ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

জাকারিয়া স্বপন

এরাও ডাক্তার হবে, রোগী দেখবে!

প্রকাশিত: ০৫:৩২, ৫ অক্টোবর ২০১৫

এরাও ডাক্তার হবে, রোগী দেখবে!

এবারের মেডিক্যালে ভর্তি নিয়ে বেশ জটিলতা তৈরি হয়েছে। একটি বড় অংশ দাবি করছে যে, প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ে গিয়েছিল এবং সেই ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্রে যারা ভাল ফল করেছে, তাদের ভর্তি করা হচ্ছে। তাদের দাবি, এই ভর্তি পরীক্ষা বাতিল করা হোক এবং নতুন করে পরীক্ষা নেয়া হোক। এই দাবিকে সামনে রেখে তারা রাস্তায় নেমেছিল। পুলিশ তাদের ওপর চড়াও হয়েছে। মেয়েদের গলার টুঁটি চেপে ধরার ছবি পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। পাশাপাশি, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িত অনেককেই আটক করেছে এবং বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের এক কর্মকর্তা তাদের হেফাজতে মৃত্যুবরণ করেছেন। যদিও স্বাস্থ্য অধিদফতর পত্রিকায় বিশাল আকারে বিজ্ঞাপন দিয়ে বলেছে যে, প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়াটা কেবলই গুজব। তাই এই গুজবে কান না দেয়ার পরামর্শ দেন তারা। পত্রিকার বিজ্ঞাপনে তারা অবশ্য ব্যাখ্যা করেননি, কেন তাহলে ইউজিসি’র কর্মকর্তাকে জীবন দিতে হলো! প্রশ্নপত্র যদি ফাঁস না-ই হবে, তাহলে তো আর এত ধরপাকড়ের কোন প্রয়োজন ছিল না। এই কোমলমতি ছাত্রছাত্রীদের ওপর নির্যাতন দেখে তাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন সমাজের অনেক মানুষ। তারাও রাস্তায় নেমেছেন। মাইকে চিৎকার করে কথা বলছেন। কিন্তু এটা বাংলাদেশ; এখানে শো-ডাউন ছাড়া কিছু হয় না। (প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ভ্যাট নিয়ে শো-ডাউন আমরা দেখেছি।) তাই এই ছাত্রছাত্রীদের নরম হাতের মিছিল, আর কিছু সচেতন মানুষের মাইকে চিৎকারে এদেশে কিছুই হবে না। ১৯১৫-১৬ সালের শিক্ষাবর্ষের এমবিবিএস/বিডিএস শিক্ষার্থীরা ফাঁস হওয়া বিতর্কটি মাথায় নিয়েই ক্লাসে যেতে শুরু করবে। এদিকে মন্ত্রণালয় যতই চিৎকার করুক, যত বড় বিজ্ঞাপনই দিক না কেন, মানুষ তো জেনে গেছে, ১৯১৫-১৬ সালে একদল ছেলেমেয়ে ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা দিয়ে ডাক্তারি পড়তে এসেছিল এবং তাদের কেউ কেউ ডাক্তারও হবে, এই দেশে রোগীও দেখবে! দুই. বাংলাদেশে কিছু আমলা আছেন, যারা কখনই ‘সরি’ বলতে শেখেননি। তারা মোটামুটি ফেরেস্তাদের মতো; তাদের কোন ভুল হতে পারে বলে তারা মনে করেন না এবং তাদের এটিচিউড এমন যেন, পুরো দেশটা তাদেরই। বাকিরা তাদের জমি ইজারা নিয়ে চাষবাস করে খায়; ওই ক্ষুদ্র প্রজাতির আবার মতামত কী! তারা নিজেদের এমনভাবে প্রতিষ্ঠিত করেন যে, রাজনৈতিক নেতারা পর্যন্ত তাদের সঙ্গে অনেক ক্ষেত্রে পেরে ওঠেন না। তারা মন্ত্রী এবং যাবতীয় অন্য সবাইকে ছড়ি ঘুরিয়ে বেড়ান এবং মনে মনে একদিন অবসরে যাওয়ার পর রাজনৈতিক টিকেট নিয়ে নির্বাচন করার স্বপ্নও দেখেন। যে কারণে তারা নিজেদের এলাকায় অনেক উন্নতির ছোঁয়া রাখেন, প্রভাব রাখেন, বিভিন্ন প্রজেক্টের কর্মকা- নিজের এলাকায় পাঠিয়ে দেন (সেটা কাজে লাগুক, আর নাই লাগুক)। এগুলো তার নির্বাচনে দাঁড়াবার প্রাক-প্রস্তুতি। তবে সবাই যে শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে আসতে পারেন, তা নয়। এমন অনেক বাঘের চেয়েও প্রতাপশালী সচিবকে দেখা গেছে, বিড়ালের চেয়েও নরম হয়ে অবসর জীবন যাপন করতে। এই কঠিন বৈপরীত্য তারা কিভাবে মেনে নেন, সেটা অবশ্য গবেষণার বিষয় হতে পারে। বাংলাদেশ বর্তমানে এমন কিছু মানুষের হাতে চলে গেছে। তারা চাইলে দিন, নইলে