ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

শীত মানেই সবজি মৌসুম

শাকের রাজা পালং মন্ত্রী পুঁই

প্রকাশিত: ০৫:৫৬, ২৪ অক্টোবর ২০১৫

শাকের রাজা পালং মন্ত্রী পুঁই

জিগজাগ আকৃতির সবুজ সবজি করলা রান্না হলে অনেকে এখনও পাতে নেয় না। স্বাদে তেতো। বাংলাদেশের এই করলাই জাপানীদের কাছে অতি প্রিয়। সবচয়ে মজার বিষয় হলো, ওরা এই সবজি কাঁচা খায়। ঝিঙে নামের সবজিটি বাংলা সাহিত্যে উপমা হিসেবে এসেছে। যেমন এসেছে পটোল। সুন্দর চোখের উপমার একমাত্র সবজি পটোল, বলা হয় পটোল চেরা চোখ। পটোলকে সমান্তরালভাবে চিরলে মানুষের চোখের সুন্দর আকৃতি ফুটে ওঠে। অনেকটা মিষ্টি স্বাদের সবজি কাঁকরুল ছোটদের খুবই পছন্দ। বাংলার আনাচে কানাচে কত যে সবজি আছে...! একেক অঞ্চলে একেক সবজি সেই এলাকাকে পরিচিত করে আজও। যেমন পূর্বাঞ্চলের গফরগাঁয়ের বেগুন। আকারে বড়। এই বেগুন গফরগাঁওকে এতটাই পরিচিতি দিয়েছে, আজও তা ম্লান হয়নি। গফরগাঁও রেল স্টেশনে ট্রেন থামলে প্লাটফর্মে বেগুন মেলে। বাজারে বড় বেগুন দেখলেই বলা হয় গফরগাঁওয়ের বেগুন। উত্তরাঞ্চলের বগুড়ার আলু, জয়পুরহাটের কচুর লতি, ঈশ্বরদীর কাঁচা পেপে আশির দশকে রফতানির তালিকায় উঠেছে। তার আগে ষাটের দশকে হল্যান্ডের সাদা গোল আলু আমদানি হয়ে আসে। বছর কয়েকের মধ্যে দেশজুড়ে আলুর আবাদ সম্প্রসারিত হয়। আশির দশকের মধ্যভাগে ভাতের পাশাপাশি সম্পূরক খাবার হিসেবে আলুর ওপর জোর দেয়া হয়। বগুড়ার আঠালো ছোট্ট হাগরাই আলু দেশজুড়ে এতটাই প্রিয় যে কেউ বগুড়া এলে দইয়ের সঙ্গে নেয় হাগরাই। ভর্তায় এমন স্বাদের আলু আর কোথাও হয় না। বর্তমানে দেশে সবজির আবাদ এতটাই বেড়েছে যে মানুষ নিজের গরজে বসতভিটার উঠানে ও বহির্আঙ্গিনায় সকল ধরনের শাক লাউ কুমড়া, চাল কুমড়ার চাষ করছে। যাদের উঠানে জায়গা একটু বেশি তারা শীতকালীন সবজি যেমন ফুল কপি, বাঁধা কপি, মুলার চাষ করছে। উত্তরাঞ্চলের প্রতিটি এলাকার গ্রামে জাংলা দিয়ে করলা পটোল ঝিঙে চিচিঙ্গার আবাদ হচ্ছে। দেশের সবজি এখন বিদেশ বিভুঁইয়ে রফতানি হয়। দেশের কয়েকটি প্রতিষ্ঠান রফতানির জন্য বিভিন্ন জেলা থেকে সবজি সংগ্রহ করে সাভারে তাপানুকূল ঘরে রেখে এয়ার ফ্রেইটে বিদেশে পাঠায়। নিকট অতীতে গরিবের খাদ্য তালিকায় ছিল কচু ঘেচু। আজকের দিনে এই সবজি অতি উন্নতমানের খাবার। কোনভাবেই আর হেলাফেলা করা যায় না। এমন অনেক সবজি আছে যা ঔষধি খাবার হিসেবে চিকিৎসাশাস্ত্রে গৃহীত হয়েছে। হৃদরোগী, ডায়াবেটিস রোগী, অম্ল বা এ্যাসিডের রোগীদের সব সময়ই সবজি খেতে পরামর্শ দেয়া হয়। হৃদরোগীদের বলা হয় পরিমিত মাত্রায় ভাতের সঙ্গে বেশি সবজি খেলেও ক্ষতি নেই। তাদের জন্য রেড মিট ও চর্বি জাতীয় খাবার নিষিদ্ধ। একই পথ্য দেয়া হয় ডায়াবেটিস রোগীদের। কাঁচাকলাও সবজি হিসেবে এসে রোগীর পথ্য হয়েছে। একটা সময় মধ্যবিত্তের কেউ কাঁচাবাজারের সওদাপাতিতে কচু কিনলেও ছালার ব্যাগের ওপরে রাখত না লাজ শরমের কথিত সঙ্কোচে। মানুষের দুর্দশার কথা বর্ণনা করতে গিয়েও উপমা দেয়া হতো কচু ঘেচুর। