ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

স্প্লিন্টারবিদ্ধ ১৪ জন যন্ত্রণায় ছটফট করছে ঢাকা মেডিক্যালে

প্রকাশিত: ০৫:২৩, ২৬ অক্টোবর ২০১৫

স্প্লিন্টারবিদ্ধ ১৪ জন যন্ত্রণায় ছটফট করছে ঢাকা মেডিক্যালে

নিয়াজ আহমেদ লাবু ॥ গভীর রাত। বাবা-মা ও চাচাকে নিয়ে হোসেনী দালানের মূল গেটের ভেতরে মিছিলের সামনে লাইনে দাঁড়িয়েছিলাম। হঠাৎ বিকট আওয়াজ। গেটের সামনের টিউব লাইটটি ভেঙ্গে যায়। মুহূর্তেই চারদিকে অন্ধকার হয়ে যায়। এ সময়ে আরও দুটি বিকট আওয়াজ। ভয়ে মাকে চেপে ধরে চোখ বন্ধ করে রাখি। কান্নাকাটি করি। মাও আমাকে চেপে ধরে রেখে দেয়ালঘেঁষে বসে পড়েন। একটু পর চোখ খুলে দেখি কয়েকজন রাস্তার ওপর রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। ‘বাঁচাও বাঁচাও’ চিৎকার। এরপর মা আমার হাত ছেড়ে দিয়ে রাস্তায় পড়ে থাকা চাচা সাজ্জাদ হোসেন সঞ্জুকে (১৬) রক্তাক্ত অবস্থায় উদ্ধার করেন। সঞ্জু চাচাকে পরে হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানে মারা যান। বোমায় আমার হাত-পা দিয়ে রক্ত ঝরছিল। আমাকেও হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে বেডে কষ্ট ও যন্ত্রণায় এ কথাগুলো বলছিল নিহত সঞ্জুর ভাতিজি কেরানীগঞ্জের চড়াইল হাইস্কুলের তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্রী সাজিয়া সুলতানা স্নেহা (১১)। ওইদিন রাতে বাবা রাশেদ, মা সুমী, চাচু সঞ্জু তানভীর, রাজন, খালা আয়েশাসহ ৭ জন হোসেনী দালানে মিছিলে যোগ দিতে এসেছিলেন। কিন্তু বোমায় সঞ্জু চাচু মারা গেছেন। বাবা-মা সামান্য আহত হলেও বাকি সবাই আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি আছেন। এ শিশুটির মতো এই ঘটনায় আরও ১৫ জন স্পিøন্টার বিদ্ধ হয়ে একই হাসপাতালে ভর্তি আছেন। কারও মাথায়, কারও দুই হাত, কারও দুই পা ব্যান্ডেজে মুড়ানো। স্পিøন্টার বিদ্ধ শরীরে বহন করে ওরা কষ্ট ও যন্ত্রণায় ছটফট করছে। তাদের এক কথা তারা সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে যেতে পারবেন নাকি সারাজীবন শরীরে স্পিøন্টার বিদ্ধ যন্ত্রণা নিয়ে বেঁচে থাকতে হবে? এদিকে ঢাকা মেডিক্যালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডাঃ মিজানুর রহমান জানান, রবিবার দুপুর পর্যন্ত এই ঘটনায় আহত ১৬ জন ভর্তি আছেন। তাদের মধ্যে তিনজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। এদের মধ্যে জামাল উদ্দিন (৫০) নামে একজনকে মুমূর্ষু অবস্থায় আইসিইউতে রাখা হয়েছে। ১১ বছরের সোহান নামে এক শিশুকে অপারেশন করা হয়েছে। তিনি জানান, গ্রেনেড বিস্ফোরণে আহত সকলকে চিকিৎসার ব্যয় সরকার বহন করছে। ২০৬ নম্বর ওয়ার্ডে আহত স্কুলছাত্রী স্নেহার শিয়রে বাবা রাশেদ জানান, শুক্রবার রাতে হোসেনী দালানে প্রথম তাজিয়া মিছিলে যোগ দেয়ার জন্য ছোট ভাই সাজ্জাদ হোসেন সঞ্জু, স্ত্রী সুমী, মেয়ে স্নেহাসহ সাতজনকে নিয়ে ইমামবাড়ার মূল ফটকের ভেতরে লাইনে দাঁড়ানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। হঠাৎ পর পর তিনটি বোমা বিস্ফোরিত হয়। এতে শত শত মানুষের দৌড়াদৌড়ি। হাত দিয়ে ধরে থাকা ছোট ভাই সঞ্জু হাত-পায়ে-পিঠে স্পিøন্টার বিদ্ধ হয়ে রক্তাক্ত অবস্থায় মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। আমি স্তব্ধ হয়ে যাই। পরে ভাইকে ঢাকা মেডিক্যালে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাত ৪টার দিকে সে মারা যায়। তিনি জানান, সঞ্জু কেরানীগঞ্জের চরাইল হাইস্কুলের সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র ছিল। ওই স্কুলে তার মেয়ে স্নেহা তৃতীয় শ্রেণীতে পড়াশোনা করে। নিহত সঞ্জুর বাবার নাম