ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

পাঁচ হাজার হাজীর বরাদ্দ হাতিয়ে নিয়েছে একটি চক্র

মক্কায় হজ সহায়তা তহবিল নিয়ে হরিলুটের অভিযোগ

প্রকাশিত: ০৫:১৮, ১৪ অক্টোবর ২০১৫

মক্কায় হজ সহায়তা তহবিল নিয়ে হরিলুটের অভিযোগ

বাবুল হোসেন, মক্কা থেকে ॥ জয়পুরহাটের হাজী মশিউর রহমান হজে আসার পর হঠাৎ অর্থসঙ্কটে পড়েছেন- এমন আবেদনের ওপর নগদ ৫০০ রিয়াল (বাংলাদেশী টাকায় ১০ হাজারের বেশি) বরাদ্দ দেয়া হয়েছে মক্কার বাংলাদেশ হজ মিশন থেকে। এমন খবর জানার পর বিস্ময়ে হতবাক অবস্থাসম্পন্ন এই হাজী। মক্কার বাংলাদেশ হজ মিশনে মশিউর রহমান এই প্রতিবেদকসহ উপস্থিত হাজীদের জানান, তিনি হজ মিশনে সাহায্যের জন্য কোন আবেদনই করেননি। এমনকি এই ধরনের কোন আবেদন কিংবা সাদা কাগজে কারও কাছে স্বাক্ষর করেননি। অথচ তার নাম পরিচয়ে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ৫০০ রিয়াল। তিনি হাজীদের নিয়ে এ রকম অবিশ্বাস্য জালিয়াতি ও কারসাজির বিষয়টি তদন্তের জন্য সরকারের উর্ধতন কর্তৃপক্ষের কাছে জোর দাবি জানান। কেবল এই মশিউর রহমানই নয়, হজ মৌসুমে ভুয়া নাম পরিচয় দিয়ে এভাবে প্রত্যেক হাজীর বিপরীতে নগদ ৫০০ রিয়াল করে হাতিয়ে নিচ্ছে একটি চক্র। শরীয়তপুরের মোসলেম উদ্দীন ও ঝালকাঠির নিজাম উদ্দিনের নামেও তোলা হয়েছে সরকারী সহায়তার এই অর্থ। অভিযোগ রয়েছে, হজ মিশনের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা ও হাবের একশ্রেণীর অর্থলোভী নেতা সরকারী বরাদ্দের এই অর্থ লুটপাট করে খাচ্ছে। বিষয়টি এরই মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর দফতর অবগত হয়েছে জেনে মক্কায় অবস্থানরত ধর্ম মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব শহীদুজ্জামান হজ মিশনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সতর্ক করে দিয়েছেন। অতিরিক্ত সচিব জনকণ্ঠকে জানান, হজ করতে এসে হঠাৎ অর্থ সঙ্কটে পড়া হাজীদের সহায়তার তহবিল নিয়ে নয়ছয় করার বিষয়টি হাজীদের কাছ থেকে শুনে তিনি সংশ্লিষ্টদের আরও সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি আরও জানান, প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকেও এ রকম অভিযোগ তাঁর কানে এসেছে। প্রধানমন্ত্রীর দফতর হজ মিশনকে বিষয়টি সতর্কতার সঙ্গে দেখার পরামর্শ দিয়েছে বলে জানা গেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সরকার প্রতিবছর হজ করতে আসা হাজীদের সহায়তা দিতে মক্কার বাংলাদেশ হজ মিশনে এককালীন থোক বরাদ্দ দিয়ে আসছে। হজের সময় কোন হাজীর টাকা হারিয়ে গেলে কিংবা অন্য কোন কারণে হঠাৎ অর্থসঙ্কটে পড়ে গেলে তাদের আপদকালীন সহায়তা দিতে এই তহবিল চালু করে। বিশেষ করে হজ শেষে দেশে ফেরা পর্যন্ত তার খাওয়া ও যাতায়াতে সহায়তার জন্যই সরকার এই তহবিল থেকে হাজীদের বরাদ্দ দিয়ে আসছে। এই বরাদ্দ পেতে হাজীদের আবেদন নিয়ে স্বশরীরে আসার নিয়ম রয়েছে। এ রকম নিয়মকে পাশ কাটিয়ে অর্থলোভী ও সুযোগ সন্ধ্যানী চক্রটি হাজীদের ভুয়া নাম পরিচয় ব্যবহার করে মোটা অঙ্কের বরাদ্দ লুটপাট করে খাচ্ছে। প্রশাসনিক দলে আসা একাধিক সদস্যের নামে উত্তোলন করা হয়েছে এই তহবিলের অর্থ। প্রত্যক্ষদর্শীর মতে এবার এই খাতে যত বরাদ্দ দেয়া হয়েছে তার উচ্চপর্যায়ের তদন্ত প্রয়োজন। ঢাকা থেকে আসা হাজী আশরাফুল আলম এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে জানান, মক্কার হজ মিশনে হাজীদের সহায়তায় তহবিল নিয়ে এ রকম লুটপাটের কারবার মেনে নেয়া যায় না। হাজীদের নামে সরকারী বরাদ্দের টাকা হরিলুট প্রশ্নে সংশ্লিষ্ট শাখার কোন কর্মকর্তা কথা বলতে চাননি। এমনকি এই খাতের বরাদ্দ ও কত বিলি-বণ্টন হয়েছে তাও জানাতে অপারগতা প্রকাশ করেন কর্মকর্তারা। প্রতারণার শিকার পুলিশ কর্মকর্তা ॥ এজেন্সির মাধ্যমে এবার হজে যেতে নগদ সাড়ে ৪ লাখ টাকা লেনদেন করেছিলেন ডিএমপিতে কর্মরত এক পুলিশ কর্মকর্তা। কিন্তু এজেন্সির প্রতারণার কারণে এই পুলিশ কর্মকর্তার ভিসা হয়নি। ফলে শেষ সময়ে বাদ পড়েছিলেন তিনি। তবে নাছোরবান্দা পুলিশ কর্মকর্তার হুঙ্কারে বাদ পড়া হাজীদের সঙ্গে তাকে ‘বারকোড’ ভিসায় মক্কায় নিয়ে আসে এক প্রভাবশালী এজেন্সি। রাখা হয় সরকারী ভাড়ার সাত নম্বর বাড়িতে। সৌদি সরকারের দেয়া এই ‘বারকোড’ ভিসা পুলিশ কর্মকর্তার পাওয়ার কথা নয়। প্রচার রয়েছে, একটি মহলের কাছ থেকে এজেন্সির মোটা অঙ্কের টাকায় কেনা এই ‘বারকোড’ ভিসায় পুলিশ কর্মকর্তাকে না জানিয়ে তড়িঘড়ি করে হজে নিয়ে আসা হয়। বলা হয় এজেন্সির মাধ্যমেই ভিসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। মক্কার বাড়িতেও রাখা হয় তাকে সরকারী ব্যবস্থাপনায় আসা হাজীদের সঙ্গে। কিন্তু হজ শেষে এ নিয়ে কানাঘোষা শুরু হলে বিপাকে পড়ার আশঙ্কায় বিব্রত পুলিশ কর্মকর্তা নির্ধারিত সময়ের আগেই গত ১২ অক্টোবর পাড়ি জমান দেশে। বারকোড ভিসা বিক্রি ॥ সৌদি সরকার চলতি হজ মৌসুমে বাংলাদেশ সরকারকে ১২০০ ‘বারকোড’ ভিসা প্রদান করেছে। এসব ভিসায় আসা হাজীরা সৌদি আরবের মক্কা, মদিনা ছাড়াও জেদ্দা, রিয়াদ, দাম্মামসহ সৌদি আরবের যে কোন জায়গায় ভ্রমণ করার সুযোগ পাবেন। তবে অন্য হাজীদের ভিসায় মক্কা ও মদিনায় গমন সীমিত থাকে। সৌদি সরকার বাংলাদেশ সরকারকে রাষ্ট্রীয় উপহার হিসেবে এই বিশেষ ভিসা দিয়েছে। সরকারী ব্যবস্থাপনায় আসা ২৬৩ জন হাজী এই বারকোড ভিসায় হজে আসেন। অভিযোগ রয়েছে, কোন কোন এজেন্সির কাছে টাকার বিনিময়ে বারকোড ভিসা বিক্রি হয়েছে। আর এর নেপথ্যে রয়েছে মন্ত্রণালয়ের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী। হাব নেতাদের গা ঢাকা ॥ সরকারের বাড়তি কোটায় আসা পাঁচ হাজার হাজীর জন্য বরাদ্দের সরকারী টাকা ভাগ-বাটোয়ারা করে মক্কা ছেড়ে দেশে ফিরে গেছেন প্রভাবশালী হাব নেতৃবৃন্দ। হাবের সাবেক সভাপতি জামাল উদ্দীনের নেতৃত্বে এই ভাগ-বাটোয়ারা হয় বলে হাবেরই একাধিক নেতার অভিযোগ। ফলে অনেক নিরীহ হাব নেতা ও এজেন্সি সরকারী বরাদ্দের এই টাকা থেকে বঞ্চিত হয়ে হাপিত্যেশ করছেন মক্কায়। মক্কায় অবস্থানরত একাধিক ও বঞ্চিত হাব নেতা জানান, বিষয়টির অবিলম্বে নিষ্পত্তি না হলে তারা মক্কার বাংলাদেশ হজ মিশন কার্যালয় ঘেরাও করবেন।
×