ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

মানচিত্রে সন্দ্বীপ

প্রকাশিত: ০৪:১৮, ৬ অক্টোবর ২০১৫

মানচিত্রে সন্দ্বীপ

অবিরাম ভাঙ্গনে মানচিত্র থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে সন্দ্বীপ। বঙ্গোপসাগর আর মেঘনার ছোবলে দিন দিন ছোট হয়ে আসছে দ্বীপটি। এর আয়তন ও লোকসংখ্যা দুটোই দ্রুতগতিতে কমছে। একদিকে পশ্চিমে জেগে উঠছে বিশাল চর, অন্যদিকে পূর্বাঞ্চল ভাঙ্গনপ্রবণ। এখন পশ্চিম-উত্তরাংশে ভাঙ্গন ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এই ভাঙ্গাগড়ার খেলায় দুলছে দ্বীপ উপজেলাটির অস্তিত্ব। ভাঙ্গনের মুখে উপজেলা সদরের সরকারী বিভিন্ন অফিস-আদালত এরই মধ্যে দুবার অন্যত্র স্থানান্তর করা হয়েছে। ২০০১ সালের আদমশুমারিতে এই দ্বীপটির লোকসংখ্যা ছিল সাড়ে তিন লাখ। এখন লোকসংখ্যা দাঁড়িয়েছে তিন লাখের নিচে। ১৯৭০, ১৯৮৫ এবং ১৯৯১ সালের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ে সন্দ্বীপের মানুষ যেভাবে প্রকৃতির নির্মমতার শিকার হয়েছিল তার আর্থ-সামাজিক ক্ষতি ও মর্মান্তিক স্মৃতি আজও বয়ে বেড়াচ্ছে ভুক্তভোগী মানুষ। বাংলাদেশের এক বিচ্ছিন্ন দ্বীপের নাম সন্দ্বীপ। বঙ্গোপসাগরের কূলঘেঁষে মেঘনার মোহনায় এই উপজেলাটির অবস্থান। পঞ্চদশ শতাব্দীর ৬০০ বর্গমাইলের ঐতিহ্যময় এ বিশাল ভূখণ্ডটি প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কবলে পড়ে এখন মাত্র ৬০ বর্গমাইলের একটি ক্ষুদ্র দ্বীপে পরিণত হয়েছে। এক সময় ৬২ মৌজার দেশ বলা হতো সন্দ্বীপকে। ছিল ৩১টির মতো চর। এখন সন্দ্বীপ নিজেই একটি ক্ষুদ্র দ্বীপে পরিণত হয়েছে। ১৪টি ইউনিয়ন প্রতিনিয়ত দক্ষিণ ও পশ্চিমাঞ্চলের বিশাল অংশজুড়ে ভাঙ্গছে। বর্তমানে দ্বীপটির ৫৮ কিলোমিটার জুড়ে বেড়িবাঁধ রয়েছে, যার ২৯ কিলোমিটারই ভাঙ্গনপ্রবণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত। বিভিন্ন সময়ে লাখ লাখ মানুষ হয়েছে গৃহহারা, সম্পদহারা। বহু ঐতিহ্যের নাম সন্দ্বীপ। এখানে সবই ছিল। এখন অনেক কিছুই নেই। এক সময় পীর-আউলিয়াদের আস্তানা ছিল। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সৌন্দর্যপ্রেমী মানুষের পছন্দের তালিকায় ছিল এই দ্বীপটির নাম। বহু খ্যাতিমান জন্ম নিয়েছেন এই দ্বীপটিতে। আগে সন্দ্বীপকে ভাঙ্গনের কবল থেকে রক্ষায় ক্রসবাঁধ আন্দোলনসহ নানা কর্মসূচী পালিত হয়েছে। তার মূল উদ্দেশ্য ছিল সন্দ্বীপের ভাঙ্গন রোধ করা। কিন্তু আদৌ সন্দ্বীপের ভাঙ্গন রোধ করা সম্ভব হয়নি। ২০০১ সালের আদমশুমারির হিসাবে ২ লাখ ৯১ হাজার বাসিন্দা থাকলেও এখন তা আড়াই লাখে নেমে এসেছে। তার মধ্যে পঞ্চাশ হাজারেরও বেশি লোক বেড়িবাঁধের ওপর মানবেতর জীবনযাপন করছে। অনেকেই নদীভাঙ্গনে সর্বস্ব হারিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে, বিশেষ করে চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামে উদ্বাস্তুর মতো জীবনযাপন করছে। সরকার আসে সরকার যায়; কিন্তু এই ঐতিহ্যবাহী দ্বীপটিকে নিয়ে ভাবার যেন কেউ নেই। নদীমাতৃক এই দেশে নদীভাঙ্গন নতুন বা বিচ্ছিন্ন কোন ঘটনা নয়। বন্যার পাশাপাশি নদীভাঙ্গনও জাতীয় দুর্যোগ হিসেবেই চিহ্নিত। এই প্রাকৃতিক দুর্যোগটি প্রতিবছরই বর্ষা মৌসুমে ব্যাপকতা ছড়ায়। এক পরিসংখ্যানে জানা যায়, দেশে প্রতি বছর ১০ হাজার হেক্টর জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে থাকে। প্রায় আড়াই লাখ মানুষ নদীভাঙ্গনের শিকার হয়। দেশের ভূমিহীন ও উদ্বাস্তু জনগোষ্ঠীর এক উল্লেখযোগ্য অংশ ভাঙ্গনকবলিত। সন্দেহ নেই গ্রামীণ দারিদ্র্যের একটি বড় কারণও নদীভাঙ্গন। সন্দ্বীপ তারই একটি অংশ। এ অঞ্চলে ক্রসবাঁধের দাবি বহুকালের। একমাত্র ক্রসবাঁধ নির্মাণ করেই সন্দ্বীপের অস্তিত্ব রক্ষা করা সম্ভব। এদেশের একটি ঐতিহ্যময় জনপদকে টিকিয়ে রাখতে সম্ভাব্য সব রকমের ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার। ভাঙ্গনে সৃষ্ট মানবিক বিপর্যয় রোধে স্থায়ী পদক্ষেপ গ্রহণ এখনই জরুরী।
×