আশরাফ মারওয়ান। মিসরের প্রাক্তন রাষ্ট্রনায়ক জামাল আবদুল নাসেরের জামাতা। বিংশ শতাব্দীর সর্বশ্রেষ্ঠ স্পাই হিসেবে তাকে চিহ্নিত করা হয়। তবে মিসরের এই বিলিয়নিয়ার ব্যবসায়ী কার পক্ষে গুপ্তচরবৃত্তি করতেন, সেটা স্পষ্ট নয়। কেউ বলেন ইসরাইলের পক্ষে, কেউ বলেন মিসরের পক্ষে আবার কেউ বলেন তিনি ছিলেন ডবল এজেন্ট। তার এই গুপ্তচর বৃত্তি নিয়ে ১৫ সেপ্টেম্বর প্রভাবশালী দৈনিক গার্ডিয়ান একটি নিবন্ধ প্রকাশ করে। নিবন্ধটি লেখেন সিমন পারকিন। আজ পড়ুন দ্বিতীয় কিস্তি...
আশরাফ মারওয়ানের জন্ম মিসরে ১৯৪৪ সালে। বাবা ছিলেন প্রেসিডেন্সিয়াল গার্ড ব্রিগেডে কর্মরত সেনা অফিসার। ২১ বছর বয়সে মারওয়ান কায়রো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফার্স্টক্লাস অনার্স ডিগ্রী নিয়ে কেমিক্যাল, ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেন। এরপর সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত হন যা তখন ছিল বাধ্যতামূলক। ১৯৬৫ সালে কায়রোর এক শহরতলীতে টেনিস খেলার সময় সপ্তদশী আকর্ষণীয় এক তরুণীর সঙ্গে তার পরিচয় হয়। ইনি প্রেসিডেন্ট নাসেরের তৃতীয় ও আদরের কন্যা। দু’জনের মধ্যে প্রেম গড়ে ওঠে। পরের বছর তারা বিয়ে করেন এবং এর মধ্য দিয়ে মারওয়ান এলিট মহলে প্রবেশ করেন। আরও দু’বছর তার সামরিক বাহিনীতে কাটে। এর পর তিনি রসায়নে মাস্টার্স করতে লন্ডনে চলে যান।
সেখানে থাকতে শোনা যায় মারওয়ানকে যে পারিবারিক ভাতা দেয়া হতো তাতে তিনি অসন্তুষ্ট ছিলেন। বলাবাহুল্য, আর্থিক দিক দিয়ে তিনি বরাবরই উচ্চাভিলাষী ছিলেন। শেষ পর্যন্ত বিপুল ঐশ্বর্যের মালিক হন যা ৪০ কোটি পাউন্ড স্টার্লিং ছাড়িয়ে গিয়েছিল। মারওয়ানের সম্পত্তির ছত্রছায়া কোম্পানির নাম ছিল কাবরা ইনভেস্টমেন্ট। কাবরার আরবী অর্থ আরও বড় হও। শোনা যায়, বাড়তি আয় যোগাড় করতে গিয়ে তিনি এক কুয়েতি শেখের স্ত্রীর মুগ্ধ দৃষ্টিতে পড়েন। এই মহিলা তাকে বাড়তি অর্থ যোগাতেন। কয়েক মাস পর ব্যাপারটা লন্ডনের মিসরীয় দূতাবাসের মাধ্যমে নাসেরের কানে যায়। তিনি জামাতাকে কায়রোয় তলব করেন এবং তাৎক্ষণিকভাবে মারওয়ানের কাছে তার কন্যার ডিভোর্স চান। কিন্তু মারওয়ান ও মোনা দু’জনেই বেঁকে বসেন। পরে নাসেরের রাগ ঠা-া হয়। তবে তিনি হুকুম জারি করেন যে মারওয়ানকে কায়রোয় থাকতে হবে। শুধুমাত্র কোর্স পেপার সাবমিট করার ও পরীক্ষা দেয়ার জন্য তিনি লন্ডনে যাবেন।
