ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

আবুল মাল আবদুল মুহিত

ছেলেবেলা ও ছাত্রজীবন

প্রকাশিত: ০৪:০১, ৭ অক্টোবর ২০১৫

ছেলেবেলা ও ছাত্রজীবন

আমার আব্বা-আম্মা (৬ অক্টোবরের পর) আমার এই ছোট খালা সৈয়দ শামসুন্নেসা বেগম আমাদের সঙ্গে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিলেন। জন্মের পরেই তার মা মারা যান এবং তিনি একটু বড় হওয়ার পরেই আমার আম্মার সঙ্গে থাকতে শুরু করেন। তার বিয়ে হয় হবিগঞ্জের লাকড়িপাড়ায় এক পীর পরিবারে। তার বাড়িতে আমরা দুই ভাই নানার সঙ্গে বেড়াতে যেতাম। খালার পরিবারে সামাজিক ও আর্থিক অবস্থা মোটামুটি ভাল ছিল এবং তার স্বামী সৈয়দ আবদুল খালেক ছিলেন বাড়ির বড় পুত্র। তারা মোট তিন ভাই এক বাড়িতেই থাকতেন। শৈশবে-কৈশোরে আমাদের দেশে শাক-সবজি খুব কম খাওয়া হতো। কিন্তু লাকড়িপাড়ায় ব্যবস্থাটি ছিল অন্যরকম। সেখানে শীতকালে প্রচুর সবজি চাষ হতো এবং এসব সবজি সেখানকার পাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত। আমরা গ্রামে যে ক’দিন থাকতাম তখন সেখানে মোটামুটিভাবে উৎসব প্রতিপালিত হতো। বহুদিন পরে ১৯৯৬ সালে আমি আমার আত্মীয়-স্বজনদের নিয়ে একটি মোটরযান শোভাযাত্রা করে ঢাকা থেকে সড়কপথে তার বাড়িতে পৌঁছি। আমি জানতাম যে, আমরা গেলেই তিনি আপ্যায়নের ব্যবস্থা করবেন। সেজন্য আমার সঙ্গী-সাথীদের জন্য প্রচুর খানা আমরা ঢাকা থেকে নিয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু খালা এবং তার ছেলে খালিসের অনুরোধে আমাদের খাওয়া পরিবেশনা দেরি করতে হলো। কারণ, খালাকে কিছু না কিছু একটু রাঁধতেই হবে। এই ভ্রমণটি আমার জীবনে খুবই স্মরণীয়। কারণ, মাস ছয়েকের মধ্যেই আমার খালা ইন্তেকাল করেন। খালা প্রায় ৭০ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। খালার প্রখর বোধশক্তি ছিল। আমাদের পরিবারের যে কোন গুরুত্বপূর্ণ সময়ে তিনি কোন না কোনভাবে উপস্থিত থাকতেন। বিয়ে-শাদিতে অবশ্য পরিকল্পনা করেই আসতেন। কিন্তু অনেক সময় শুধু নাড়ির টানে তিনি যথাসময়ে উপস্থিত থাকতেন। আম্মা যখন আমার ঢাকার বাড়িতে অসুস্থ তখন হঠাৎ একদিন খালা তার কিছু লোকজনের সাহায্যে এখানে এসে হাজির। তিনি যেন আম্মার মৃত্যুতে হাজির থাকতে এসেছিলেন। ১৯৮৫ সালে আমার আব্বার মৃত্যুকালেও তিনি অকস্মাৎ গিয়ে উপস্থিত হন। আগেই বলেছি যে, আমার আম্মার কোন প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া ছিল না। আমার মনে হয় আব্বা আম্মাকে সুশিক্ষিত করে তুলতে অনেক সময় ব্যয় করেন। অবশ্য তার সুফলও তিনি সারাজীবন উপভোগ করেন। আমার আম্মা তার স্বামীর সকল কাজের সহযোগী এবং সিলেটের নেতৃস্থানীয় সমাজ ও রাজনীতি সচেতন কর্মী ছিলেন। আমার আব্বার বিয়ে হয় ১৯২৮ সালের ৭ সেপ্টেম্বরে। আমাদের পূর্ব পুরুষরা যেমন শহরের লোক ছিলেন, আম্মা ছিলেন একান্তই তার উল্টো, একেবারেই গ্রামের মেয়ে। আব্বার বিয়ে ঠিক করেন তার পিতা এবং তাকে সহায়তা করেন তার জামাই বদরুজ্জামান সাহেব। আমার আম্মা ছিলেন সুনামগঞ্জ মহকুমার (বর্তমানে