নাসির মিয়া। ৫ ভাই ২ বোনের মধ্যে সঞ্জু পঞ্চম। তারা কেরানীগঞ্জের হাবিবনগর গোলাপবাগ এলাকায় সপরিবারে থাকত। এদিকে শনিবার দুপুরে সঞ্জুর লাশের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করেন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সোহেল মাহমুদ। তিনি জানান, নিহত সাজ্জাদ হোসেন সঞ্জুর শরীরে সাতটি স্পিøন্টার বিদ্ধ হয়েছে। এর মধ্যে একটি স্পিøন্টার (লোহার দ-) তার পেছন থেকে ঢুকে ফুসফুসে আঘাত করে। এতে তার মৃত্যু হয়েছে। স্পিøন্টারের লোহার দ-টি ছিল বড় মাপের। তার ফুসফুস থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। ২০৬ নম্বর বেডে হালিমা বেগম হাত-পায়ে স্পিøন্টার বিদ্ধ অবস্থায় যন্ত্রণায় ছটফট করছিলেন। তিনি জানান, হোসেনী দালানের ভেতরে কবরস্থানের সামনে রাস্তায় মিছিলে লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলাম। দেড় বছরের ছেলে কায়েসকে কোলে নিয়ে স্বামী মনিরও দাঁড়িয়েছিল। তারপর হঠাৎ বিকট আওয়াজ পরপর তিনটি বোমা বিস্ফোরণ। এতে হাতে ও পায়ে স্পিøন্টার বিদ্ধ হয়ে রক্তাক্ত অবস্থায় রাস্তায় পড়ে যাই। ওঠার চেষ্টা করেও পারিনি। মানুষ তার শরীর চাপা দিয়ে ছুটোছুটি করেছে। পরে এক লোক তাকে এক কোণে নিরাপদ স্থানে রেখে দৌড়ে বের হয়ে যান। ওই বিস্ফোরণে তার পরিবারের আরও চার সদস্য আহত হয়েছেন। এর মধ্যে তার দেড় বছর বয়সী ছেলে কায়েসও রয়েছে। বাকিরা হলেনÑ স্বামী মনির হোসেন (৩৫) ভাশুর নূর হোসেন (৪০) খালাত ভাই কামাল হোসেন আরিফ (২২)। আহত হালিমা জানান, হোসেনী দালানের ইমামবাড়াতে ছেলে কায়েসের নামে মানত দিতে গিয়েই তারা বোমা হামলার শিকার হন। পরিবারের সদস্যদের নিয়ে বংশাল এলাকার কসাইটুলির এলাকায় বসবাস করেন তারা। ১০১ নম্বর বেডে হালিমার খালাত ভাই কামাল হোসেন আরিফ জানান, হোসেনী দালানের মূল গেটের ভেতরে সামনের মিছিলের জন্য লাইনে দাঁড়িয়েছিলাম। হঠাৎ একটি বিকট আওয়াজ। গেটের সামনের টিউব লাইটটি ভেঙ্গে যায়। চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। ওই অবস্থায় আরও পর পর দু’টি বিকট আওয়াজে বিস্ফোরণ ঘটে। মুহূর্তে মিছিল ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। বাঁচাও বাঁচাও আর্তনাদ। শিশু, নারী ও পুরুষ রক্তাক্ত অবস্থায় মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। তাদের চাপা দিয়ে মানুষ ছোটাছুটি করছে। তখনও মনে নেই। আমার হাত-পা দিয়ে রক্ত ঝরছে। ওঠার চেষ্টা করছিলাম। আর পারলাম না। যেন হাত-পা অবশ হয়ে যাচ্ছে। এক পর্যায়ে আমি লুটিয়ে পড়লাম। আমাকে চাপা দিয়ে মানুষ ছুটে পালাচ্ছে। এরপর আর মনে নেই। এর কতক্ষণ পর চোখ খুলে দেখি আমি হাসপাতালের বেডে। তার দুই পা ও পিঠে এবং হাত ব্যান্ডেজে মোড়ানো। যন্ত্রণায় ছটফট করছেন। বার বার বলছিলেন আমি ভাল হয়ে যাব তো। ২০৬ নম্বর ওয়ার্ডে আহত স্ত্রী রুনা বেগমকে (৩০) বেডে শিয়রে বসে আছেন নাজির উদ্দিন। চোখেমুখে আতঙ্কের ছাপ। যেন বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা এখনও তাদের তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। বোমা বিস্ফোরণে তিনি নিজে। তার ১২ বছর বয়সী ছেলে সিফাত ও মেয়ে শ্রাবন্তীকে (৯) আহত হয়েছেন। সন্তানরা সুস্থ থাকলেও স্ত্রীর অবস্থা আশঙ্কাজনক। নাজির উদ্দিন জানান, রাত ১২টার দিকে হোসেনী দালান এলাকায় যাই। পুরো এলাকাটি একবার ঘুরে দেখি। পরে মিছিলে যাওয়ার জন্য লাইনে দাঁড়াই। লাইনে দাঁড়িয়েই মোবাইলে ভিডিও করছিলাম। এ সময় বোমা বিস্ফোরণ হলে বোমার একটি অংশ হাতে ও মোবাইলে পড়ে। এতে মোবাইলটি পুড়ে যায়। পরে দেখি, মাথায় আঘাত পেয়ে স্ত্রী মাটিতে পড়ে আছে। সন্তানরাও