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর একদার ক্ষুধা নিবারণের কথিত নিম্নমানের খাবারটি আজ পাঁচ তারকা হোটেলের প্রেস্টিজিয়াস ও ডিলিসিয়াস খাবার। গ্রামীণ জীবনের খাবার ঢেঁড়স বা ভেন্ডি ফাইভ স্টারে গিয়ে ইংরেজি নামে পরিচিত হয় ‘লেডিস ফিঙ্গার’। ঢেঁড়স ও কচু হয়েছে হাই প্রোটিন ভেজিটেবল। গ্রামীণ জীবনে শিশুদের রাতকানা রোগ নিরাময়ে ছোট মাছ ঢেলা মওয়ার সঙ্গে কচু খাওয়ার প্রচার কার্যক্রম আজও চলে। গ্রামের সাধারণ মানুষের কাছে কচু, বইকচু, মানকচু, পানিকচু, ওলকচু, কচুলতিসহ সকল কচুই প্রিয় খাবার। পাতা কচু দিয়ে ইলিশের মাথা রান্না ঠিকমতো করতে পারলে সুস্বাদ মুখে লেগে থাকে। কচুর সঙ্গে মাটির নিচের ও ওপরের ওল খাদ্য তালিকায় আরেক কাঠি সরেস। ওল খেলে মুখ চুলকায় এমন ভাবনাও আজ দূর হয়েছে। ওল ভর্তা, ওল ভাজিতে সামান্য টকের মিশ্রণ সুস্বাদু করে তোলে। কামরাঙ্গা সবজির ভূবনে রাঙা ভাবির মতোই স্থান করে নিয়েছে। লাউয়ের যে কত ধরন! ছাচি লাউ, চাল কুমড়া, মিষ্টি কুমড়া বিদেশে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে। ছোট চিংড়ি লাউ দিয়ে রান্না করলে আহা...। শাকের কদর আরও কয়েক কাঠি উপরে। বলা হয় শাকের রাজা পালং, মন্ত্রী পুঁই শাক। বাকিরা শাকের প্রজা ইত্যাদি। ডাটা শাক, কদু শাক, লাল শাক, মুলা শাক, পেঁয়াজের ফুলকাকেও এখন পেঁয়াজ শাক বলা হয়। সরষের শাক, পাট শাক, শাকের নাতিপুতি। সরষের মধুও আছে, শাকও আছে। দুধকুষি, বরবটি, শিম শীত মৌসুমের অন্যতম সবজি। টমেটোর কথাই আলাদা। বলা হয়, এ হলো বনেদি সবজি। এর সঙ্গী গাজর। বর্তমানে শহরে গ্রামে বিয়ে শাদিসহ নানা অনুষ্ঠানে টমেটো না থাকলেই নয়। গ্রামের প্রবীণ ও শহরের পুরনো দিনের মানুষ টমেটোকে আদর করে ‘আমাবাগুন’ বলেও ডাকে। একটা সময় কচুর লতি ফেলে দেয়া হয়েছে। জয়পুরহাটের পাঁচবিবি ও আক্কেলপুর উপজেলার কচুর লতি বিদেশে রফতানি হচ্ছে। বিদেশের কিছু সবজিও এ দেশে এসেছে, যেমন এ্যাসপারাগাস। আমেরিকা ইউরোপ অস্ট্রেলিয়া মহাদেশ এবং এশিয়ার কিছু এলাকায় এ্যাসপারাগাস জনপ্রিয় সবজি। এর পুষ্টিমান বেশি। শাক জাতীয় এই সবজি উত্তরাঞ্চলের বগুড়া, শিবগঞ্জ ও জয়পুরহাট অঞ্চলে চাষ হচ্ছে। কৃষক এ্যাসপারাগাসের সঙ্গে লেটুস পাতা, রেডক্যাবেজ, সুইটকর্ন, ব্রনকলি, চেরিটমেটো, ক্যাপসিকামসহ বিদেশী প্রায় দশ জাতের সবজি আবাদ করছে। চাইনিজ রেস্তোরাঁয় এ্যাসপারাগাস ও ক্যাপসিকাম, চেরিটমেটো বিশেষ ধরনের সবজি ও সালাদের সঙ্গে ব্যবহার করা হচ্ছে। হালে দেশী সবজির সঙ্গে বিদেশী কিছু সবজির সংমিশ্রণ ঘটেছে, তবে কোনভাবেই দেশী সবজির কাছে টিকতে পারেনি। গ্রামের যে সবজি গৃহস্থ ও কিষাণ বাড়ির উনুনে হরহামেশাই তরকারির সঙ্গে উঠছে, নগর মহানগরীর বড় হোটেল, ঢাকার অভিজাত ও তারকাখচিত হোটেলে পাকা শেফের মাধ্যমে বিশেষ ব্যবস্থায় রান্না হয়ে দেশের সবজির মানকে আরও এগিয়ে নিয়ে গেছে। সবচেয়ে বড় কথা- দেশ এখন সবজি আবাদে স্বয়ংসম্পন্ন হয়ে চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে পাড়ি দিয়েছে। Ñসমুদ্র হক, বগুড়া থেকে
×