ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

হোসেনী দালানে হামলায় ৪ জন জড়িত থাকার তথ্য পাওয়া গেছে

জামায়াতীরা আগে থেকেই তাজিয়া মিছিলবিরোধী প্রচার চালায়

প্রকাশিত: ০৫:৪৩, ২৯ অক্টোবর ২০১৫

জামায়াতীরা আগে থেকেই তাজিয়া মিছিলবিরোধী প্রচার চালায়

গাফফার খান চৌধুরী ॥ হোসেনী দালানে বোমা হামলায় একাধিক গ্রুপ জড়িত। হামলায় অন্তত ৪ জন জড়িত থাকার বিষয়ে তথ্য পাওয়া গেছে। চারজন ২ জন করে দুইটি গ্রুপে ভাগ হয়ে হামলা চালায়। হামলাকারীরা হোসেনী দালানের নিচু দেয়াল বেয়ে নেমে কবরস্থানে প্রবেশ করে। এরপর কবরস্থানের সুবিধাজনক জায়গায় দাঁড়িয়ে হামলা চালায়। হামলা শেষে আবার সেই পথেই পালিয়ে যায়। ইতোমধ্যেই বোমা হামলার ঘটনায় ৪ জনকে আটকের খবর জানা গেলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তরফ থেকে বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়নি। পহেলা মহরম থেকেই হোসেনী দালান, আজিমপুর, লালবাগ, মোহাম্মদপুর ও মিরপুরের কয়েকটি মসজিদে তাজিয়া মিছিলবিরোধী প্রচার চালানো হয়েছে। যারা প্রচার চালায় তাদের অধিকাংশই জামায়াতপন্থী আবার কেউ সরাসরি জামায়াতে ইসলামীসহ বিভিন্ন ইসলামী দলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। তদন্তকারী সংস্থা ও অনুসন্ধানে এমন তথ্য জানা গেছে। গত ২৩ অক্টোবর হোসেনী দালানে বোমা হামলায় একজন নিহত ও শতাধিক আহত হন। সরেজমিনে দেখা গেছে, হোসেনী দালানটি মূল ভবনে প্রবেশ করতে দুইটি ফটক পাড়ি দিতে হয়। হোসেনী দালানে প্রবেশের দুইটিই মাত্র গেট। প্রধান গেট দিয়ে ঢুকতেই ১০ থেকে ১২ গজ সামনেই দোতলা দারুল কুরআন লাইব্রেরী ভবন। পূর্ব দিকে বাড়িঘর। উঁচু দেয়াল। যা টপকে কারও পক্ষেই ভেতরে প্রবেশ করা সম্ভব নয়। পশ্চিম পাশেই দারুল কুরআন শেফাখানা এ্যান্ড ডেন্টাল ক্লিনিক। ক্লিনিকের সঙ্গে চওড়া কবরস্থান। যেটি হোসেনী দালানের মূল স্থাপনা পর্যন্ত। করবস্থানের পুরো প্রাচীর দেয়ালের মধ্যে মূল স্থাপনার পশ্চিম দিকের সিঁড়ির দিকে ১০-১২ ফুট দেয়াল মাত্র ৬ ফুট উঁচু। দেয়ালের ওপর কোন কাঁটাতারের বেড়া বা দেয়ালের ওপর তারকাঁটা বা কাচ দেয়া নেই। একেবারেই অরক্ষিত। ইচ্ছা করলেই সেখান দিয়ে লাফিয়ে অনায়াসে কবরস্থানের ভেতরে প্রবেশ করা সম্ভব। এছাড়া লাফিয়ে পড়ারও প্রয়োজন হয় না। দেয়াল ঘেঁষে একটি কাঁঠাল গাছ। গাছটি কয়েকটি বাঁক নিয়ে দেয়াল ঘেঁষেই উঠেছে। দেয়ালের বাইরের দিকে গার্মেন্টসের বিভিন্ন ছোটখাটো মালামাল যেমন বোতাম, চেইন, শার্টের কলারে লাগানো প্লাস্টিকের প্যাকিংসহ নানা জিনিসপত্র তৈরি