ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

জড়িতরা জেএমবি ও শিবিরের ক্যাডার

পুলিশ কর্মকর্তা হত্যা ও হোসেনী দালানে বোমা একসূত্রে গাঁথা

প্রকাশিত: ০৫:৪০, ২৮ অক্টোবর ২০১৫

পুলিশ কর্মকর্তা হত্যা ও হোসেনী দালানে বোমা একসূত্রে গাঁথা

গাফফার খান চৌধুরী ॥ জামায়াতে ইসলামীর প্রত্যক্ষ মদদে হোসেনী দালানে বোমা হামলা ও গাবতলীতে পুলিশ কর্মকর্তা হত্যার ঘটনা ঘটে। ছাত্রশিবিরের বেশ কয়েকটি গ্রুপ মারাত্মক বিস্ফোরক ও আগ্নেয়াস্ত্রে সজ্জিত হয়ে বিভিন্ন জায়গায় নাশকতা চালানোর পরিকল্পনা করছে। ভবিষ্যতে এ ধরনের আরও ঘটনা ঘটানো হতে পারে। পুলিশ কর্মকর্তা হত্যা ও হোসেনী দালানে বোমা হামলা একসূত্রে গাঁথা। এজন্য একত্রে চলছে দুইটি মামলার তদন্ত। বোমা হামলায় জড়িতরা জেএমবি ও ছাত্রশিবিরের প্রশিক্ষিত সদস্য। হোসেনী দালানে বোমা হামলা এবং পুলিশ কর্মকর্তা হত্যার মামলার তদন্তকারী সংস্থা সূত্রে এমন তথ্য জানা গেছে। এসব ঘটনা ঘটনার পেছনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গাফিলতি ছিল কিনা সে বিষয়ে তদন্ত চলছে। গত ২২ সেপ্টেম্বর গাবতলীতে রাত ৯টায় দারুস সালাম থানার এএসআই ইব্রাহিম মোল্লাকে ব্যাগ তল্লাশির সময় ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়। মূলহত্যাকারী পালিয়ে যায়। তবে ধরা পড়ে মাসুদ রানা (২৪) নামে একজন। মাসুদ রানার পিতার নাম হাসান ম-ল। বাড়ি বগুড়া জেলার আদমদীঘি উপজেলার কেশোরতা গ্রামে। তিনি ছাত্রশিবিরের সাথী। মাসুদ রানার তথ্য মতে, ওই রাতেই রাজধানীর কামরাঙ্গীরচর থানাধীন পূর্ব রসূলপুরের ৩ নম্বর সড়কের ২৩ নম্বর বাড়ি থেকে গ্রেফতার করা হয় জামায়াত নেতা আব্দুল আজিজ মিয়া (৬০) তার দুই ছেলে শিবিরকর্মী ফজলে রাব্বী ও রাকিব হাসানকে। তাদের কাছ থেকে ৫টি হ্যান্ড গ্রেনেড উদ্ধার হয়। মাসুদ রানা আরও জানায়, বগুড়া জেলার আদমদীঘি উপজেলা ছাত্রশিবিরের সাবেক সভাপতি এনামুল হক প্রকাশ ওরফে কামাল পুলিশ কর্মকর্তাকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করে পালিয়ে যায়। তার ও মাসুদ রানা এবং কামরাঙ্গীরচর থেকে গ্রেফতারকৃত জামায়াত নেতা ও তার দুই ছেলে শিবিরকর্মী একই বাসায় থাকত। কামাল গোয়েন্দা জালের মধ্যে রয়েছে বলে জানা গেলেও এ ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তরফ থেকে কোন আনুষ্ঠানিক বক্তব্য পাওয়া যায়নি। পুলিশ কর্মকর্তা হত্যার ঘটনায় বগুড়া থেকে গ্রেফতার করা হয় জামায়াত নেতা ড. ইউনূস আলী আকন্দ (৫৭) ও বিএনপি নেতা শেখ রফি আহমেদ ওরফে আচ্চুসহ (৬৫) ২৫ জন। পুলিশ কর্মকর্তা হত্যার পরদিন হোসেনী দালানে বোমা হামলা করে একজনকে হত্যা ও শতাধিক জনকে আহত করা হয়। ঘটনাস্থল থেকে অবিস্ফোরিত অবস্থায় দুইটি হ্যান্ড গ্রেনেড উদ্ধার হয়। পরবর্তীতে আরও ৩টি হ্যান্ড গ্রেনেডের সেফটি লক