ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

একটি খালের আত্মকথা

প্রকাশিত: ০৪:১২, ২৯ অক্টোবর ২০১৫

একটি খালের আত্মকথা

মাহবুবুল আলম চুন্নু আমি শতবর্ষেরও পুরনো। সুনির্দিষ্ট কোন নাম না থাকলেও জনগুরুত্বের দিক থেকে এই ভূ-খ-ের মানুষের কাছে আমার সুনাম ছিল। দখলের কবলে পরে আজ আমি মৃত। আমার অঘোরে মৃত্যু সংবাদ প্রকৃতিপ্রেমী তথা দেশপ্রেমিক মানুষের অন্তরে হাহাকার সৃষ্টি করলেও ‘মৃত্যু’টি কিন্তু সত্য। আমাকে মেরে ফেলা হয়েছে। প্রভাবশালী, লাঠিওয়ালা, ভৌগোলিক সুবিধা সম্পন্ন লুটেরা-ধনাঢ্য-দুর্বৃত্ত জাতীয় কিছু লোক দখল নিয়েছে এবং দখল চরিতার্থ করতে গিয়ে আমার গলা টিপে ধরেছে। আমি মরে গেছি! নতুন প্রজন্মের আগ্রহী মানুষ ‘থাক-পর্চায়’ই শুধু আমার অস্তিত্ব খুঁজে পাবে। বাস্তবে আমাকে দেখা যাবে না। এখন আমার বুকে বালির পাহাড়। সেই পাহাড়ের বুকে ঘরবাড়ি-দোকানপাট। এখানে যে খড়স্রোতা স্বচ্ছ পানি-বহমান একটি খাল ছিল, তা একদিন কেউ বিশ্বাস করবে না। দখলদাররা আমার আবহমানকালের গর্বিত অবস্থানকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে। আমাকে হত্যা করার মতো এই নিষ্ঠুর কাজে দুর্বৃত্তদের আইনী সহায়তা দিয়েছে জেলা পরিষদের কিছু অর্থলোভী লুটেরা কর্মকর্তা কর্মচারী। আমার বুকের বালির পাহাড় ওই লোভী মানুষগুলোর টাকার পাহাড় গড়ে দিয়েছে। দয়া করে আমাকে একটু চিনে নিন। আজ থেকে শতবর্ষ আগে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যচর্চার সোনালি সময়ে এই বাংলার মানুষ তাদের ‘প্রয়োজনে’ আমাকে সৃষ্টি করে। আমাকে দিয়ে তারা তাদের বহুমাত্রিক প্রয়োজন মিটিয়েছে। আমি তাদের নৌ-চলাচল, মালামাল পরিবহন ইত্যকার সুবিধা দেয়া ছাড়াও এতদাঞ্চলের প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় অবদান রেখেছি। ‘মাছে-ভাতে-বাঙালী’র রসনা মিটাতে নানা প্রজাতির মাছের ব্যবস্থা করেছি। জলাবদ্ধতার অভিশাপ থেকে তাদের রক্ষা করেছি। আমাকে চিনে নেয়ার কথা বলছিলাম। আমার চলার পথ অর্থাৎ বিস্তৃতি অনেক দীর্ঘ হলেও আমি শুধু আমাকে চেনার জন্য মৃত অংশটুকুই তুলে ধরছি। চাঁদপুর জেলাধীন হাজীগঞ্জ রেলস্টেশন থেকে মকিমাবাদের বুকচিড়ে শহীদ আলী আজ্জম সড়ক ধরে যে খালটি হাজীগঞ্জ বাজারের ‘গাজীর খাদা’য় এসে মিশেছে, আমিই সেই ‘হতভাগা’। যা বিভিন্ন সময়ে দখল বাণিজ্যের বহ্নি উৎসবে মরে গেছে। মোদ্দাকথা আমাকে মেরে ফেলা হয়েছে। বলছিলাম ‘গাজীর খাদা’র কথা। চিনেছেন? বয়স্কজনেরা নিশ্চয়ই চিনে থাকবেন। ঝামেলা বাধবে জুনিয়রদের নিয়ে। বিশাল খাদাটি (বড় পুকুর) ভরাট করে ফেলার পর থেকেই আমার মৃত্যুধ্বনি শোনা গিয়েছিল। দখলদার সুবিধাবাদী মানুষগুলো ওঁৎ পেতে বসেছিল- কখন শকুনের মতো খাবলে যাওয়ার সময় আসবে। জনস্বার্থে আমার কণ্ঠহার গাজীর খাদাটির অবদান অনেক। আমার বিশাল জলরাশি যে খাদাটি তার বুকে ধারণ করত, তার অনেক গৌরবময় কীর্তি আছে। তিনি আমার অনেক সিনিয়র, মুরুব্বি। আমার দিদি। একটি ঘটনার কথা আমার বেশ মনে পড়ছে। ১৯৭১ সাল। মহান মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় দিনগুলোর কথা। সাঁঝের আলো-আঁধারিতে একজন কিশোর মুক্তিযোদ্ধা ‘গাজীর খাদা’ থেকে ওঠে এসে ব্রাশফায়ার করে ১০-১৫ জন পাকিস্তানী হানাদার ও তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকার হত্যা করে আবার ‘গাজীর খাদায়’ ঝাঁপিয়ে পড়ে। গাজীর খাদা পরম ¯েœহে তার বড় বড় কচুরিপানায় ওই বীরকে আশ্রয় দেয়। বাংলার ওই বীরসন্তান আমার বুক বেয়ে নিরাপদ স্থানে চলে যায়। কিন্তু হায়, আজ ‘আমিও নেই, দিদিও (গাজীর খাদা) নেই’ কেমন মজা হবে? হ্যাঁ, মজা লুটছে আমার দখলকাররা আর জেলা পরিষদের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা কর্মচারী। আমাকে মেরে ওই লুটেরারা তাদের ভাগ্য গড়েছে। স্বীয় পরিবারের ভবিষ্যত নিশ্চিত করেছে। আমি ছিলাম এই অঞ্চলের পানি নিষ্কাশনের স্বাভাবিক আঁধার। আমাার বুক বেয়ে বন্যা- অতিবৃষ্টির পানি সহজেই নেমে যেত। মানুষ কষ্টে পড়ত না। হে মানুষ! আমি তোমাদের সার্বিক জীবন ব্যবস্থার চলার পথের বন্ধু ছিলাম। আমাকে মেরে তোমাদের জীবন সুখের হবে না। যখন বুঝবে, তখন কিছুই করার থাকবে না। সময় গেলে সাধন হয় না। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যেখানে প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা করে মানুষের জীবনকে অনাবিল সুখময় করার লক্ষ্যে নতুন নতুন খাল-লেক তৈরি করা হচ্ছে, সেখানে রক্তে কেনা এই বাংলাদেশে পুরনো প্রতিষ্ঠিত খাল-জলাশয়গুলোকে হত্যা করা হচ্ছে। ‘সার্থক জনম মাগো, জন্মেছি এই দেশে’- আমাদের লালিত অহঙ্কারগুলোর শাণিত রূপ ধীরে ধীরে ভোতা হয়ে যাচ্ছে। বাংলার খাল-বিল-জলাশয়গুলোকে রক্ষা কর। আমাকে-আমাদের বাঁচাও, নিজেরা বাঁচো। বাংলার শাশ্বতরূপকে সমুন্নত রাখ। হাজীগঞ্জ, চাঁদপুর থেকে
×