেজে শিক্ষাদানের স্থায়ী ও পর্যাপ্ত অবকাঠামো নেই ॥ এদিকে অভিযোগ উঠেছে, বেসরকারী মেডিক্যাল ও ডেন্টাল কলেজগুলো সরকারী নিয়ন্ত্রণে নেই। অধিকাংশ কলেজ নিজেদের তৈরি নিয়মে চলছে। বেসরকারী মেডিক্যাল ও ডেন্টাল কলেজ স্থাপন ও পরিচালনা আইন ২০১৩ নামের একটি আইনের খসড়া প্রস্তুত করে রেখেছে সরকার। খসড়া আইনটি চূড়ান্তলাভ ও কার্যকর শুরু হলে বিদ্যমান বেসরকারী মেডিক্যাল কলেজগুলোর অধিকাংশই প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। মেডিক্যাল শিক্ষার বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা বলেন, কিছুসংখ্যক বেসরকারী মেডিক্যাল কলেজের কারণে পুরো চিকিৎসা সেক্টর প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন বাংলাদেশ মেডিক্যাল এ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সভাপতি অধ্যাপক মাহমুদ হাসান। তিনি জনকণ্ঠকে জানান, বিভিন্ন কারণে পর্যাপ্ত দক্ষ চিকিৎসক তৈরি হচ্ছে না। অনেক বেসরকারী কলেজে শিক্ষক, মেডিক্যাল উপকরণ ও রোগীর সঙ্কট রয়েছে। কিছুসংখ্যক মেডিক্যাল কলেজে হাসপাতাল পর্যন্ত নেই। হাসপাতাল, রোগী ও পর্যাপ্ত মেডিক্যাল উপকরণ না থাকায় শিক্ষার্থীরা প্র্যাকটিক্যাল দিক দিয়ে পিছিয়ে পড়ে। নতুন মেডিক্যাল কলেজ স্থাপনের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। আর শিক্ষকদের যোগ্যতা ভালভাবে মনিটরিং করা হয় না। বাংলাদেশ মেডিক্যাল এ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) সভাপতি অধ্যাপক এএসএম আহমেদ আমীন সাংবাদিকদের জানান, মেধাবী শিক্ষার্থীদের সুযোগ পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। মেধা মূল্যায়িত হবে এমন ন্যূনতম নম্বর নির্ধারণ করা দরকার। অনেক কলেজে পুরনো দিনের পাঠ্যপুস্তক দিয়ে আগামী দিনের ডাক্তারদের পড়ানো হয়। কিন্তু মেডিক্যাল প্রযুক্তি প্রতিনিয়তই পরিবর্তন হচ্ছে। এক্ষেত্রে শিক্ষকদের যোগ্যতা নিশ্চিত করার ওপরও গুরুত্বারোপ করেন অধ্যাপক এএসএম আহমেদ আমীন।
×