জেলা) জগন্নাথপুর থানার সৈয়দপুর গ্রামের চৌধুরী বাড়ির বড় মেয়ে সৈয়দ শাহার বানু চৌধুরী। সৈয়দপুরের জমিদার আবুল বশর চৌধুরী এবং সৈয়দ আজিজা বানুর কন্যা। আমার আম্মার জন্ম হয় ১৯ নভেম্বর ১৯১৪ সালে এবং তিনি ইহধাম ত্যাগ করেন ১৯৮৩ সালে ২১ অক্টোবরে ক্যান্সারের রোগী হিসেবে আমার সরকারি বাড়ি ৫নং ধানম-ির ১৪ নম্বর বাড়িতে ঢাকায়। তার পড়াশোনা ছিল অন্দরমহলে : বাংলা, ইংরেজী অক্ষরজ্ঞান এবং আরবিতে বেশ ভাল। তিনি অত্যন্ত সুললিতকণ্ঠে দ্রুতগতিতে কোরআন শরীফ পড়তে পারতেন এবং সবসময় তার বাংলা অনুবাদ দেখতেন। ইংরেজী, বাংলা তিনি শেখেন আমার আব্বার কাছে এবং আমরা তাকে দেখেছি গল্প, কবিতা, উপন্যাসের আগ্রহী পাঠক হিসেবে। তার মাসিক পত্রিকা- প্রবাসী, ভারতবর্ষ, বুলবুলের সংগ্রহ এবং অন্যান্য বই-পুস্তক দিয়ে আমি কৈশোরে আমার পাড়ায় একটি গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা করি। আম্মারা ছিলেন নয় ভাইবোন। আরও দুই/একজন অল্প বয়সেই মৃত্যুবরণ করেন। সকলের বড় ছিলেন আমার মামা সৈয়দ শাহ আলম চৌধুরী। তিনি সম্ভবত আম্মার চেয়ে দুই/তিন বছরের বড় ছিলেন। আম্মার বিয়ের পরপরই তিনি সিলেটে চলে আসেন লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়ার জন্য এবং আমার আব্বা যখন তার বাড়িটি নির্মাণ করেন তখন তিনি এর বিশেষ দেখাশোনা করেন। তাদের গ্রামে লেখাপড়া মোটেই ছিল না। তাদেরই আত্মীয়-স্বজন ক’জন লেখাপড়া শুরু করেন। সেখানকার সর্বপ্রথম গ্র্যাজুয়েট ছিলেন উনবিংশ শতাব্দীর দশ শতকের একজন শিক্ষাবিদ সৈয়দ হাফিজুর রহমান। তার ছোট ভাই মওলানা সৈয়দ হাবিবুর রহমান আম্মার পরবর্তী বোনকে বিয়ে করেন। আগেই ছোট খালা সম্বন্ধে বলেছি। তিনি ছিলেন আম্মার তৃতীয় বোন। তার পরে ছিলেন আমাদের ছোট মামা সৈয়দ শাহ আনোয়ার চৌধুরী। তার জন্ম হয় ১৯২৭ সালে এবং ২০০০ সালের ১৪ মে তিনি পরলোকগমন করেন। তিনি ১৯৪৪ সালে সিলেটে চলে আসেন পড়াশোনার জন্য এবং তারপর সারা জীবন সিলেট মহানগরে অতিবাহিত করেন। তিনি ছিলেন আমাদের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ এবং স্কুলে আমরা প্রথমে মেঝো মামা এবং পরে তার সঙ্গে যেতাম। তিনি আমাদের এক বছর আগে প্রবেশিকা পাস করে সিলেট মেডিকেল স্কুলে ভর্তি হন। সম্ভবত স্কুলটি ১৯৪৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। এখান থেকে তিনি ১৯৫২ সালে এলএমএফ পাস করে ডাক্তান হন এবং বাধ্যতামূলকভাবে সরকারি চাকরি গ্রহণ করেন। তিনি দক্ষিণবঙ্গ অর্থাৎ বৃহত্তর বরিশালে পদায়িত হন এবং সেখানে বেশ কিছুদিন অবস্থান করেন। ১৯৬১ সালে তার বিয়ে ঠিক হয় এবং সরকারি কাজের চাপে বিয়ের জন্য তার ছুটি মিলল না। এই সময় আমাকে তার বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে হয় এবং যথাসময়ে তার ছুটি মঞ্জুর হয়। তার বিয়ে হয় সিলেটে নজমুল হোসেন চৌধুরী নামে আমাদের একজন স্কুল পরিদর্শকের কন্যা লালে শাহওয়ারের সঙ্গে। বিয়ের অব্যবহিত পরে তিনি সরকারি চাকরি ছেড়ে দিয়ে সিলেটে প্র্যাকটিস শুরু করেন। তিনি মোটামুটিভাবে