ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

কারিগরি শিক্ষা শেষে কর্মসংস্থানের সুযোগ নেই

প্রকাশিত: ০৫:২৪, ২৬ অক্টোবর ২০১৫

কারিগরি শিক্ষা শেষে কর্মসংস্থানের সুযোগ নেই

বিভাষ বাড়ৈ ॥ কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষাকে দক্ষ জনশক্তি তৈরির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খাত হিসেবে অভিহিত করা হচ্ছে বারবার। অথচ দেশে কারিগরি ডিপ্লোমাধারী লাখ লাখ শিক্ষার্থীর উচ্চ শিক্ষার কোন সুযোগই নেই। তাদের উচ্চ শিক্ষার সুযোগ দেয়ার বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ দীর্ঘ পাঁচ বছরেও বাস্তবায়ন করেনি দেশের কোন প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। ফলে পুরোপুরি অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে এ শিক্ষার্থীদের উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের উদ্যোগ বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া। এদিকে আশা জাগিয়ে সম্ভাবনাময় বিষয় হিসেবে ১০ বছর আগে বহু বিষয় চালু করা হলেও আজ পর্যন্ত তাদের জন্য সৃষ্টি করা হয়নি কর্মসংস্থানের কোন পদ। এ অবস্থায় একবার আশার আলো দেখলেও এখন চোখে রীতিমতো অন্ধকার দেখছেন পলিটেকনিক থেকে পাস করা ডিপ্লোমাধারীরা। দেশের কারিগরি শিক্ষার্থীদের অবস্থা সম্পর্কে খোঁজ নিতে গিয়ে বেরিয়ে এসেছে তাদের উচ্চ শিক্ষার সঙ্কটসহ নানা অবহেলার চিত্র। উচ্চ শিক্ষার সঙ্কট ও এর সমাধানের বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা হতাশা প্রকাশ করে বলছেন, পুরোপুরি অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে সারাদেশের কারিগরি ডিপ্লোমাধারী শিক্ষার্থীদের উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের উদ্যোগ বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া। হাতে গোনা দু’একটি প্রতিষ্ঠান চার বছর মেয়াদী ডিপ্লোমাধারীদের ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে বিএসসি ডিগ্রী গ্রহণের সুযোগ দিলেও তার আসনও সীমিত। ক্রেডিট সমন্বয়ের মাধ্যমে তাদের স্মাতক ও স্মাতকোত্তর ডিগ্রী প্রদান কার্যক্রম শুরু করতে দীর্ঘ প্রায় পাঁচ বছর আগে ২০১০ সালের ২০ ডিসেম্বর চিঠি দিলেও আজ পর্যন্ত তা কার্যকর করেনি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। এমনকি শিক্ষার্থীদের স্বার্থে উদ্যোগ কার্যকর করার বিষয়ে চিঠির কোন উত্তরও দেয়নি কোন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এর আগে শিক্ষার্থীদের এ সঙ্কটের কথা চিন্তা করেই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ও কৌশল বাস্তবায়নে গঠন করা হয়েছিল জাতীয় বিশেষজ্ঞ কমিটি। দীর্ঘ আলাপ-আলোচনা, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে কমিটি ডিপ্লোমাধারীদের উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের সুযোগের পক্ষে মতো দেয়। যত দ্রুত সম্ভব কারিগরি শিক্ষার্থীদের উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সরকারের কাছে সুপারিশ করে ওই কমিটি। কমিটির সুপারিশ মেনে দ্রুত বিষয়টি চূড়ান্ত করেছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়। একই সঙ্গে অবিলম্বে বিষয়টি কার্যকর করার জন্য সকল প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়কে ২০১০ সালের ২০ ডিসেম্বর চিঠিও দেয়া হয়। চিঠিতে বলা হয়, সুপারিশ বাস্তবায়ন কার্যক্রম শুরু করে অবিলম্বে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে এসব বিষয়ে অবহিত করতে হবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, চিঠি দেয়ার পর দীর্ঘ এক বছর চলে গেলেও কোন বিশ্ববিদ্যালয় নির্দেশ বাস্তবায়ন করেনি এমনকি মন্ত্রণালয়কে এ বিষয়ে কোন মতামতও পাঠায়নি। জানা গেছে, দেশে মধ্যম স্তরের কারিগরি শিক্ষার মধ্যে রয়েছে বহু ধরনের ডিপ্লোমা শিক্ষা। এর মধ্যে রয়েছে ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং, ডিপ্লোমা ইন এগ্রিকালচার, ডিপ্লোমা ইন মেরিন, ডিপ্লোমা ইন টেক্সটাইল, ডিপ্লোমা ইন ফরেস্ট্রি, ডিপ্লোমা ইন এনিম্যাল হেলথ এ্যান্ড প্রোডাক্টশন টেকনোলজি, ডিপ্লোমা ইন ভোকেশনাল এ্যাডুকেশন, ডিপ্লোমা ইন হেলথ টেকনোলজি ইত্যাদি। দেশে বর্তমানে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের আওতায় চার বছর মেয়াদী ডিপ্লোমা ডিগ্রী প্রদানকারী সরকারী বেসরকারী প্রতিষ্ঠান আছে ৪৮৭টি। শিক্ষার্থী আছে প্রায় তিন লাখ। এর মধ্যে সরকারী প্রতিষ্ঠানে এক লাখ। বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে ২ লাখ শিক্ষার্থী আছে। প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আছে ৪৯টি সরকারী ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং, ১৩টি কৃষি প্রশিক্ষক ইনস্টিটিউট, ছয়টি টেক্সটাইল ইনস্টিটিউট, একটি মেরিন্ ইঞ্জিনিয়ারিং, দুটি সার্ভে ইনস্টিটিউট এবং ৪০টি টেক্সটাইল ভোকেশনাল ইনস্টিটিউট। জনশক্তি ও কর্মসংস্থান ব্যুরোর অধীনে রয়েছে ৩৫টি টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টার। কারিগরি শিক্ষা অধিদফতরের অধীনে ৬৪টি টেকনিক্যাল স্কুল এ্যান্ড কলেজ রয়েছে। কিন্তু শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের বহু বছরের অভিযোগ, কারিগরি শিক্ষা গ্রহণের পর শিক্ষার্থীরা উচ্চতর ডিগ্রী লাভ করতে গিয়ে নানা সমস্যার সম্মুখীন হন। উচ্চশিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে কারিগরি শিক্ষায় উত্তীর্ণদের জন্য কোন দেশে কোন ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। শিক্ষার্থীদের জন্য কেবল গাজীপুরে অবস্থিত ঢাকা ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং এ্যান্ড টেকনোলজিতে (ডুয়েট) সুযোগ রয়েছে। এদিকে দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এই উদ্যোগ বাধাগ্রস্ত হওয়ায় হতাশ বিশেষজ্ঞরা। কারিগরি শিক্ষার এই দাবি বাস্তবায়ন আন্দোলনের সঙ্গে সব সময় ছিলেন বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের সভাপতি ও শ্যামলী আইডিয়াল পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষ এম এ সাত্তার। সার্বিক পরিস্থিতিতে হতাশা প্রকাশ করে তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, বহু বছরের দাবি অনুযায়ী এই উদ্যোগ নিয়েছিল সরকার। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অসহোযোগিতায় আজও তা বাস্তবায়ন হয়নি। কোন বিশ্ববিদ্যালয় এটি বাস্তবায়ন করেনি আজ পর্যন্ত। বিষয়টিতে তিনি অবিলম্বে শিক্ষামন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। সরকারের উদ্যোগের পরেও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এমন কর্মকা-ে ক্ষোভ ও হতাশা প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ পলিটেকিনিক শিক্ষক সমিতির নেতৃবৃন্দ। সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষক নির্মল চন্দ্র সিকদার হতাশা প্রকাশ করে বলছিলেন, পাঁচ বছরেও কোন বিশ্ববিদ্যালয় সরকারের কাজ বাস্তবায়নে এগিয়ে না আসা দুঃখজনক। আমরা চাই অবিলম্বে দেশের স্বার্থে এ উদ্যোগ বাস্তবায়ন হোক। যাতে কারিগরি শিক্ষার প্রতি শিক্ষার্থীদের আগ্রহ আরও বাড়বে, এগিয়ে আসবে মেধাবীরা। তিনি ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, আমরা পলিটেকনিক শিক্ষক সমিতির পক্ষ থেকে বহুবার বলেছি। ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের পক্ষ থেকেও সরকারকে বলা হয়েছে। কিন্তু আজও লাখ লাখ শিক্ষার্থীর স্বার্থের বিষয়টি বাস্তবায়ন না হওয়া দুঃখজনক। কেমন আছেন অত্যন্ত সম্ভাবনাময় সেই বিষয়ের শিক্ষার্থীরা? ॥ মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট অধিদফতরের অবহেলা আর ব্যর্থতার কারণে নিজেদের ভবিষ্যত নিয়ে চোখে রীতিমতো অন্ধকার দেখছেন দেশের সরকারী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের হাজার হাজার শিক্ষার্থী। ১০ পলিটেকনিকের এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং বা পরিবেশ প্রকৌশল বিভাগের শিক্ষার্থীদের জন্য ১০ বছরেও সৃষ্টি করা হয়নি কর্মসংস্থানের কোন পদ। দু’একবার পদ সৃষ্টির উদ্যোগ নেয়া হলেও আজ পর্যন্ত কোন সুখবর নেই শিক্ষার্থীদের। বিশ্বব্যপী পরিবেশ রক্ষায় এ কোর্সের চাহিদা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এ প্রকৌশলীদের কাজের নতুন নতুন ক্ষেত্র তৈরি করা হচ্ছে। তবে দেশে ২০০৫ সালে কোর্স চালুর পর থেকে কেবল অবহেলায় দিন কাটছে শিক্ষার্থীদের। প্রতিবছর এ বিষয়ে শ’ শ’ দক্ষ প্রকৌশলী চার বছরের ডিগ্রী নিয়ে বের হচ্ছে, তবে কপালে জুটছে বেকারত্ব। যাদের নেই উচ্চ শিক্ষার কোন সুযোগও। এ অবস্থায় অত্যন্ত সম্ভাবনাময় এ বিষয় চালুর লক্ষ্যকে আজ প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা সরকারগুলোর অবহেলায় হতাশা প্রকাশ করে বলছেন, দেশের ১০ পলিটেকনিট ইনস্টিটিউটে এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং বা পরিবেশ প্রকৌশল বিভাগের প্রায় ৫ হাজার শিক্ষার্থীর জন্য সরকারী শিক্ষক আছেন মাত্র ৮ জন। একই সঙ্কট চলছে ইলেক্ট্রো মেডিক্যাল, মাইনিং বিষয়েও। এসব বিষয় পড়ালেখা করে শ’ শ’ শিক্ষার্থী বের হচ্ছে কিন্তু কর্মসংস্থানের কোন পদ সরকার সৃষ্টি করেনি। এমন সঙ্কট রেখে বছরের পর বছর ধরে কারিগরি শিক্ষার মতো প্রায়োগিক শিক্ষা প্রদান করা মানে হচ্ছে শিক্ষার নামে প্রহসন। রাষ্ট্রীয়ভাবে বছরের পর বছর গুরুত্বপূর্ণ খাত বলা হলেও এভাবে অবহেলার শিকার আর কতদিন? এ প্রশ্ন এখন সংশ্লিষ্ট সকলের। শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা বলছেন, কারিগরি শিক্ষা নিয়ে যতটা আলোচনা হচ্ছে, এ শিক্ষাখাতে সরকারের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন ততটাই পিছিয়ে রয়েছে। কারিগরি শিক্ষা নিয়ে যারা গবেষণা করছেন তারাও শঙ্কিত এই ভেবে যে, এ খাত নিয়ে কথা বেশি হলেও কাজ হচ্ছে কম। অবহেলার কারণে যেখানে আসার আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে শিক্ষার্থীরা। শিক্ষা অর্জন করেও হতাশায় ভুগছেন পলিটেকনিটগুলোর এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং, মাইনিং, ইলেক্ট্রো মেডিক্যালের মতো সম্ভাবনাময় বিষয়ের শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের দুর্ভাগ্যের কথা জানাতে গিয়ে ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক শামসুর রহমান বলছিলেন, অত্যন্ত সম্ভাবনাময় এ বিষয় হচ্ছে এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং। উন্নত বিশ্বের মতো দেশের পরিবেশের কথা ভেবে অনেক আশা নিয়ে এ বিভাগটি খোলা হয়েছিল। বিশ্বব্যাপী পরিবেশকে ক্ষতিকর দিক থেকে রক্ষায় এ কোর্সের চাহিদা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এ প্রকৌশলীদের কাজের নতুন নতুন ক্ষেত্র তৈরি করা হচ্ছে। আমাদেরও সে আশাই ছিল। কিন্তু আজ কোর্স চালুর পরও কেবল অবহেলায় দিন গুণছে আমাদের শিক্ষার্থীরা। তিনি বলেন, বহুবার কাজের সুযোগ সৃষ্টির জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সহায়তা চেয়েছি। তবে আজও ভাল ফল পাইনি। তিনি জানান, উন্নত বিশ্বের মতো আমাদের এ বিভাগের শিক্ষার্থীরাও তদের কারিকুলামে পাচ্ছে পরিবেশের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বিষয় জ্ঞানার্জনের সুযোগ। ওয়াসা, বর্জ্য পরিশোধনাগার (ইটিপি), দুর্যোগ ব্যবস্থাপনাসহ আধুনিক জীবনযাপনে প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের জ্ঞান এখন প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছে। কিন্তু এত বছর হয়ে গেলেও আজ পর্যন্ত নতুন একটি চাকরির পদ তাদের জন্য সৃষ্টি করা হয়নি। এর ফলে এ শিক্ষায় আসা হাজার হাজার শিক্ষার্থী ও তার পরিবার আজ হতাশায় নিমজ্জিত।
×