হয়। কারখানার পানি সরবরাহ করার জন্য একটি স্টিলের ট্যাঙ্ক রয়েছে। ট্যাঙ্কটি ৩ ফুট উঁচু চারকোণা সিমেন্টের পাকা দেয়ালের ওপর বসানো। গোল ট্যাঙ্কটি রাখার পরেও সিমেন্টের চারকোণা পাটাতনটির কোণা বেরিয়ে আছে। সিমেন্টের পাটাতনের ওপর পা রাখার পর দেয়াল মাত্র ৩ ফুট উঁচুতে থাকে। যেখান থেকে যে কেউ অনায়াসে দেয়ালে উঠতে পারে। আর কাঁঠাল গাছটি দেয়াল ঘেঁষে এঁকেবেঁকে উঠা। গাছটির বয়স হলেও তেমন বাড়েনি। তবে খুবই শক্ত। অন্তত এক শ’ কেজি ওজনের মানুষ অনায়াসে সেই কাঁঠাল গাছের খাঁজে পা রেখে দেয়াল টপকে ভেতরে প্রবেশ করতে পারে আবার বেরও হতে পারে। এছাড়া কবরস্থানের দিকে থাকা স্টিলের পাইপে ভর করেও যে কেউ করবস্থানে নামতে পারে। আর এ দেয়ালটির কাছে যেতে হয় ওই গার্মেন্টস এক্সেসরিজ কারখানার গেট দিয়ে। গেটটি হোসেনী দালানের পশ্চিম পাশের মূল রাস্তা লাগায়ো। বাটা জুতার গোডাউনের উল্টো দিকে গেটটি। ২৪ ঘণ্টাই কারখানায় কাজ চলে। গেট সব সময়ই খোলা থাকে। গেটে কোন নিরাপত্তা প্রহরী নেই। সেই গেট দিয়ে ঢুকে অনায়াসে সেই করবস্থানে নামার নিচু দেয়ালের কাছে যাওয়া যায়। এমনকি অনায়াসে নেমে আবার উঠাও যায়। তদন্তকারীদের ধারণা, যে পরিমাণ নিরাপত্তা বেষ্টনী হোসেনী দালানের প্রথম ও দ্বিতীয় গেটে ছিল তাতে কোন সন্ত্রাসীর পক্ষেই সেখান দিয়ে গ্রেনেড বা বিস্ফোরক নিয়ে প্রবেশ করা প্রায় অসম্ভব। হামলার ঘটনাটি পূর্ব পরিকল্পিত। তাই হামলাকারীরা অনেক দিন ধরেই পুরো হোসেনী দালান পর্যবেক্ষণ করেছে। হোসেনী দালানে প্রবেশের দুর্বল জায়গা হিসেবে তারা নিচু দেয়ালটি বেছে নিতে পারে। আর সেই দেয়াল টপকে প্রবেশ করার পর আবার বের হওয়া খুবই সোজা। বোমা হামলার পর সরু রাস্তা ধরে হামলাকারীরা কবরস্থান থেকে বেরিয়ে যায়। যে জায়গাটি তারা বেছে নেয়, সেখানে তেমন আলোর ব্যবস্থা ছিল না। আর জায়গাটি ছিল সিসি ক্যামেরার আওতার অনেকটাই বাইরে। সরাসরি হামলায় অন্তত ৪ জন ছিল বলে ধারণা করা হচ্ছে। তারা একে একে নিচু দেয়াল বেয়ে কবরস্থানের ভেতরে প্রবেশ করে। এরপর দুইজন করে দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়। কবরস্থানের তিনটি গেট রয়েছে। হোসেনী দালান ইমামবাড়ায় ২৫ বছরের স্বেচ্ছাসেবী ফারহান হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, কবরস্থানে প্রবেশের তিনটি গেটের মধ্যে ডেন্টাল ক্লিনিক ও কবরস্থানে মাঝ বরাবর থাকা গেট দুইটি পুরোপুরি তালাবদ্ধ ছিল। আর ইমামবাড়ার মূল স্থাপনার পশ্চিম পাশের সিঁড়ি সংলগ্ন গেটটি খোলা ছিল। কারণ অনেকেই ইমামবাড়ায় দোয়া করার পর বেরিয়ে কবরখানায় প্রবেশ করে মোমবাতি জ্বালিয়ে দোয়া করেন। রাত ২টায় বোমা হামলার সময় জুলজানার দুলদুল ঘোড়াটি সাজিয়ে মিছিল নিয়ে বের হচ্ছিল মাত্র। তদন্তকারী সূত্র বলছে, গেট তালাবদ্ধ থাকায় হামলাকারীরা কবরস্থান থেকে বের হতে পারেনি। তারা ডেন্টাল ক্লিনিক লাগোয়া কবরস্থানের ভেতরের কোণার দিকে দাঁড়িয়ে ঠিক মিছিলের সামনে যেখানে দুলদুল ঘোড়াটি রাখা হয়েছিল, সেখানে প্রথম হ্যান্ড গ্রেনেডটি ছুড়ে। প্রথমটির বিস্ফোরণে তেমন শব্দ হয়নি। এরপর দ্বিতীয় বিস্ফোরণটি ঘটে ইমামবাড়ার মূল স্থাপনার পশ্চিম দিকের সিঁড়িতে। বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হয়। এখানে বেশ কয়েকজন নারী পুরুষ ও শিশু আহত হয়। এরপর তৃতীয় হ্যান্ড গ্রেনেডটি বিস্ফোরিত হয় আবার সেই দুলদুল ঘোড়ার কাছে। এই হামলায় একজন নিহত হন। আহত হয় শতাধিক। ঘটনাস্থল থেকে ৩২টি সিসি ক্যামেরার ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ করে পর্যালোচনা চলছে। ফুটেজে দুইজনকে কবরস্থানের কোণা থেকে বোমা ছুড়ে মারার দৃশ্য ধরা পড়েছে। তবে ইমামবাড়ার পশ্চিম সিঁড়িতে বোমা হামলাকারীদের সম্পর্কে এখন পর্যন্ত কোন সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায়নি। তাদের শনাক্তও করা যায়নি। হামলার পর প্রাণ বাঁচাতে লোকজন যার যার মতো গেট দিয়ে নিরাপদ জায়গার দিকে ছুটে যায়। এমন শোরগোলের মধ্যে হামলাকারীরা আবার সেই নিচু দেয়াল বেয়ে বেরিয়ে যেতে পারে। কারণ পালানোর জন্য সেটিই সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা। অনেকটা অন্ধকারে নিচু দেয়ালটির অবস্থান থাকায় কেউ বিষয়টি হয়ত আঁচ করতে পারেননি। গার্মেন্টস এক্সেসরিজ কারখানাটির মালিক রেজাউল করিমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, কারখানায় প্রবেশের গেটে সর্বক্ষণিক নিরাপত্তা প্রহরী থাকে। কারখানায় ১৫ জন শ্রমিক কাজ করেন। প্রায় ২৪ ঘণ্টাই কারখানায় কাজ চলে। ঘটনার দিন ও পরদিন কারখানাটি বন্ধ ছিল। তবে তার কারখানা দিয়ে প্রবেশ করে বোমা হামলা চালিয়ে কেউ বেরিয়ে যায়নি। বোমা হামলার ঘটনায় ৪ জন এবং গত ২২ অক্টোবর গাবতলীতে পুলিশ কর্মকর্তা ইব্রাহিম হত্যা মামলায় গ্রেফতারকৃত জামায়াত-শিবির ও বিএনপির এক নেতাদের জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। তবে ঢাকা মহানগর পুলিশের মিডিয়া বিভাগের উপ-কমিশনার মুনতাসিরুল ইসলাম জানান, হোসেনী দালানের হামলায় ঘটনায় কাউকে আটক বা গ্রেফতার করা যায়নি। তবে চেষ্টা চলছে। পুলিশ কর্মকর্তা হত্যার ঘটনায় গ্রেফতারকৃতদের বোমা হামলার ঘটনায় জিজ্ঞাসাবাদ চলছে।
×