ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

দাউদ হায়দার

বানানা রিপাবলিকের ২৫ বছর

প্রকাশিত: ০৪:১৭, ৬ অক্টোবর ২০১৫

বানানা রিপাবলিকের ২৫ বছর

গত শতকের মধ্য-পর্বেও ল্যাটিন আমেরিকার কয়েকটি দেশে কলা চাষ, কলা বিক্রি, কলার বিশ্ববাজার দখল নিয়ে রীতিমত যুদ্ধ হয়েছে। বিশ্ববাজার বলতে মূলত ইউরোপ। আমেরিকারও কিছু রাজ্য। ঠাকুরঘরে কলা খাওয়ার প্রবাদ ইউরোপেও। ইউরোপের বাজারে যত কলা দেখবেন, সবই ল্যাটিন আমেরিকার। ইউরোপে কলা চাষ হয় না, যেমন হয় না চা কিংবা কফি। দিনের শুরুতে চা বা কফি না গিললে ইউরোপিয়ানদের মেজাজ তিরিক্ষে। চা, কফি নিয়ে বিস্তর কেচ্ছাকাহিনী, ইতিহাস আছে। রাজনীতি আছে। বাণিজ্য আছে। রেষারেষিও আছে। চীনে কিংবা জাপানে চা সিরিমোনি এখনো এলিট কালচার। শুরু ১৭৭২ সাল থেকে। কলা এত কুলীন নয়, কিন্তু ইউরোপিয়ানদের ব্রেকফাস্টে না হলে চলবে না, কলা চাই। যে সব দেশে কলার জাতীয় চাষ ও ব্যবসা, আড়াই দশক আগেও ব্যঙ্গ করে বলা হতো, বানানা রিপাবলিকান দেশ। ওই ব্যঙ্গ ইউরোপের আরও নানা দেশের প্রাপ্য, জার্মানির জন্যে তো বটেই। অভিজ্ঞতা থেকে একটি ঘটনা বলি, অগাস্ট ১৯৮৭। এক সন্ধ্যায় এসএফবি (জেন্ডার ফ্রাইস বার্লিন)-র টিভি অনুষ্ঠান দেখছিলুম। পশ্চিম বার্লিন থেকে প্রচারিত। দেখি, পশ্চিম বার্লিনের কলাখাদকরা অর্ধেক কলা খেয়ে ডাস্টবিনে ছুঁড়ে দিয়ে বলছে, নষ্ট করলাম। আহা, বাকিটা যদি পূর্ব জার্মানির ভাইবোনদের পাঠাতেম, ওরা খেত। ওরা তো ‘কলাঁও’ খেতে পায় না। কাকে বলে মিথ্যে প্রোপাগান্ডা, বুঝলুম। পূর্ব বার্লিনে গিয়ে দেখলুম (১৯৮৭ সালে) পূর্ব বার্লিনের মানুষ দিব্যি কলা খাচ্ছে। কলার দামও সস্তা। কলা আসছে ল্যাটিন আমেরিকার নানা দেশ থেকে এবং ওই সব কলার বড় চালান পূর্ব জার্মানি থেকে পশ্চিম জার্মানিতে। তাহলে কেন এই প্রোপাগান্ডা? উদ্দেশ্য একটিই, কমিউনিস্ট পূর্ব জার্মানিকে বিভ্রান্ত করা, কমিউনিজম বিষয়ে বিষিয়ে তোলা। নানা ঘটনার পাঁচমিশেলে পশ্চিম জার্মানি সফল। সঙ্গে আমেরিকার রিয়াজ (জওঅঝ) রেডিও, টিভি তো সারাক্ষণই, হামেশাই। পূর্ব বার্লিনসহ গোটা পূর্ব জার্মানির যুবসমাজকে কিভাবে তছনছ করেছে, টের পাচ্ছে এখন। পঁচিশ বছর আগের যুবদল আজ প্রৌঢ়। দেখছে অতীত। মরীচিকার চাকচিক্যে দিশেহারা হয়ে যে ভুল করেছিল, সাধ্যি নেই আর শোধরানোর। গলা ফাটিয়ে হা-পিত্যেশ করেও যে তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই। ফেডারেল রিপাবলিক অব জার্মানি আজ বানানা রিপাবলিকেরই এপিঠ-ওপিঠ। ৩ অক্টোবর ১৯৯০ সালে দুই জার্মানির আইনহাইটে (একত্রীকরণ) বহুমান্য সাহিত্যিক গ্যুয়েন্টার গ্রাস পই-পই করে বলেছিলেন (‘টু স্টেটস ওয়ান নেশন?’ বইয়ে), রাষ্ট্রীয়সমাজ বিভেদ আজ থেকে শুরু হলো। এখনই বিভেদ প্রতিরোধ করা জরুরী। প্রোফেসি-বাণী। আজ আমরা কি দেখছি, দুই জার্মানির একত্রীকরণের ২৫ বছর পরে? চিত্রটা ভয়াবহ। কতটা ভয়ঙ্কর, জার্মানির পয়লা দৈনিক ফাঙ্কফুর্টার আলগেমাইনে লিখেছে (প্রচ্ছদে রঙিন কলা ছাপিয়ে), বানানা রিপাবলিক জার্মানি আজ ইউরোপীয় ইউনিয়নে স্বৈরশাসক। ইউরোপের বাকি দেশগুলোকে পদানত করে সর্বেসর্বা। আলামত আদৌ ভাল নয়। আজকের ধনতান্ত্রিক জার্মানি নিজেকে বিশ্বসেরা করার পাঁয়তারায় মরিয়া। আমরা দেখছি এই পাঁয়তারা নানা ঘরানায়। বিশদ বললে জার্মান সরকার গণতন্ত্রের দোহাই দিয়ে টুঁটি চেপে ধরতে পারেন, বিদেশীকে। তো, চুপ থাকাই ভাল। কতটা আর চুপ থাকা যায়! গত পঁচিশ বছরে দেখছি, জার্মানির বানানা রিপাবলিকের পতন নানা সেক্টরেই। রাষ্ট্রনেতারা যতই বলুন, ফাঁকা আওয়াজ। কতটা আওয়াজ, টের পাই নিত্যদিনই। জার্মানির একত্রীকরণের পঁচিশ বছর উপলক্ষে বিশাল আয়োজন, রাইখস্ট্যাগ (সংসদ ভবন) এবং ঐতিহাসিক ব্রান্ডেনবুর্গ গেটের সামনে, হরেক আতশবাজির খেল, চোখ ধাঁধানো অনুষ্ঠান, বিশাল পর্দায় পূর্ব জার্মানির কমিউনিস্ট সরকারের অত্যাচার প্রদর্শিত। কিন্তু একবারও দেখানো হলো না পশ্চিম জার্মানির শত-শত মানুষ ভিক্ষাপাত্র হাতে নিয়ে রাস্তায়-রাস্তায় ভিক্ষারত। মনে রাখবেন, দুই জার্মানি এক হলেও, মহাসমারোহে ২৫ বছর উদযাপন করলেও, পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানি এখনও বিভক্ত মনমানসিকতায়, সমাজে, অর্থনৈতিক বৈষম্যে। দেখছি সেই ৩ অক্টোবর ১৯৯০ থেকেই। নামমাত্র দুই জার্মানির একত্রীকরণের ২৫ বছর। লেখক : কবি, জার্মানি থেকে
×