একজন সফল চিকিৎসক ছিলেন। পরবর্তীকালে যখন এলএমএফ পড়া ডাক্তারদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থায় ঢাকার মিটফোর্ড কলেজে এমবিবিএস পড়াশোনার প্রচলন হয় তখন তিনি প্রথম ব্যাচে সেখান থেকে এমবিবিএস পাস করেন। তিনি আজীবন সিলেট মহানগরে বসবাস করেন এবং ১৯৬৪ সালে সেখানে তার বাড়ি নির্মাণ করেন। সিলেটে সম্ভবত ১৯৬২ সালে আম্বরখানায় একটি আবাসিক এলাকা স্থানীয় উদ্যোগে জেলা প্রশাসক গড়ে তোলেন। আমার ওপর চাপ প্রয়োগ করে সেখানকার জেলা প্রশাসক এই আবাসিক এলাকায় একখ- জমি নিতে বাধ্য করেন। এই জমিটি আমি আমার মামার কাছে বিক্রি করি এবং সেখানেই তিনি তার বাড়িটি নির্মাণ করেন। সেই বাড়িতেই আমার মামি এবং তাদের একমাত্র ছেলে সৈয়দ মুবীর বসবাস করেন। ছোট মামা একজন জনপ্রিয় চিকিৎসক ছিলেন এবং তিনি ছিলেন বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের নির্ধারিত চিকিৎসক। আমি সিলেটে গেলে বিশেষ করে আমার আব্বা-আম্মার পরলোগমনকালের পর তার সঙ্গেই থাকতাম। ২০০০ সালে সামান্য অসুখে ভুগেই তিনি ইন্তেকাল করেন। ছোট মামা আজীবন আব্বার ছোট ভাইয়ের মতো ছিলেন এবং হাঁকে-ডাকে সব সময়ই তিনি উপস্থিত থাকতেন। আব্বার মৃত্যুকালে যখন কোন সন্তান-সন্ততি তার পাশে ছিল না তখন এই মামা এবং মামিই আব্বাকে সঙ্গ দেন। ছোট মামার জন্মের অব্যবহিত পরেই আমাদের নানি সৈয়দ আজিজা বানুর মৃত্যু হয়। নানা কিছুদিন পরে দ্বিতীয় দারপরিগ্রহ করেন এবং এই পক্ষেও বেশ কয়েকজন মামা ও খালা ছিলেন বা আছেন। এই পক্ষে আমার প্রথম মামা সৈয়দ শাহ জামাল আমাদের বাড়িতে থেকে যখন পড়াশোনা করতেন তখন ছাত্র রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৭১ সালে তিনি ছাত্র ছিলেন এবং আমাদের বাড়িতেই থাকতেন। সেই সময় পাকিস্তানি দস্যু সেনাবাহিনী কর্তৃক তিনি নিখোঁজ হয়ে যান এবং তাকে আর কোনদিনই পাওয়া যায়নি। শাহ জামালের পরে আমার দুজন খালা পরিপূর্ণ জীবনযাপন করেন। জানেয়া বেগম ও জামেয়া বেগম দুজনই বিলেতে পাড়ি দেন এবং তাদের পরিবার-পরিজন ব্রিটেনের সানডারল্যান্ডের অধিবাসী। তাদের সন্তান-সন্ততি সানডারল্যান্ডের সবচেয়ে প্রসিদ্ধ ক্যাটারিং সার্ভিসের মালিক। শাহ জামালের সর্বকনিষ্ঠ ভাই শাহ কামাল আমাদের ছোট মামা। তিনি কোন্ বছর সিলেটে আসেন আমি তা বলতে পারব না। কিন্তু তিনি বলতে গেলে আমাদের বাড়িরই বাসিন্দা। তার নিজের পরিবার থাকে আম্বরখানার আবাসিক এলাকায়। কিন্তু আমাদের বাড়ির দেখাশোনা এবং খোঁজখবর নেয়া তারই দায়িত্ব। তিনি আমার আম্মা এবং আব্বার খুবই ঘনিষ্ঠজন ছিলেন এবং আমার সর্বকনিষ্ঠ ভাইয়ের বড় বন্ধু ছিলেন। এখনও তিনি একইভাবে তার সব আত্মীয়-স্বজনের দেখাশোনা করেন, যদিও তিনি অসুখ-বিসুখে প্রায়ই কাবু হয়ে পড়েন। তার বড় মেয়েটি ডাক্তার এবং ছেলেটি ব্যাংকার। আমরা খুবই ভাগ্যবান যে, আমাদের বাড়িতে বড় মামা, মেঝো মামা এবং ছোট মামা সকলেই বিভিন্ন সময়ে বসবাস করেন। যুদ্ধকালে বড় মামা আমাদের বাড়িতেই একটি ঘর নির্মাণ করে প্রায় বছর দু’য়েক অবস্থান করেন। চলবে...
×