ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

মিনা ট্র্যাজেডি প্রত্যক্ষদর্শীর ভাষ্য

প্রকাশিত: ০৫:৩৩, ৫ অক্টোবর ২০১৫

মিনা ট্র্যাজেডি প্রত্যক্ষদর্শীর ভাষ্য

মিনায় ট্র্যাজেডির ব্যাপকতা ও ভয়াবহতা নিয়ে দেশে ফিরে আসার পর যতটা জেনেছি মক্কা বা মদিনায় ততটা জানিনি। তবে দেশে ফিরে কতিপয় খটকা লেগেছে। প্রথম খটকা লাগে মিনায় নিহতের সংখ্যা নিয়ে, দ্বিতীয় খটকা হলো এই দুর্ঘটনার কারণ নিয়ে। দেশে ফেরার আগে সংখ্যাটি সম্পর্কে সম্যক জ্ঞানই ছিল না। সর্বশেষ পরিসংখ্যানে দেখা যায় বাংলাদেশী মৃতের সংখ্যা ৪৩ জন। ৩০ সেপ্টেম্বর সংখ্যাটি ছিল ২৬ জন। সেদিন আমরা দেশে ফিরে আসি। ২৪ সেপ্টেম্বর অর্থাৎ দুর্ঘটনার দিন আমরা ঘটনাস্থল থেকে ১৫ মিনিটের দূরে ছিলাম। আমার সঙ্গে আমার স্ত্রী মোর্শেদা চৌধুরী ও জ্যেষ্ঠ সন্তান ড. মুশফিক এম চৌধুরী ছিলেন। আমরা খুব সম্ভবত নয়টা ১৫ মিনিটে কঙ্কর মারা শুরু করি। এখানে আমার ছেলে একটা মুনশীয়ানা বা কৌশলের পরিচয় দেয়। এটা আমার কাছে বিজ্ঞানসম্মত মনে হয়েছে। আমরা বড় জামারায় বা বড় শয়তানকে প্রথমাংশে কঙ্কর না ছুড়ে শেষাংশে গিয়ে পাথর ছুড়ি। কেননা শেষাংশে ভিড়ভাট্টা বরাবরই কম থাকে। অন্যদের মতো আমরা এসব কঙ্কর মুজদালিফা থেকে সংগ্রহ করেছিলাম। শেষাংশে পৌঁছাতে তেমন ভিড় আগেও আমার ছেলে দেখেনি বা এবারে আমরা দেখিনি। তবে আগেরবারের মতো হাজীদের নিয়ন্ত্রিত ও শৃঙ্খলিত করার বিষয়টা তেমন কঠোর ছিল না। আমরা কঙ্কর মারা শেষ করে বামদিকে মোড় নিয়ে মিনার তাঁবুমুখী পথে রওয়ানা হলাম। আমাদের সঙ্গে একজন গাইডও ছিল, যিনি অত্র এলাকা সম্পর্কে অনেকটা অবগত ছিলেন। আমরা ডানদিকে মোড় নিয়েও মিনার ক্যাম্পে যেতে পারতাম। জামারায় যাওয়ার পথে রাস্তার সংকেতে দেখলাম মিনার ক্যাম্প থেকে জামারার দূরত্ব ০.৯ কিলোমিটার। ফেরার পথেই এটা ছিল দিকনির্দেশ। আমাদের তাঁবুটি ছিল একটা ফ্লাইওভারের নিচে। আমরা রোদে পুড়ছিলাম আর ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। তাই দ্রুত তাঁবুতে ফিরতে গিয়ে যতটা কম সময় দেয়া যায় তার ব্যবস্থা নিলাম। কিন্তু তাঁবুতে ঢুকতে আমাদের প্রথম কয়েকটি প্রয়াস ব্যর্থ হলো। কেননা, সবকটি প্রবেশপথ তালা কিংবা নিরাপত্তাকর্মী দিয়ে বন্ধ রাখা ছিল। আমরা মিনা থেকে বরং আরাফাতের দিকে এগোতে এগোতে হঠাৎ একটি প্রবেশপথ পেয়ে গেলাম। সে পথ পেরিয়ে আমরা জামারামুখী পথে হাঁটতে হাঁটতে মিনায় আমাদের যাত্রাস্থলটি পেয়ে গেলাম। এখানেও ক্যাম্পে ঢুকতে গিয়ে বাধা পেলাম। তবুও অনেকটা জোর করেই আমাদের ক্যাম্পে ঢুকলাম। এই সময় চতুর্দিক থেকে কেবল এ্যাম্বুলেন্সের ছোটাছুটির আওয়াজ পেলাম। এ্যাম্বুলেন্স ও সরকারী গাড়ির ছোটাছুটির কারণে আমাদের জন্য প্রেরিত