ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী

শফিক রেহমানের ‘মৃত্যুদণ্ড’

প্রকাশিত: ০৪:০০, ৭ অক্টোবর ২০১৫

শফিক রেহমানের ‘মৃত্যুদণ্ড’

পাঠক, আমার আজকের লেখার শিরোনামটি দেখে আঁতকে উঠবেন না। ‘যায়যায়দিন’-খ্যাত সাংবাদিক এবং অধুনা বিএনপি-জামায়াতের অন্যতম মুখপাত্র শফিক রেহমানকে কেউ মৃত্যুদ- দেয়নি। তিনি নিজেই নিজের ‘মৃত্যুদণ্ডে’ স্বাক্ষর করে লন্ডনের প্রকাশনা সভায় বইটি ‘গুণীজনের’ মধ্যে বিতরণ করেছেন। তার বইয়ের নাম ‘মৃত্যুদ- : দেশে-বিদেশে যুগে যুগে।’ বলা হয়েছে ‘মৃত্যুদ- সম্পর্কে এটি একটি গবেষণামূলক গ্রন্থ। ফাঁসি সিস্টেমের বিরুদ্ধে একটি ক্যাম্পেইন, একটি আন্দোলন।’ এই প্রচারণার আড়ালে আসল ব্যাপার হলো, বাংলাদেশে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী ও মানবতার শত্রুদের বর্তমানে যে বিচার ও মৃত্যুদণ্ড হচ্ছে (কারো কারো যাবজ্জীবন কারাদণ্ড) বহির্বিশ্বে তার বিরুদ্ধে ক্যাম্পেইন জোরদার করার জন্যই সময় বুঝে বইটি লেখা এবং লন্ডনে তার প্রকাশনা উৎসব। ব্রিটেনে মৃত্যুদণ্ড-সিস্টেম নেই। তাহলে যেসব দেশে মৃত্যুদণ্ড আছে, যেমন বাংলাদেশে, সেখানে বইটির প্রকাশনা অনুষ্ঠান না করে লন্ডনে বিএনপি ও জামায়াতের মুখচেনা কিছু বুদ্ধিজীবী-ভাঁড় নিয়ে এই অনুষ্ঠান করা কেন? এই বই প্রকাশের উদ্দেশ্যটা এখানেই ধরা পড়ে। বাংলাদেশে একাত্তরের ঘাতকদের মৃত্যুদ-দানের প্রকাশ্য বিরোধিতা করবে এমন বুদ্ধিজীবী খুঁজে পাওয়া ভার হবে। বিএনপি ও জামায়াত ঘেঁষা যে কয়েকজন বুদ্ধিজীবী আছেন, তাদের নিয়েও ঢাকায় এই বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠান করা একটু কষ্টকর হতো। আর এই বই লেখার উদ্দেশ্যটা তো দেশে মৃত্যুদ--বিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলা নয়; তাতে লাভ হবে না। দেশের মানুষ যুদ্ধাপরাধীদের চরম শাস্তিদানের পক্ষে। একমাত্র বিদেশেইÑ বিশেষ করে পশ্চিমা দেশগুলোতে জামায়াত মৃত্যুদণ্ড প্রথার বিরুদ্ধে, মানবতার নামে আন্দোলনের আড়ালে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও দণ্ড থেকে বাঁচাবার জোর চেষ্টা চালাচ্ছে। দু’হাতে টাকা ছড়িয়ে তারা এই বিচারের স্বচ্ছতা সম্পর্কে বিভ্রান্তি সৃষ্টির প্রয়াস চালাচ্ছে। শফিক রেহমানের মৃত্যুদণ্ড সম্পর্কিত এই বই লেখা এবং জামায়াত ও যুদ্ধাপরাধীদের সমর্থকদের একটি বড় প্রচারণা কেন্দ্র লন্ডনে বইটির অনুষ্ঠান একই ক্যাম্পেইনের অংশ বলা যেতে পারে। এই সময়ে এই বই লেখা ও প্রকাশের উদ্দেশ্যটি স্পষ্ট। তা মৃত্যুদণ্ড-প্রথা বাতিলের উদ্দেশ্যে নয়, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানোর উদ্দেশ্যে লেখা। গত ২৯ সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার পূর্ব লন্ডনের ওসমানি সেন্টারে শফিক রেহমানের ‘মৃত্যুদ-ের’ প্রকাশনা অনুষ্ঠান হয়। লন্ডনের জামায়াত ঘেঁষা একটি বাংলা পত্রিকাতেই মাত্র খবরটি প্রকাশিত হয়েছে। যদিও পত্রিকাটির খবরে বলা হয়েছে, বিশিষ্ট লেখক, সাংবাদিকেরা অনুষ্ঠানে এসেছিলেন; কিন্তু তাদের নামের তালিকা দেখে বোঝা যায়, ব্রিটেনের কয়েকজন হাতেগোনা ব্যক্তি, যাদের কুমির ছানার মতো বিএনপির সব অনুষ্ঠানে দেখানো হয়, তারেক রহমানের সভা থেকে বিএনপির নানা অনুষ্ঠান পর্যন্ত ওরাই শফিক রেহমানের এই সভার শোভাবর্ধন করেছেন। তাদের মধ্যে শিক্ষাবিদ বলে পরিচিত এক ব্যক্তি তার বক্তব্যে যে ভাঁড়ামির পরিচয় দিয়েছেন, তা থেকেই এই বই লেখা এবং তার উদ্দেশ্যটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বলা হয়েছে, দেশে-বিদেশে যুগে যুগে মৃত্যুদ-ের যে প্রথা চলে এসেছে তা নিয়ে গবেষণামূলক আলোচনা করা বইটির উদ্দেশ্য এবং তা ফাঁসি সিস্টেমের বিরুদ্ধে একটি ক্যাম্পেইন বা আন্দোলন, কিন্তু বাস্তবে কি দেখা গেল? বইটি যারা পড়েছেন এবং লন্ডনে বইটির প্রকাশনা অনুষ্ঠানের খবর যারা দেখেছেন তারা জানেন, এই বইতে আসল প্রচারণাটি বাংলাদেশে ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও চরম দ-দানের বিরুদ্ধে এবং লন্ডনে বইটির প্রকাশনা অনুষ্ঠানেও জোরেশোরে সেই কথা বলা হয়েছে। বইটির প্রকাশনা অনুষ্ঠানের মূল কথাই ছিল ‘রাষ্ট্র (বাংলাদেশ) একটি ফাঁসির প্রজন্ম সৃষ্টি করছে।’ অর্থাৎ বাংলাদেশে দীর্ঘ বিলম্বিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও দ-দান দ্বারা সরকার ফাঁসির প্রজন্ম সৃষ্টি করছে। প্রশ্ন হলো, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর বিজয়ী পশ্চিমা শক্তি নাৎসি যুদ্ধাপরাধীদের ত্বরিত বিচার এবং তাদের মৃত্যুদ-দানের ব্যবস্থা করে কি ইউরোপে একটি ফাঁসির প্রজন্ম সৃষ্টি করেছিল? তাহলে সেই প্রজন্মটি এখন কোথায় গেল? শফিক রেহমানের বইতে তার কোনো তত্ত্ব-উপাত্ত নেই। শফিক রেহমান লন্ডনে এসেছেন তা আমার জানা ছিল না। এরশাদবিরোধী আন্দোলনে তার সাপ্তাহিক ‘যায়যায়দিন’ পত্রিকার বলিষ্ঠ ভূমিকার জন্য তিনি তখনকার তরুণ পাঠকদের মধ্যে নন্দিত ব্যক্তি হয়ে উঠেছিলেন। তিনি লন্ডনে এলেই বাংলাদেশী তরুণ সমাজে তাকে নিয়ে একটা হৈ চৈ পড়ত। তিনি ধীরে ধীরে বিএনপি-জামায়াত শিবিরে চলে যাওয়ার পর এই হৈ চৈ আর নেই। সাপ্তাহিক ‘যায়যায়দিন’ও এখন নেই এবং তিনিও এখন পতিত সম্পাদক ও বিস্মৃত লেখক। সুতরাং ইদানীং তিনি কখন লন্ডনে আসেন এবং যান তা আমার জানা হয় না। এবার তার লন্ডনে উপস্থিতির কথা লন্ডনের ওই জামায়াত ঘেঁষা পত্রিকাটিতে গ্রন্থ প্রকাশ অনুষ্ঠানের খবর দেখে জানতে পেরেছি। বেগম খালেদা জিয়ার বর্তমান লন্ডন সফরের সময় শফিক রেহমান এখানে থাকবেন এটা আমার আগেই ধারণা করা উচিত ছিল। খালেদা জিয়ার দরবারে তার আগের প্রাধান্য না থাকলেও এখনও তিনি তার উপদেষ্টা নামক পারিষদ দলে আছেন, সুতরাং এবার লন্ডনে এসে বিএনপি নেত্রীর সভাসদের দায়িত্ব পালন এবং মৃত্যুদ- সম্পর্কে বই লিখে জামায়াতের মনোরঞ্জন ও তাদের উদ্দেশ্য পূরণে সহায়তাদানÑ দুটো কাজই যদি তিনি করে থাকেন তাহলে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। লন্ডনের গ্রন্থ প্রকাশ অনুষ্ঠানে শফিক রেহমান দাবি করেছেন, কিশোর বয়স থেকেই ফাঁসির মতো ঘটনা তাকে ব্যথিত করে আসছে। কিন্তু একশ্রেণীর ফাঁসির আসামির দ্বারা নৃশংস খুন, শিশু ও নারী হত্যা বা একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের দ্বারা সংঘটিত গণহত্যা, বর্বর পন্থায় দেশের অগুনতি বুদ্ধিজীবী হত্যা তাকে কখনও ব্যথিত করেছে কিনা সে কথার উল্লেখ করেননি, তার মায়াকান্না যে মৃত্যুদ- প্রথার বিরুদ্ধে নয় বরং বাংলাদেশে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের মৃত্যুদ-দানের বিরুদ্ধে তা তার পরবর্তী বক্তব্যেই বোঝা যায়। আমার পাঠকদের স্মরণ থাকতে পারে যে, ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার প্রথমে যাবজ্জীবন দ-াদেশ হওয়ার পর ঢাকায় লক্ষ লক্ষ নর-নারীর বিক্ষোভ-সমাবেশ হয়েছিল। তার নেতৃত্ব দিয়েছিল গণজাগরণ মঞ্চ। এই সমাবেশের দাবি ছিল কাদের মোল্লার মতো মানবতার জঘন্য শত্রুদের চরম দ-দান। মোমবাতির আলোতে সভা প্রাঙ্গণে উজ্জ্বল করে শিশুরাও দাবি তুলেছিল ফাঁসি চাই। শফিক রেহমান এই গণসমাবেশের দাবির বিরোধিতা ও তাকে হেয় করার কাজটি তার গ্রন্থ প্রকাশনা অনুষ্ঠানে অত্যন্ত ধূর্ততার সঙ্গে করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘বাংলাদেশে শিশুদের ফাঁসির ব্যাপারে উৎসাহিত করা হচ্ছে। ছোট ছোট ছেলেমেয়ে যাদের মুখে ভালোভাবে কথাই ফোটেনি, তাদের মুখে তুলে দেয়া হচ্ছে নির্মম ফাঁসির শব্দ।’ আমি এ সভায় উপস্থিত থাকলে শফিক রেহমানকে জিজ্ঞাসা করতাম, আপনি শিশুর মুখে ফাঁসির শব্দ শুনলে পীড়াবোধ করেন। কিন্তু ’৭১ সালে যুদ্ধাপরাধীদের হাতে শিশুঘাতী, নারীঘাতী বর্বরতার অনুষ্ঠান কি দেখেছেন? না, দেখেননি। গোটা একাত্তর সালে তিনি লন্ডনে সপরিবারে নিরাপদ ও সচ্ছল-স্বচ্ছন্দপূর্ণ জীবনযাপন করেছেন। এই সেদিনও, শফিক রেহমান যে বিএনপি-জামায়াত গোষ্ঠীকে সমর্থন করেন, তাদের সন্ত্রাসীদের আগুনে বোমায় বাসযাত্রী মায়ের কোলে দুগ্ধপোষ্য শিশুর নির্মম মৃত্যু হয়েছে। পুড়ে মারা গেছে ঘুমন্ত বালক। তখন কোথায় ছিল শফিক রেহমানের এই মানবতাবোধ? শিশুদের