উদ্ধার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। মামলা দুইটির তদন্তকারী সংস্থা ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের পাশাপাশি র‌্যাবের বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞরাও বলছেন, হোসেনী দালানে হামলায় ব্যবহৃত হ্যান্ড গ্রেনেড এবং কামরাঙ্গীরচর থেকে উদ্ধারকৃত হ্যান্ড গ্রেনেড এক ও অভিন্ন। কামরাঙ্গীরচর থেকে গ্রেনেড উদ্ধারের ঘটনায় গ্রেফতারকৃতরা এবং পুলিশ কর্মকর্তাকে হত্যার সঙ্গে জড়িতরা জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মী। মামলার তদন্তে দুইটি ঘটনার সঙ্গে জামায়াতের প্রত্যক্ষ মদদ থাকার বিষয়টি একেবারেই স্পষ্ট। জামায়াত ও তাদের সহযোগী সংগঠনগুলো দলীয়ভাবে চেইন অফ কমান্ড মেনে চলতে বাধ্য। তাই দুইটি ঘটনার সঙ্গে জামায়াতে মদদ থাকার বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। শুধু পুলিশ কর্মকর্তা হত্যার সঙ্গে ছাত্রশিবির জড়িত। আর হোসেনী দালানে বোমা হামলার সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর বি টিম হিসেবে পরিচিত জেএমবির পাশাপাশি ছাত্রশিবিরের প্রশিক্ষিত সদস্যরা উপস্থিত ছিল জানা গেছে। ইতোপূর্বে এ ধরনের বোমা বা হ্যান্ড গ্রেনেড যুবদল, ছাত্রদল ও শিবিরের মেস থেকে উদ্ধার হয়েছে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট একজন উর্ধতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, গত ২৩ অক্টোবর শুক্রবার দিবাগত রাত ২টায় হোসেনী দালানের ইমামবাড়ার তাজিয়া মিছিলে হামলার বিষয়ে আশঙ্কা ছিল। এমন আশঙ্কা থেকেই পর্যাপ্ত পুলিশ, র‌্যাব ও বিজিবি মোতায়েন ছিল। এমনকি সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কয়েকটি ঘটনা পর্যালোচনা করে এবং গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে তাজিয়া মিছিলকে রাতে না করার জন্য মিছিল বাস্তবায়ন কমিটিকে অনুরোধও করা হয়েছিল। কিন্তু তাজিয়া মিছিলটি যেহেতু ধর্মীয় বিষয়, এজন্য খুব বেশি চাপ প্রয়োগ করার সুযোগ ছিল না। এছাড়া হাজার হাজার মানুষ কড়া নিরাপত্তা বেষ্টনী উপেক্ষা করে হুড়হুড় করে ঢুকে পড়ে। এজন্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা কিছুটা বিঘিœত হয়। আর এমন সুযোগে নাশকতার ঘটনাটি ঘটায়। ছাত্রশিবিরের বেশ কয়েকটি গ্রুপ বিস্ফোরক ও আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে মাঠে নেমেছে। তারা বড় ধরনের নাশকতা চালানোর পরিকল্পনা করছে। এদিকে পুলিশ কর্মকর্তা হত্যা ও হোসেনী দালানে বোমা হামলা মামলার ঘটনায় গঠিত পৃথক দুইটি তদন্ত কমিটির প্রধান ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার শেখ মোহাম্মদ মারুফ হাসান ঘটনাস্থল দুইটি পরিদর্শন করেন। পরিদর্শন শেষে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে অনানুষ্ঠানিক এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, পুলিশ কর্মকর্তা হত্যা এবং হোসেনী দালানে বোমা হামলার পেছনে পুলিশের দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে কোন গাফিলতি ছিল কিনা তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। কোন পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া গেলে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেয়া হবে। পুলিশ কর্মকর্তা হত্যার ঘটনায় গ্রেফতারকৃত মাসুদ রানা ছাত্রশিবির নেতা। হত্যাকারীও ছাত্রশিবিরের নেতা। আর গ্রেফতারকৃত মাসুদ রানার তথ্য মতে কামরাঙ্গীরচর থেকে গ্রেফতারকৃতরাও জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মী। এমনকি কামরাঙ্গীর চর থেকে উদ্ধারকৃত হ্যান্ড গ্রেনেডের সঙ্গে হোসেনী দালানে বোমা হামলায় ব্যবহৃত হ্যান্ড গ্রেনেড এক ও অভিন্ন। দুইটি মামলা আলাদা আলাদা তদন্ত চললেও প্রাপ্ত তথ্য দুইটি মামলার ক্ষেত্রেই কাজে লাগবে। হোসেনী দালানে বোমা হামলাকারী ও পুলিশ কর্মকর্তা হত্যাকারীকে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। তবে দুইটি ঘটনার সঙ্গে বিশেষ যোগসূত্র থাকার সম্ভবনা বেশি। একাধিক সন্ত্রাসী গ্রুপ বড় ধরনের নাশকতা চালানোর চেষ্টা করছে বলেও জানান তিনি। দেশকে পরিকল্পিতভাবে অস্থিতিশীল করে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে রাখতেই এ ধরনের নাশকতামূলক কর্মকা- চালানো হচ্ছে। ইতোপূর্বে সোমবার এক আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনে ডিএমপি কমিশনার মোঃ আছাদুজ্জামান মিয়া বলেছেন, গাবতলীতে পুলিশ কর্মকর্তা হত্যা এবং হোসেনী দালানে বোমা হামলা একসূত্রে গাঁথা। তিনি সরকারকে রাষ্ট্র ও সরকারকে আন্তর্জাতিকভাবে চাপে রাখতে একটি গোষ্ঠী পরিকল্পিত এসব নাশকতা চালাচ্ছে বলে দাবি করেন। রাজধানীতে বাড়তি চেকপোস্ট বসিয়ে নিরাপত্তা জোরদারের পাশাপাশি গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। তদন্তকারী সূত্রে জানা গেছে, পুলিশ কর্মকর্তা হত্যার ঘটনার ৫ দিন আগে মাসুদ রানা গাজীপুরে একটি বাসা ভাড়া করে। ধারণা করা হচ্ছে, হোসেনী দালানে বড় ধরনের নাশকতা চালিয়ে তাদের গাজীপুরের ওই বাড়িতে আত্মগোপন করতেই আগাম বাসা ভাড়া নেয়া হতে পারে। হোসেনী দালানে বোমা হামলার ঘটনায় সন্দেহভাজন হামলাকারী হিসেবে শফিকুল ইসলাম, মোরসালিন, আব্দুল কাদির জিলানীসহ ৪ জন ছাড়াও কামরাঙ্গীরচর থেকে গ্রেফতারকৃত ৩ জন এবং পুলিশ কর্মকর্তাকে হত্যার সময় গ্রেফতারকৃত মাসুদ রানাকে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। পুলিশ কর্মকর্তা হত্যা ও হোসেনী দালানে বোমা হামলায় এদের ছাড়াও বগুড়া থেকে গ্রেফতারকৃত জামায়াত ও বিএনপি নেতাসহ ৬ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
×