১৯৬৯ সালের বসন্তে একবার মারওয়ান লন্ডনে গিয়েছিলেন। লোক দেখানো অজুহাত দেখিয়েছিলেন যে, পেটের পীড়ার জন্য হার্লি স্ট্রীটের এক ডাক্তারকে দেখাতে চান। লন্ডনে এসে তিনি ইসরাইলী গোয়েন্দা সার্ভিসের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এই যোগাযোগ কিভাবে ঘটেছিল সে ব্যাপারে দু’তিন ধরনের নাটকীয় বিবরণ আছে যার একটির সঙ্গে আরেকটির মিল নেই। ইতিহাসবিদ হাওয়ার্ড ব্লাম তার ২০০৩ সালের বই ‘দি ইভ অব ডেসট্রাকশন’ এ উল্লেখ করেছেন, মারওয়ান তার সেই ডাক্তারকে এক্সরে রিপোর্ট দেখাতে গিয়ে একটা মোটা ফাইলও ধরিয়ে দেন যেখানে মিসর সরকারের রাষ্ট্রীয় নথিপত্র ছিল। তিনি ডাক্তারকে ফাইলটি লন্ডনে ইসরাইলী দূতাবাসে পৌঁছে দিতে বলেন। তিনদিন পর মারওয়ান হ্যাবডস ডিপার্টমেন্ট স্টোরে হেঁটে যাওয়ার সময় মোসাদের এক এজেন্ট তার সঙ্গে যোগাযোগ করেন।
কিন্তু মোসাদের সিনিয়র এজেন্টরা বলেছেন, ব্যাপারটা তা নয়। এরা সাবেক ইসরাইলী গোয়েন্দা বিশ্লেষক ইউরি বার-জোসেফের কাছে যে বিবরণ দিয়েছেন এবং যা কিনা তার ২০১০ সালের বই ‘হামালাচ’-এ সন্নিবেশিত আছে; সেটাও কম চিত্তাকর্ষক নয়। সেই বর্ণনাটা এ রকম : মারওয়ান ইসরাইলী দূতাবাসে গিয়ে সিকিউরিটি টিমের একজন সদস্যের সঙ্গে কথা বলার ইচ্ছা ব্যক্ত করেন। তাকে অন্ততপক্ষে দুই দুইবার ফিরিয়ে দেয়া হয়। শেষে তাকে একটা মেসেজ রেখে যাবার অনুমতি দেয়া হয়। মারওয়ান নিজের নাম-পরিচয় দেন এবং জানান, তিনি ইসরাইলী গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষে কাজ করতে চান। তিনি যোগাযোগের জন্য কোন ফোন নম্বর রেখে যাননি। তবে জানান যে, ওই দিনই বিকেলে আবার ফোন করবেন। বিকেলে ফোনও করেছিলেন তিনি তবে কোন সাড়া পাননি। এবার মারওয়ান তার হোটেলের ফোন নম্বর দেন।
মোসাদের ইউরোপীয় প্রধান স্যামুয়েল গোরেন সে সময় লন্ডনে ছিলেন। গোরেন মারওয়ানের মেসেসটা দেখেন এবং মুহূর্তের মধ্যে তাকে চিনে ফেলেন। মোসাদ সম্ভাব্য রিক্রুট হিসেবে ইতোমধ্যে তার ওপর একটা ফাইল খুলে বসেছিল। গোরেন মারওয়ানের দেয়া নম্বরে ফোন করে তাকে তার হোটেল রুমে থাকতে বলেন। পরে আবার ফোন বেজে ওঠে। এবার তাকে হোটেলের