ট্যাক্সিটি তার গন্তব্যস্থলে পৌঁছতে পারল না। আগেই বলেছি, আমাদের কঙ্কর নিক্ষেপ ও দুর্ঘটনার সময় ব্যবধান ছিল ১৫ মিনিট। কঙ্কর মেরে আসার পথে আমরা নিরাপত্তা বাহিনীর কোন তৎপরতা দেখিনি। নিশ্চয়ই সৌদি রাজপুত্র প্রায় ২Ñ৩ শত সৈনিক নিয়ে ওই এলাকায় পৌঁছে থাকলে নিরাপত্তা কর্মীদের যে ধরনের তৎপরতা থাকার কথা ছিল সে ধরনের তৎপরতা আমাদের চোখে পড়েনি। তবে দুর্ঘটনার সহায়ক হিসেবে নিয়ন্ত্রণে নিষ্ক্রিয়তা বা প্রবেশপথগুলো বন্ধ করে দেয়ার একটা ভূমিকা রাখতে পারে। অবশ্য দুর্ঘটনায় প্রধান ভূমিকাটি রেখেছেন যারা দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন। তাদের একদল ছিল সোজাসুজি জামারামুখী আর অপর দলটি সে দলের ওপর ভিন্ন দিক থেকে হামলে পড়েন। পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায় ইরানীদের ওপর আফ্রিকান দেশের হাজীরাই হয়ত হামলে পড়েন। এখানে ব্যাপারটা এমন যে, একজন মাটিতে পড়ে গেলে আর একজন তার ওপর পড়ে যাবেই এবং তার ওপর অন্যরা একে একে হামলে পড়বে। এখানে নিয়োজিত নিরাপত্তাকর্মীর সংখ্যাটাও কম ছিল। জামারায় পৌঁছে গেলে অনেক হাজীই বিশেষত আফ্রিকান হাজীরা দিগি¦দিক হয়ে পড়েন। অনেকেই দুনিয়াদারী ভুলে যান, কেউ কেউ বড় পাথর ছুড়ে মারেন, কেউ আবার পানির বোতল বা পায়ের স্যান্ডেলও ছুড়ে মারেন। অনেকটা কা-জ্ঞানহীনভাবে কাজটি চলতে থাকে। এই সময়ে যে প্রচ- চাপ সৃষ্টি হয় তা সীমিতসংখ্যক নিরাপত্তাকর্মী সামাল দিতে পারে না। একথা আমি প্রায় ৫০ বছর আগেই আমার নানার মুখে শুনেছিলাম। তাই আমরা একটু বেশি সতর্ক ছিলাম। শুনেছি, নিরাপত্তাকর্মীর সংখ্যা আরাফাত, মিনা, মুজহানিয়া ও জামারায় ছিল সর্বসাকুল্যে এক লাখ। তাদের অনেকেই ছিল ভলান্টিয়ার জাতীয় বা আনাড়ি। সেখানে সেনাবাহিনীর লোক ছিল বলে আমার মনে হয়নি। মক্কা ও মদিনায় অন্য ধর্মীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ। তাই নিরাপত্তা ও সামগ্রিক ব্যবস্থাপনায় সৌদি ও পাকিস্তানী ছাড়া অন্যদের ভূমিকা গৌণ এবং তাদের দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন হতেই পারে। আমার কাছে মনে হয়নি যে, ইরান পরিকল্পিতভাবে বা সৌদি সরকার প্রিন্সের অযাচিত আগমন ঘটিয়ে এমন অবস্থার সৃষ্টি করেছে। সৌদি আরবের মতো দেশে ১৬০ দেশের বিশ লাখ হাজী সামাল দেয়া নেহাতই কঠিন কাজ। নিহতের সংখ্যা সম্পর্কে আরও কিছু কথা আছে। যে সংখ্যা দেয়া হচ্ছে তার উৎস নিয়ে প্রশ্ন আছে। প্রশ্ন আছে যে, নিহতের সংখ্যাটা কি মিনায় নিহতের সংখ্যা, না হজ উপলক্ষে নিহত সামগ্রিক সংখ্যা। দুর্ঘটনার পরই জানলাম যে, সংখ্যাটা ৩১৯ জন এবং তার মধ্যে বাংলাদেশের ৫০ জনের মতো রয়েছেন। ঘটনার পরই বাংলাদেশে টেলিফোন করে জানলাম যে, বাংলাদেশীর