ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আবুল মাল আবদুল মুহিত

ছেলেবেলা ও ছাত্রজীবন

প্রকাশিত: ০৫:৩৯, ১০ অক্টোবর ২০১৫

ছেলেবেলা ও ছাত্রজীবন

শৈশবের স্মৃতি (৯ অক্টোবরের পর) আমার শৈশবের দু’টি স্মৃতি বেশ ভাল মনে আছে। সেটি হলো আব্বার প্রায়ই কলকাতা গমন। আব্বা কলকাতা থেকে এলে সেটা ছিল আমাদের একটি খুশির সকাল। তিনি কলকাতা থেকে নানা ফল, পাটালি গুড়, মিষ্টি, নানা জাতের খাবার এবং মাঝে-মধ্যে আমাদের জন্য পোশাক নিয়ে আসতেন। একটি পোশাক আমার খুব পছন্দের ছিল। সেটি ছিল সিল্কের স্যুট-একটি হাফ শার্ট এবং তার সঙ্গে গেলিস দিয়ে লাগানো শর্ট। আব্বা ১৯৩৩ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫ বছরের জন্য সিনেটের ফেলো হন। সেই কারণে তিনি কলকাতায় প্রায় প্রতিমাসে যেতেন। পরবর্তীকালেও তার কলকাতায় সচরাচর ভ্রমণ বহাল ছিল। কলকাতায় তার আশ্রয় ছিল নানাবাড়ি মৌলভী আবদুল করিম সাহেবের ৩৩/১, ওয়েলেসলী স্ট্রীট রোড (আমি সেই বাড়িটি ১৯৫২ সালে দেখতে যাই, তখন সেখানে অনেক লোক জবর দখল করে বসবাস করতো)। এই বাড়ি এবং করায়া বাজারে তার আর একটি বাড়ি এই দুটি সম্পত্তির আয় দিয়ে তিনি ১৯১৬ সালে একটি শিক্ষা ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেন। এখান থেকে মুসলমান ছাত্রদের পড়াশোনার জন্য বৃত্তি দেয়া হতো এবং ইসলাম প্রচারের জন্য অর্ধেক আয় ব্যবহার করা হতো। এই আয় ব্যবহার করার আরও একটি শর্ত ছিল যে, তার ৫০ শতাংশ সিলেটের ছাত্র বা প্রতিষ্ঠানের জন্য ব্যবহার করা। পড়াশোনার জন্য বৃত্তি ‘করজে হাসানা’ হিসেবে দেওয়া হতো; অর্থাৎ প্রত্যেক বৃত্তিধারীকে অঙ্গীকার করতে হতো যে, তিনি রোজগার করার পর একইভাবে একজন শিক্ষার্থীকে পড়াশোনা করতে সাহায্য করবেন। এই ফাউন্ডেশন বর্তমানে সচল আছে কি-না সে তথ্য আমার জানা নেই। শৈশবের অন্য স্মৃতিটি হলো আব্বাকে ঘিরে। আব্বা আমাদের মজার মজার গল্প শোনাতেন। আম্মাসহ আমরা সবাই গোল হয়ে সম্ভবত আম্মা-আব্বার শোবার ঘরে বসতাম। প্রথমে তো পাঁচজন ভাইবোন ছিলাম। আব্বা মোটা মোটা বই থেকে ইংরেজীতে পড়ে সুয়োরানি দুয়োরানির বা ঘুমন্ত রাজকন্যার কাহিনী আর দৈত্য-দানবের কিসসা শোনাতেন। বড় রানী ছোট ভাল রানীদের কী রকম অত্যাচার করতো বা সৎমা সুন্দর রাজকন্যাকে কেমন অবহেলা ও নির্যাতন করতো, কাজের মানুষের মতো ভাবতো, সেগুলো শুনে দুঃখ লাগতো। তারপরে যেই কোন পরী বা ভাল বুড়ো মহিলা বা দাইমা তাদের সাহায্যে আসতো এবং জাদুকরী ব্যবস্থার সহায়তায় তাদের উদ্ধার করতো বা জীবনে সুখ-শান্তি প্রতিষ্ঠা করতো, তখন খুব খুশি লাগতো। দৈত্য-দানবের গল্পে সব সময়ই কোন সৎ ও সাহসী ব্যক্তি অথবা উদ্যোগী রাজকুমার শত বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে তাদের শায়েস্তা করতো বা তাড়িয়ে দিত, সে সব কাহিনী শুনে আমরাও কখনো ভীত, কখনো উৎফুল্ল বা কখনো উত্তেজিত হয়ে যেতাম। কিসসা কাহিনীর ব্যাপারটাই হয়ে যেত বাস্তব উপলব্ধি বা অনুভূতির বিষয়। ১৯৪১ সালে আমরা দুই ভাই সম্ভবত মার্চ মাসে সিলেট সরকারী উচ্চ ইংরেজী বিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিই। আমার ভাই দিলেন চতুর্থ শ্রেণীর জন্যে এবং আমি তৃতীয় শ্রেণীর জন্যে। আমার