মুখে ফাঁসি শব্দটি শুনলে তিনি তরুণ প্রজন্মের ভবিষ্যত ভেবে শঙ্কিত হন। কিন্তু এই তরুণ প্রজন্ম যখন তার দলের বা জামায়াতীদের বর্বর হত্যার শিকার হন, তখন তিনি নীরব! মানবতার শত্রুদের বিরুদ্ধে তার মনে সহানুভূতি ও কৃপার অন্ত নেই। কিন্তু নির্যাতিত মানবতার পক্ষে তিনি কখনও দাঁড়িয়েছেন, তার একটি দৃষ্টান্তও দেখাতে পারবেন কি? তিনি এখন মৃত্যুদ- প্রথা বাতিলের পক্ষে মায়াকান্না কাঁদছেন। আসলে তার এই কান্নাতো বাংলাদেশের ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের মৃত্যুদ- রদের জন্য! এই গ্রন্থ প্রকাশনা উৎসবে শিক্ষাবিদ নামধারী এক শিক্ষিত ভাঁড় যে ভাঁড়ামি করেছেন সে কথা আগেই উল্লেখ করেছি। তিনি বলেছেন, ‘বাংলাদেশকে একটি ফাঁসিবিহীন রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে চাই। এই ফাঁসি শব্দটি ভাবতে গেলেই প্রথমে ক্ষুদিরামের কথা মনে পড়ে। সেই ছোটবেলায় শোনা গান ‘একবার যেতে দে মা...।’ এই ভাঁড় বিদেশী শাসকের হাতে দেশপ্রেমের জন্য বিপ্লবী ক্ষুদিরামের ফাঁসিকে তুলনা করেছেন বর্তমান বাংলাদেশে দেশদ্রোহী এবং মানবতার শত্রু যুদ্ধাপরাধীদের মৃত্যুদ- প্রাপ্তির সঙ্গে। এটা শুধু ভাঁড়ামি নয়, ভাঁড়ামির আড়ালে বিদেশে বসে এক ধরনের দেশদ্রোহিতা। মানবতার জন্য দরদ প্রকাশের আড়ালে এরা মানবতার শত্রুদের সমর্থক ও সহযোগী। এদেরও বিচার হওয়া উচিত। মানবতা ও মানব সভ্যতার বৃহত্তর স্বার্থেই মানবতার শত্রুদের চরম শাস্তি হওয়া প্রয়োজন। এই দ-দানের সঙ্গে সাধারণ মৃত্যুদ-দান-প্রথার কোন সম্পর্ক নেই। সম্পর্ক থাকলে যে ইউরোপ ও আমেরিকা মৃত্যুদ-দান-প্রথার বিরোধিতা করছে, তারা ইরাকের সাদ্দাম হোসেনকে অন্যায় যুদ্ধে পরাজিত করে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলিয়ে হত্যা করত না। লিবিয়ায় গাদ্দাফিকে বিনা বিচারে ভাড়াটিয়া মবের হাতে মৃত্যুবরণ করতে দিত না। সাধারণ মৃত্যুদণ্ড প্রথা ধীরে ধীরে সারা বিশ্ব থেকে অবশ্যই একদিন বিলুপ্ত হবে। সভ্যতা ও শিক্ষা প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে সমাজে অপরাধ যত কমবে সর্বপ্রকার দ-দানই তখন কমে আসবে। তবে বর্তমান বিশ্বের অনেক মনীষী মনে করেন, সাধারণ খুনী ও জঘন্য অপরাধীর জন্যও মৃত্যুদ-দান প্রথা রহিত করা যেতে পারে; কিন্তু গণহত্যাকারী, দেশ ও জাতির ভয়ানক শত্রুদের জন্য তা রহিত করা উচিত নয়। আমার বন্ধু শফিক রেহমান অবশ্য মৃত্যুদণ্ডদান-প্রথা বাতিলের আন্দোলনে নামেননি, তিনি তার যুদ্ধাপরাধী বন্ধুদের মৃত্যুদ- থেকে বাঁচানোর ক্যাম্পেইনে নেমেছেন। মুখোশটি ধারণ করেছেন মানবতার। কিন্তু মুখোশের আড়ালে মুখগুলো যে বড় বেশি চেনা! লন্ডন ৬ অক্টোবর, মঙ্গলবার, ২০১৫ ॥
×