বোমাতে আহত হয়। পরে লেগুনাতে করে স্থানীয়রা আমাদের ঢাকা মেডিক্যালে নিয়ে আসেন। হোসেনী দালানে গ্রেনেড বিস্ফোরণে গুরুতর আহত জামাল উদ্দিন (৫৫) ঢামেকের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন রয়েছেন। আহত জামালের ভাই জামিল জানান, সাত ভাই-বোনের মধ্যে জামাল সবার বড়। স্ত্রীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হওয়ার পর পরিবারের সঙ্গেই লালবাগের পোস্তায়বংশাল কাজী রিয়াজ উদ্দিন লেনের একটি ভাড়া বাসায় থাকতেন তারা। জামাল কসমেটিকস ফেরি করে বিক্রি করতেন। দিনে দুই শ’ থেকে তিন শ’ টাকা আয় করতেন। তা দিয়ে সংসার চলতেন। তিনি জানান, টানাপোড়েনের সংসারে তাদের জন্য চিকিৎসা ব্যয় করা খুব কঠিন। ইতোমধ্যে তার পেছনে প্রায় ১০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। তাদের পাশে কেউ-ই এগিয়ে আসেনি। সরকারের তরফ থেকে ৫ হাজার টাকা দেয়া হয়েছে। দালান কমিটির এক সদস্য এক হাজার টাকার ওষুধ কিনে দিয়েছেন। জামালের পরিবার সরকারের সহযোগিতা কামনা করেছেন। জামিল জানান, ডাক্তাররা স্পষ্ট করে কিছু বলেননি। তারা ওষুধ আনতে বলছেন। আমরা এনেছি। তারা চেষ্টা করছেন বলে জানিয়েছেন। আহত নাজির উদ্দিন বলেন, ‘আমরা গরিব মানুষ। যা আয় করি তাতে ঘরভাড়া ও খাওয়ায় ফুরিয়ে যায়। কখনও টাকা-পয়সা জমাতে পারিনি। এখন এত টাকা কই পাব? এদিকে হোসেনী দালানের ঘটনায় আহত মাহুতটুলী প্রাইমারী স্কুলের ৫ম শ্রেণীর ছাত্র সোহানকে (১১) রবিবার দুপুরে অপারেশন করা হয়েছে। ঢামেক হাসপাতালে জরুরী বিভাগের তৃতীয় তলায় পোস্ট অপারেটিভে কথা হয় তার মা পারভীনের সঙ্গে। তিনি জানান, সেদিনের মধ্যরাতে প্রথম তাজিয়া মিছিলে অংশ নিতে ছেলে সোহনকে নিয়ে গিয়েছিলেন। পর পর তিনটি বোমা বিস্ফোরণ ঘটে। তার ছেলের মাথা, হাতে ও পায়ে স্পিøন্টার বিদ্ধ হয়ে রক্তাক্ত হয়েছে। তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, আমার ছেলে সোহান সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে যেতে পারবে তো? আগামী মাসে পঞ্চম শ্রেণীর সমাপনী পরীক্ষা অংশ নিতে পারবে তো? এই আশঙ্কা তার। আহতদের চিকিৎসা খরচ সরকার দেবে- নাসিম ॥ হোসেনী দালান প্রাঙ্গণে বোমা বিস্ফোরণের ঘটনায় আহতদের চিকিৎসা ব্যয় সরকার বহন করবে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম। শনিবার দুপুর আড়াইটায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে শনিবার দুপুর আড়াইটায় বোমা বিস্ফোরণে আহতদের দেখতে গিয়ে তিনি সাংবাদিকদের এ কথা বলেন। স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, বোমা বিস্ফোরণের ঘটনায় যারাই আহত হয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে এসেছেন তাদের সবাইকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে চিকিৎসাসেবা দেয়া হচ্ছে। তাদের সকল ব্যয় সরকার বহন করবে। তিনি বলেন, ‘আহতদের চিকিৎসায় ডাক্তাররা রাত থেকেই কঠোর পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। ইতোমধ্যে ৬৩ জনকে চিকিৎসা দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে একজন মারা গেছেন। ১৪ জন চিকিৎসাধীন। একজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। আগামীকাল তার অপারেশন করা হবে। বর্তমানে তাকে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিউ) রাখা হয়েছে। সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে মোহাম্মদ নাসিম বলেন, এটা অত্যন্ত পরিষ্কার, দেশকে অস্থিতিশীল করার জন্যই এ বোমা হামলা করা হয়েছে। তিনি বলেন, ইতোমধ্যে বেশ কয়েকজনকে পুলিশ আটক করেছে। বাকিদের খুব তাড়াতাড়িই আইনের আওতায় আনা হবে।
×