কাছাকাছি একটা কাফেতে যেতে বলা হয়। মারওয়ান সেই কাফেতে প্রবেশ করেন। কাফের ভেতরে একটা টেবিলে জনৈক ব্যক্তি বসে পেপার পড়ছিলেন। তার কফির পেয়ালার পাশে মারওয়ানের ছবি রাখা ছিল; যে ছবিটা ৪ বছর আগে তার বিয়ের দিনে তোলা। মারওয়ান কাফেতে প্রবেশ করতেই লোকটি তার চেহারার সঙ্গে ওই ছবিটি মিলিয়ে দেখেন এবং প্রবেশপথের বাইরে দাঁড়ানো দ্বিতীয় ব্যক্তিকে মাথা নেড়ে সম্মতিসূচক ইঙ্গিত দেন। এবার দ্বিতীয় ব্যক্তি কাফেতে প্রবেশ করে সোজা মারওয়ানের কাছে গিয়ে বলেন, ‘মি. মারওয়ান! আপনার সঙ্গে পরিচিত হয়ে খুশি হলাম। আমার নাম মিশা।’ মারওয়ান উঠে দাঁড়িয়ে করমর্দন করলেন। যে লোকটা পেপার পড়ছিল তিনি গোরান। উনি উঠে চলে গেলেন। কেউ তা লক্ষ্য করল না। আর মিশার আসল নামের প্রথম অংশ দুবি। দু’জনের আলাপচারিতার মধ্যে মারওয়ান মিসরের বিভিন্ন মহলের সঙ্গে তার যোগাযোগের কথা উল্লেখ করে ইসরাইলীদের কি ধরনের তথ্য দিতে পারেন মিশাকে তা জানালেন। মারওয়ান একটা খাম টেবিলের ও প্রান্তে ঠেলে দিয়ে বললেন, ‘আমি আপনাদের কি দিতে পারি এটা তার একটা স্যাম্পল। এবার আমি কিছু চাচ্ছি না তবে আশা করব আমাদের পরের বারের সাক্ষাতে তা পুষিয়ে দেয়া হবে।’ তার ফি কত? ১ লাখ ডলার।
মারওয়ানের উদ্দেশ্য নিয়ে মোসাদের সন্দেহ ছিল। উনি কি ডবল এজেন্টের ভূমিকা নিয়ে ইসরাইলকে অসত্য তথ্য পরিবেশন করতে চাইছেন নাকি গোপন তথ্য তার শ্বশুরের কাছে পাঠানোর পরিকল্পনা করছেন; এর উত্তর দিয়েছেন মারওয়ান নিজে। মিশাকে তিনি বলেছেন, ১৯৬৭ সালের ৬ দিনের যুদ্ধে মিসরের পরাজয়ে তিনি আতঙ্কিত বোধ করছেন। তিনি সোজা বিজয়ীর পক্ষে থাকতে চান। এই বৈঠকের পর গোরানের সঙ্গে মিশা ফের মিলিত হন একটা ট্যাক্সিতে। দু’জনে ঐ ট্যাক্সি করে ইসরাইলী দূতাবাসে যাবার পথে মারওয়ানের দেয়া নথি পড়ে দেখেন। নথিগুলো নির্ভেজাল বলেই মনে হয়। গোরান সেদিন বলেছিলেন ‘এ ধরনের সূত্র থেকে এমন কিছু পাওয়া হাজার বছরের মধ্যে একবারই ঘটে।’ আরেক মোসাদ এজেন্ট ইতিহাসবিদ হাওয়ার্ড ব্লাম বলেন, ‘ব্যাপারটা এমন যেন আমরা নাসেরের শয্যাসঙ্গিনী কাউকে পেয়ে গেছি।’ মোসাদের অভ্যন্তরে মারওয়ানের ডাকনাম ছিল ‘এঞ্জেল’। তাকে যে যথেষ্ট সম্মানের সঙ্গে গ্রহণ করা হতো এটাই তার প্রমাণ।
ক্রমশ...
সূত্র : গার্ডিয়ান
শীর্ষ সংবাদ: