ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

রেজা ফারুক

হিমোষ্ণ হেমন্তের নগর

প্রকাশিত: ০৬:০১, ২৬ অক্টোবর ২০১৫

হিমোষ্ণ হেমন্তের নগর

হেমন্তের হিমোষ্ণ হাওয়া এক অন্যরকম আমেজ প্রকৃতিকে দান করেছে ভিন্নতর মাত্রা। মনকে প্রলুব্ধ করা এই আবেশ যেন দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি পরতে মেলে দিয়েছে চিরকালীন ভাললাগাময় গভীর ব্যঞ্জনা; যা শুধুই হেমন্তের অনাস্বাদিত রূপ। বছর ঘুরে ঘুরে হেমন্ত এসে রোজকার ব্যস্ততা মুখর নগরজীবনকে একটু দুলিয়ে দিয়ে যায়; যার স্থায়িত্ব খুব দীর্ঘ নয়। ধুলোবালি, প্রবল শব্দের পলেস্তারা ভেদ করে হেমন্তের সুরবীথি নাগরিক বোধের গহনে খুব একটা আলোড়ন সৃষ্টি করতে সক্ষম হয় তা কিন্তু নয়। কেননা, এই শহুরে জীবনের সকালটাই শুরু নানা কর্মচাঞ্চল্যের মধ্য দিয়ে । সেখানে ঋতুবৈচিত্রের রঙটাকে নিবিড়ভাবে অনুভব করার ফুরসতই যেন মেলে না। তবুও কি ঋতুর অনিন্দ্য সৌন্দর্য মুগ্ধ বৈভব থমকে থাকে। মোটেই থাকে না। নিসর্গের নিয়ম মেনে সব ঋতুই একে একে বছর ঘুরে বাড়ির আঙিনায় রেখে যায় স্ব স্ব বৈশিষ্ট্যের ছোঁয়া। তেমনি হেমন্তও এসেছে নিজের মতো করে। সোনারঙ রৌদ্রের চিনিচম্পা মেদুর মায়াবি এক সুগন্ধি সুবাস হৃদয়ে মেখে দাঁড়িয়েছে একচিলতে ব্যালকনি বা বারান্দার কার্নিশে। আর তাতেই যেন অন্তরে বেজে ওঠে নৈসর্গিকতার সবুজ মুগ্ধতা। বাতায়নে হেমন্তের স্বর্ণালী দিনের আধো হিম্ আধো উষ্ণ আবেশ ভরিয়ে দেয় সারাদিনের কর্মক্লান্ত ধূসর মন। হেমন্ত এলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে নবান্নের হলুদ শস্যের বিস্তৃত মাঠ। কৃষকের কর্মতৎপর ছবিটা গ্রামবাংলার প্রতিটি স্তরকে এক আনন্দঘন শুভ সংবাদ বহন করে যেন প্রদর্শিত হতে থাকে। গ্রামে গ্রামে ফসল কাটার মহা উৎসবের সূচনা হয়। নতুন ধানের গন্ধে বিভোর হয়ে পড়ে গ্রাম- গ্রামান্তর। বাড়ির উঠোনে স্তূপাকৃত ধানের আঁটির মর্মে যেন কৃষকের জীবনের সুগভীর আবেগটুকু স্পন্দমান হতে থাকে। আর এখানেই বিপুলভাবে খুঁজে পাওয়া যায় হেমন্তের সোনালী রূপ সুধা। গ্রামে-গঞ্জে এই হেমন্তেরকালেই নাইওর যায় কনে বউয়ের দল। বাড়ি বাড়ি জমে ওঠে পিঠা,ক্ষীর, পায়েস উৎসব; যা গ্রামীণ জীবনের এক অনস্বীকার্য অনন্য প্রতিচ্ছবি। কিন্তু ওই ছবিটা শহরের কর্মময় নগরজীবনে একেবারেই অনুপস্থিত। শিশু, কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণী থেকে শুরু করে সকলেই যেন একটা বৃত্তের রেখায় চালিত হয় নিয়ম মেনে। স্কুল,কলেজ, ইউনিভার্সিটি, কোচিং সেন্টার কিংবা হাউস টিচারের রুটিন মেনে এই চলমান জীবনের কোথাও কি খুঁজে পাওয়া সম্ভব আবহমান বাংলার সেই হৈমন্তি প্রহর। পাওয়া যাবে খুব ভোর বেলাকার ঘাসে ঘাসে জমে থাকা শিশিরপুঞ্জের মোহনীয় দৃশ্যাবলী। কুয়াশায় ডুবে থাকা সকালের আদিগন্ত মাঠের যে ভেজাসিক্ত ছবি গাঁয়ের সর্বত্র দৃশ্যমান তাও নেই ইট, পাথর আর কংক্রিটের নিরেট নগরে। আছে কম্পিউটার, মোবাইল, গেম শো, টিভি চ্যানেলের পর্দায় চোখ রেখে অবসর মুহুর্তগুলো উপভোগ করার অন্য এক জগত। সময়ের নিরিখেই প্রকৃতির বর্ণময়তা যেমন বদলে যেতে থাকে হেমন্তের মোহনীয়তাও সেভাবেই এসে জীবনে উপস্থিত হয়। মনকে করে তোলে চঞ্চল-উল্লসিত। গ্রামের হেমন্ত শিশির ধোয়া হলেও শহরের হেমন্ত প্রহর কাটায় ধুলিধূসরতায়। নাগরিক মন তবু খুঁজে ফেরে এক-আধটু ঋতুমগ্ন দিবসের নিবিড় সান্নিধ্য যা শুধু খুঁজে পাওয়া যায় নিরিবিলি পার্কের নির্জনতায়। কিন্তু সেই সবুজের ছাউনিটানা বিপুল বৃক্ষরাজিও কি আছে শহরগুলোতে। আর এই সবুজের শূন্যতার জন্য পরিবেশও মাঝে মধ্যে কেমন আচরণ করে নগরবাসীর সঙ্গে। বিশুদ্ধ বাতাসের ছিটেফোঁটাও কি অবশিষ্ট আছে। পাখি আর গাছের সন্ধিস্থল যে সবুজায়ন তাও যেন ক্রমশ উধাও হতে বসেছে। বিপরীত এ ‘দৃশ্যপটের ফাঁকফোকরেই ঋতুর বিভা এসে ছায়া ফেলে আপন মহিমায়। কিছুটা হলেও তখন সতেজ হয়ে ওঠে মন। হেমন্তের মন উদাস করা ঝিরিঝিরি হাওয়া বয়ে নিয়ে আসে অফুরন্ত ভাললাগা। হেমন্ত চিরকালই এক সৃষ্টিশীল ঋতু। হেমন্তেই আকাশজুড়ে ফুটে ওঠে উজ্জ্বলতম মেঘের ফোয়ারা। ঝরে যায় সেই মেঘের ফোয়ারা থেকে টুটাফাটা একচিলতে বৃষ্টিও। তবে এ বৃষ্টি ঝমঝমিয়ে নেমে আসে না। আসে লাজুক নয়নে। এই বৃষ্টি এই রোদের সোনারঙ সকাল, দুপুর, বিকেল গড়িয়ে হাল্কা শীতের আভা ছড়ানো হেমন্তের সন্ধ্যা এক চিরন্তন চন্দ্রময় সৌহার্দ্যকে যেন বুকে টেনে নিয়ে নিসর্গকে আপ্লুত করে তোলে। সে হেমন্ত হোক শহরের কিংবা গ্রামবাংলার। ছবি : শেখ সাদি মডেল : ফাহিম ও সুজান
×