সংখ্যা হলো ৫ জন। তারপর থেকেই বাংলাদেশীর মৃতের সংখ্যা কয়েক ঘণ্টায় আর উচ্চারিত হলো না। কিছু মিডিয়ায় অন্যান্য দেশের নাম এলেও আমাদের দেশের নাম আর শুনলাম না। আবারও বলছি, সৌদি আরবে চলাচল, এমনকি মিডিয়ার প্রবেশেও বিধিনিষেধ আছে। ফলে তথ্য পেতে বিলম্ব অবাঞ্ছিত কিছু নয়। মদিনা থাকাবস্থায় সংখ্যাটা জানলাম ৭৬৯ জন। তারপর মদিনায় প্লেনে ওঠার সময় জানলাম সৌদি সরকার মৃত ১২০২ জন জানিয়ে ছবি বিভিন্ন মর্গে টাঙিয়ে দেয়। সৌদি রাজা সালমানের দুর্ভাগ্যই বলা যায়। এই প্রথমবারের মতো হজের সময় ক্রেন দুর্ঘটনায় ১০৯ জন এবং পদদলিত ঘটনায় এত লোক মারা গেছে। অগ্নিকা-ের ঘটনাও ঘটেছে। সুলতান নিজেই ইরান ও তার পরিবারের পক্ষ থেকে বৈরিতার সম্মুখীন হয়েছেন। বহির্বিশ্বেও তার বৈরিতা রয়েছে। আমার মনে হচ্ছে, সংখ্যা নিয়ে রাজনীতির ভিন্ন কৌশল থাকতে পারে। অন্তত হজ উপলক্ষে পবিত্র ভূমিতে এমনটি হওয়া অনুচিত। পদদলন ছাড়াও স্বাভাবিক মৃত্যু স্বাভাবিক ঘটনা। আমরা বলতে গেলে অধিকাংশ জামাত হারাম শরীফে পড়েছি। প্রতি ওয়াক্ত ফরজ নামাজের পর আমরা মৃতদের উদ্দেশে জানাজার নামাজ পড়েছি। তবে মৃতের সংখ্যাটি কত তা জানতে পারিনি। মদিনাতেও আমরা প্রতি ওয়াক্ত নামাজের পর জানাজার নামাজ পড়েছি। অতএব মৃত্যুর বিভীষিকা ও ব্যাপকতা বিশ্লেষণে এই বিষয় কটি মনে রাখতে হবে। ক্রেন দুর্ঘটনায় নিহতরা দু’কোটি ও আহতরা প্রায় এক কোটি টাকা এবং চিকিৎসা সুবিধা পেয়েছেন। এই ক্ষতিপূরণের অঙ্কটা মৃতের সংখ্যা বাড়িয়ে দিতেও আবেগনির্ভর কারণ খুঁজতে সহায়তা করতে হবে। তবে আমি মনে করি, রাসূলের পবিত্র ভূমিতে কেউ তেমন দাবি করবেন না, ইরানীরাও মৃতদের নিয়ে রাজনীতি করবে না। ইতোমধ্যে সৌদি হজ কমিশনের চেয়ারম্যান গ্রান্ড মুফতির সঙ্গে দেখা করেছেন। মহামান্য গ্রান্ড মুফতিও একমত হয়েছেন যে, এর চেয়ে অধিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা দেয়া সম্ভব নয়। আমি মূলত ব্যবস্থাপনার অধ্যাপক। আমার সীমিত জ্ঞানে বলতে পারি, সৌদি সরকার তার সীমিত জনসম্পদ দিয়ে সাধ্যমতো সবকিছু করেছে। তবে পূর্বাহ্নে সেনা ও বিমানবাহিনী মোতায়েন করলে হয়ত দুর্ঘটনার ব্যাপকতা কমানো যেত। তারপরও একটি কেন্দ্রীয় তদন্ত কমিটি আবশ্যক, যা ইতোমধ্যে গঠন করা হয়েছে। যে সব দেশের হাজীরা মৃত্যুবরণ করেছেন সেসব দেশেও তদন্ত কমিটি গঠন করা যেতে পারে। তাতে ভবিষ্যতে এমন দুর্ঘটনার প্রচ-তা হ্রাস করা যাবে। ২০০৬ সাল থেকে নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও অবকাঠামো সৃষ্টিতে ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয়েছে। ভবিষ্যতে আরও হবে বলে আমার বিশ্বাস। লেখক : উপাচার্য, ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ
×