ভাইকে তৃতীয় শ্রেণীতে ভর্তি হওয়ার উপযুক্ত ঘোষণা করা হলো। আমি কিন্তু ভর্তি পরীক্ষায় মোটেই পাস করলাম না। তখন সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ের হেডমাস্টার ছিলেন খান সাহেব মফিজুর রহমান। তিনি কবে ‘খান সাহেব’ উপাধি লাভ করেন তা আমার জানা নেই। খান সাহেবের বাড়িটি ছিল স্কুলের পাশে সুরমা নদীর পাড়ে এবং ঐ বাড়ির সিঁড়ি দিয়ে সুরমা নদীতে যাওয়া যেত। সম্ভবত খান সাহেবের এক ছোট মেয়ে বন্দুক নিয়ে খেলা করার সময় বন্দুকের গুলিতে নিহত হয়। এটিই খান সাহেবের জীবনে বহুদিন একটি ট্র্যাজেডি হয়ে থাকে। তার স্ত্রী অনেক আগেই মারা গিয়েছিলেন এবং সম্ভবত মেয়ের মৃত্যুর পর তিনি দ্বিতীয়বার পাণিগ্রহণ করেন এবং এই মহিলা সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়েরই এক সময়কার সহকারী প্রধান শিক্ষক ফটিক চান্দ সাহেবের বিধবা স্ত্রী ছিলেন। ফটিক চান্দ সাহেবের এক ছেলে শফিক নি¤œতম ক্লাস থেকেই আমার সহপাঠী ছিল। খান সাহেব অত্যন্ত দক্ষ প্রধান শিক্ষক ছিলেন। সম্ভবত ১৯৪৫ সালে শিলচর নর্মাল স্কুলের তিনি প্রধান শিক্ষক সুপারিনটেনডেন্ট পদায়িত হন এবং সেখান থেকেই অবসরে যান। তিনি প্রতিদিন একটি ছোট বেত হাতে সারা স্কুল ঘুরে দেখতেন এবং তার হাঁটা ছিল একেবারে নিঃশব্দে। যখন তখন তিনি কোন ক্লাসে বেশি আওয়াজ বা অন্য কোন রকম বিশৃঙ্খলা দেখলে তখনই ঢুকে পড়তেন। তাকে সবাই খুব ভয় করতেন। কিন্তু তিনি যে শাস্তি দিয়েছেন সেটা খুব কম লোকই দেখতে পেয়েছেন। তিনি নানা বিষয়ে শিক্ষাও দিতেন, যেমনÑ ইংরেজী, ইতিহাস এবং অংক। আমি ভর্তি পরীক্ষায় ব্যর্থ হলে আমার আব্বা একদিন হেডমাস্টার সাহেবের বাসায় আমাকে নিয়ে গেলেন। মনে হলো তারা বেশ ঘনিষ্ঠ। তিনি প্রধান শিক্ষককে জানালেন যে, আপনি আমার দুটি ছেলের মধ্যে যেটি খুবই ভাল তাকে নিলেন না। আমার অন্য ছেলেটি তো পরীক্ষা দিয়ে ভর্তি হয়ে গেল। তাদের বয়সের তফাৎ দু’বছর। কিন্তু তারা এক সঙ্গেই একজন গৃহশিক্ষকের কাছে পড়াশোনা করেছে। আমার দ্বিতীয় ছেলের মুখস্থবিদ্যা খুব প্রখর। সেজন্য সে খুব বেশি লেখালেখি করে না। প্রধান শিক্ষক জানালেন যে, আমি বাংলা শ্রুতলিপি এবং অংকে দুটতেই শূন্য পেয়েছি। যাহোক, তিনি জানালেন যে, আপনি যখন আপনার ছেলের এত প্রশংসা করছেন তখন তাকে একদিন স্কুল চলাকালে আমার কাছে পাঠিয়ে দেবেন। আমি দেখবো কী করা যায়। পরদিনই আমাকে আব্বার মুন্সী সাহেব স্কুলে নিয়ে গেলেন। এই মুন্সী সাহেবের নাম ছিল আবদুর রাজ্জাক এবং তিনি এক সময় বেশ প্রসিদ্ধ রাজনৈতিক নেতা হয়ে যান। তিনি আমার দাদা আবদুল হামিদ সাহেবের মুন্সী ছিলেন এবং খেলাফত আন্দোলনে মূল্যবান ভূমিকা পালন করেন। খেলাফত আন্দোলন শেষে আমার দাদা আর ওকালতিতে ফিরে এলেন না। তখন মুন্সী সাহেব হয়তো অন্য কোথাও কাজ করেন। আমার আব্বা ১৯২৬ সালের অক্টোবরে সিলেট জেলা বারে যোগ দেন। তখন আবদুর রাজ্জাক সাহেব তার মুন্সী হিসেবে কাজ করতে শুরু করেন। তিনি আব্বার ওপর বেশ কর্তৃত্ব বজায় রাখতেন এবং তাকে নানা বিষয়ে উপদেশ দিতেন। তার পরিবারের সঙ্গে আমাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক এখনও বজায় আছে। তার মা বহুদিন জীবিত ছিলেন এবং তাকে সবাই ভয় করতো। চলবে...
×