ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সব হামলার পেছনেই লন্ডন ষড়যন্ত্র

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ২৯ অক্টোবর ২০১৫

সব হামলার পেছনেই লন্ডন ষড়যন্ত্র

শংকর কুমার দে ॥ দুই বিদেশী হত্যাকা-ের ঘটনার নির্দেশদাতা দেশীয় বড় ভাইয়ের সীমানা অতিক্রম করে এখন আন্তর্জাতিক বড় ভাইয়ের দিকে সন্দেহের তীর। শুধু দুই বিদেশী হত্যাকা-ই নয়, পুলিশের এএসআই হত্যাকা-, হোসেনী দালানে গ্রেনেড হামলাসহ সকল ঘটনার মূল উৎপত্তিস্থলের সন্দেহের তীর লন্ডন ষড়যন্ত্র। লন্ডন থেকে নির্দেশ আসে কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে, কেন্দ্রীয় নেতারা নির্দেশ দেন মধ্যম সারির নেতাদের, মধ্যম সারির নেতারা নির্দেশ দেন তার নিচের স্তরের নেতাদের, নিচের স্তরের নেতাদের নির্দেশে পেশাদার ভাড়াটিয়া খুনীদের নিয়োগ করে অন্তত চার থেকে পাঁচটি স্তর অতিক্রম করে দুই বিদেশী হত্যাকা-ের পরিকল্পনার বাস্তবায়ন ঘটানো হয়েছে। তদন্তের এই পর্যায়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বুধবার বলেছেন, নির্দেশদাতা হিসেবে বিএনপি নেতা কাইয়ুম কমিশনারকে বড় ভাই না বলে তাকে সন্দেহের তালিকায় রেখেছেন এবং সন্দেহের তালিকায় আরও রাজনীতিবিদ রয়েছেন। এর আগে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন, ইতালির নাগরিক তাভেলা হত্যাকা-ে শুধু ‘বড় ভাই’ আসল নয়, তার পেছনে যারা রয়েছেন তারা রাজনীতিবিদ, এটা দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র। এটা যে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র তা পরিষ্কার হয়েছে দুই বিদেশী হত্যাকা-ের বিষয়ে আবারও বুধবার আইএসের দায় স্বীকারের তথ্য সঠিক দাবি করে সরকারকে সত্যের মুখোমুখি হওয়ার পরামর্শ দিয়ে বিবৃতি দিয়েছে জঙ্গী তৎপরতা পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা সাইট ইন্টেলিজেন্স গ্রুপ। এতে দুই বিদেশী হত্যাকা-ের রহস্যের জট আরও ঘনীভূত হয়ে তদন্তের সীমানা দেশীয় গ-ি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ের দিকে অগ্রসর হচ্ছে এবং অনেক বড় ভাইয়ের বড় ভাই চাঁই হিসেবে তদন্তের জালে আটকা পড়ার ইঙ্গিত স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। তদন্তের সংশ্লিষ্ট পর্যায়ে এ ধরনের তথ্য পাওয়া গেছে। তদন্ত সূত্র জানায়, দুই বিদেশী নাগরিকের মধ্যে গুলশানের ইতালীয় নাগরিক সিজার তাভেলা হত্যাকা-ের নির্দেশদাতা হিসেবে বিএনপি নেতা কাইয়ুম কমিশনার তার ভাই আবদুল মতিন এবং রংপুরে জাপানী নাগরিক হোশি কুনিও হত্যাকা-ে বিএনপির আরেক নেতা স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি হাবিব উন নবী সোহেল ও তার ভাই রাশেদ উন নবী বিপ্লব সন্দেহের তালিকায় গোয়েন্দা নজরদারিতে আছেন। এর মধ্যে কাইয়ুম কমিশনারের ভাই আবদুল মতিন ইতালীয় নাগরিক হত্যাকা-ের পর পলাতক এবং রংপুরে জাপানী নাগরিক হত্যাকা-ের ঘটনায় হাবিব উন নবী সোহেলের ভাই রাশেদ উন নবী বিপ্লব গ্রেফতার হয়ে কারাগারে আটক আছে। এখন হাবিব উন নবী সোহেল ও কাইয়ুম কমিশনারকে গ্রেফতারের জন্য খোঁজা হচ্ছে। তদন্ত সূত্র জানায়, হাবিব উন নবী সোহেল ও কাইয়ুম কমিশনারের আরও এক ধাপ ওপরের কেন্দ্রীয় নেতা যাদের লন্ডন ও বিদেশী কানেকশন আছে তাদের মধ্যে অন্তত চার থেকে পাঁচজন বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের প্রতি নজরদারি করছে গোয়েন্দা সংস্থা। বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যে যাদের লন্ডন কানেকশন আছে তাদের গ্রেফতারের আগ পর্যাপ্ত সাক্ষ্য, প্রমাণ, আলামত সংগ্রহের ওপর জোর দেয়া হয়েছে। তবে লন্ডন ষড়যন্ত্রের কারণেই যে সরকারকে বেকায়দায় ফেলার জন্য দেশের মধ্যে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির চেষ্টার উদেশ্যে দুই বিদেশী হত্যাকা-সহ পুলিশ হত্যা, হোসেনী দালানে গ্রেনেড হামলার ঘটনা ঘটানো হয়েছে তা প্রায় নিশ্চিত মনে করছেন গোয়েন্দারা। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যা বলেছেন ॥ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলছেন, গুলশানে ইতালির নাগরিক সিজার তাভেলা খুনের ‘নির্দেশদাতা’ হিসেবে ঢাকার সাবেক কমিশনার এমএ কাইয়ুমের নাম সন্দেহের তালিকায় রেখেছেন তারা। তিনি বলেছেন, দুই বিদেশী হত্যার পেছনে রাজনীতিকরা। বুধবার সচিবালয়ে আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, হাসানুল হক ইনুসহ সাত মন্ত্রীর উপস্থিতিতে আইনশৃঙ্খলাসংক্রান্ত এক বৈঠকের পর এই কথা বলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তবে এর আগের দিন মঙ্গলবার রাতে একাত্তর টেলিভিশনকে বলেছিলেন, গুলশানে ইতালির নাগরিক সিজার তাভেলা খুনের ‘নির্দেশদাতা’ হিসেবে বড় ভাই ঢাকার সাবেক কমিশনার এমএ কাইয়ুম। বুধবার সচিবালয়ে বৈঠকের পর বিএনপি নেতা কাইয়ুমের নির্দেশেই এই হত্যাকা- সংঘটিত হয়েছে কিনা, প্রশ্ন করা হয়। তখন মন্ত্রী বলেন, হ্যাঁ এবং পুনরায় প্রশ্ন করা হলেও তিনি হুঁ’ বলেছিলেন, তারপর বলেন, এ ধরনের কথা হয়নি। তাকে (কাইয়ুম) ছাড়াও আরও অনেকজনকে সন্দেহ করেছি, তারাও সন্দেহের তালিকায় আছে। বিদেশী হত্যাকা-ে আর কেউ জড়িত কিনা, এ প্রশ্নে মঙ্গলবার রাতে মন্ত্রী আসাদুজ্জামান কামাল বলেন, ‘আমাদের তদন্ত চলছে। তদন্ত শেষে বাদ বাকি জানা যাবে বলে জানান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। ইতালীয় নাগরিক তাভেলা হত্যাকা-ে জড়িত অভিযোগে চারজনকে গ্রেফতারের পর সোমবার পুলিশ বলেছিল, এক ‘বড় ভাই’য়ের নির্দেশে তারা হত্যাকা- ঘটায়। পরদিন মঙ্গলবার সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন, এই হত্যাকা-ের পেছনে রাজনীতিবিদ রয়েছেন। তবে তখন কারও নাম বলেননি তিনি। রাতে কাইয়ুমের নাম বলেন। ঢাকায় তাভেলা খুনের পাঁচ দিনের মধ্যে এই মাসের শুরুতে রংপুরে জাপানী নাগরিক হোশি কুনিওকে একইভাবে গুলি চালিয়ে হত্যার পর জঙ্গী সংশ্লিষ্টতার দাবি উঠলেও তা প্রত্যাখ্যান করেছে সরকার। পুলিশ প্রথম থেকেই বলে আসছে, সরকারকে বেকায়দায় ফেলার উদ্দেশ্য থেকে বিদেশীদের হত্যা করা হয়। দুই বিদেশী হত্যা, সম্প্রতি গাবতলীতে পুলিশ হত্যা এবং শিয়াদের তাজিয়া মিছিলে হামলার মধ্যে যোগসূত্র রয়েছে বলে পুলিশের দাবি। আইনশৃঙ্খলাসংক্রান্ত কমিটির সভায় ॥ বুধবার সচিবালয়ে আইনশৃঙ্খলাসংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকের পর কমিটির সভাপতি শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, তাদের (বাংলাদেশে অবস্থানরত বিদেশী) যদি সিকিউরিটি কনসার্ন এতই থাকে তাহলে তারা কিভাবে অবস্থান করছে? আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অত্যন্ত সন্তোষজনক কার্যক্রমের মাধ্যমে বিভিন্ন সঙ্কট উতরে যাচ্ছি। আমু বলেন, দেশে একটি অরাজক অবস্থা সৃষ্টির জন্য ২০১৪ সালের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যে ধরনের কার্যক্রম শুরু হয়েছিল, তা বিক্ষিপ্ত-বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন সময় সংঘটিত হচ্ছে বলে মনে করছি। তাভেলা হত্যা মামলায় গ্রেফতার একজন স্বীকারোক্তি দিয়েছেন, আরও তিনজন রিমান্ডে আছে বলে জানান তিনি। মন্ত্রী বলেন, হোসেনী দালানে তাজিয়া মিছিলে বোমা হামলার ঘটনায় জিলানী নামে একজন গ্রেফতার রয়েছে এবং আরও তিনজনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করা হয়েছে। এছাড়া গাবতলীতে এসআই ইব্রাহীম মোল্লা হত্যায় জড়িত থাকায় ঘটনাস্থল থেকে মাসুদ রানা নামে একজনকে গ্রেফতারের পর বগুড়া থেকে জামায়াত-শিবিরের চারজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে জানান তিনি। সরকারের অস্বীকৃতি ॥ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, আইএসের নামে যে টুইট করা হয়েছে তা এসেছে বাংলাদেশ থেকেই। সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে আবারও বলা হয়েছে এসব ঘটনার সঙ্গে আইএসের সংশ্লিষ্টতা বা দায় স্বীকারের দাবির কোন ভিত্তি গোয়েন্দারা খুঁজে পাননি। এসব ঘটনায় কয়েকজনকে গ্রেফতারের পর পুলিশের পক্ষ থেকেও বলা হয়েছে, সরকারকে চাপে ফেলতে পরিকল্পিতভাবে এসব ঘটনা ঘটানো হচ্ছে।
×