রাত। তারা কিছুতেই স্বীকার করবেন না যে, কোথাও ঝামেলা হয়েছে। তাদের কাছে প্রশ্নপত্র কখনই ফাঁস হয় না, সবাই খুব ভালভাবে পড়েই গোল্ডেন জিপিএ পেয়ে যাচ্ছে, কলেজে ভর্তিতে কোন সমস্যা নেই, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিতে কোন সমস্যা নেই। কিন্তু এরাই দেখবেন অবসরে যাওয়ার পর, পত্রিকায় কলাম লিখবে, নয়ত টিভির টকশোগুলোতে গিয়ে হাজারটা সমস্যা নিয়ে আলোচনা করবে। তারা যদি নিজেদের ক্ষমতাকালীন এই সমস্যাগুলোকে এড্রেস করতেন, তাহলে আমরা একটি ভিন্ন বাংলাদেশ পেতাম। তারা যদি একটিবারের জন্য মনে করতেন, ঠিক আছে সমস্যা হয়েছে, দেখি কিভাবে ঠিক করা যায়। তাহলে সমস্যাগুলো চিরতরে সমাধান হয়ে যেত। কিন্তু তারা কখনই সমস্যা যে আছে, এটাই মেনে নিতে পারেন না; কিংবা তাদের রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষের কারণে মেনে নেন না। কিন্তু আমরা তো মানুষ। আমাদের ভুল হতে পারে। আমাদের তৈরি সিস্টেমে ভুল থাকতে পারে। আমাদের তৈরি সফটওয়্যারে ত্রুটি থাকতে পারে। সেটা মেনে নেই। তারপর দেখি কিভাবে সেটাকে সমাধান করা যায়। কিন্তু আমরা কখনই সেই পথে হাঁটি না। ফলে, ধীরে ধীরে সিস্টেমগুলো মরতে বসেছে এবং ভবিষ্যতে আরও হবে। এই গ্রহে যে দেশ এবং জাতি নিজেদের উন্নত একটি জায়গায় নিয়ে যেতে পেরেছে, তারা প্রথমেই ভুলটাকে স্বীকার করে নিয়ে ‘সরি’ বলেছে এবং পরবর্তীতে যেন সেটা না হয়, তার প্রচেষ্টা করেছে। আপনি যখন সরি বলেন, তখন আপনিই সেটাকে ঠিক করার জন্য সচেষ্ট হবেন। নইলে কখনই সেটাকে এড্রেস করবেন না। আমরা যেহেতু ধরেই নিয়েছি আমরা ভুল করতে পারি না, তাই সেটাকে ঠিক করার তো আর প্রশ্নই আসে না! তিন. মা-বাবা যেন জোর করে আমাকে ডাক্তার বানাতে না পারেন, সেজন্য আমি কলেজে বায়োলজি সাবজেক্টটা নেইনি। আমাদের সময় ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হতে পারে, কিংবা সেটার পেছনে ছোটার মতো অবস্থা আমাদের ছিল না। কঠিন পড়ালেখা করে কোথাও ভর্তি হতে হয়েছিল এবং ক্লাসে গিয়ে বুঝতে পেরেছি, তারাও কত কষ্ট করে এই নদী পার হয়ে এসেছেন এবং তাদের মেধা এবং যোগ্যতা কোন্্ পর্যায়ের! এখনও ভাবলে গা শিউরে ওঠে। নিজে ডাক্তারি না পড়লেও আমি কাছ থেকে অসংখ্য বন্ধুকে দেখেছি, কী কঠিন সেই লেখাপড়া! ঢাকা মেডিক্যাল, সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল, ময়মনসিংহ মেডিক্যালে আমার অসংখ্য বন্ধু পড়ত এবং তাদের সবাই ওই সময়ে প্রথম/দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছিল। এমনকি পরবর্তীতে ডাক্তারি পরীক্ষাতেও কেউ কেউ প্রথম হয়েছিল। তাদের কাছ থেকে যেটুকু শুনেছি, ডাক্তারি পেশার জন্য প্রয়োজন ফটোগ্রাফিক মেমরি। পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা পড়ে যেতে হবে এবং সেগুলো মনে রাখতে হবে। যার মেমরি যত বেশি ফটোগ্রাফিক, তার জন্য তত সুবিধা। নইলে এই প্রফেশনে ভাল করার সুযোগ নেই বললেই চলে। যদি এই হয় বাস্তবতা, তাহলে যারা আজ ফাঁস করা প্রশ্নে ভাল ফলাফল করে বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হলো, তারা কিভাবে কী করবে সেটা আমার মাথায় কিছুতেই ঢুকছে না। তারা কিভাবে ডাক্তার হবে, আর কিভাবে রোগী দেখবে? আমার তো মনে হয়, তার নিজের পরিবারের সদস্যরাই তাকে ডাক্তার হিসেবে মেনে নেবে না। তাহলে তার ভবিষ্যত কি? নির্ঘাত রাজনীতি! কিছুদিন আগে ঢাকার একটি বিখ্যাত হাসপাতালে গিয়েছিলাম। যার সঙ্গে কথা হচ্ছিল, তিনি হাসপাতালটি পরিচালনা করেন। তাকে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, ভাই আপনি এই হাসপাতালটি চালান কিভাবে? এত রোগী! এদের চিকিৎসা ঠিক মতো হয়? হাসতে হাসতে তিনি বলেছিলেন, ভাই আপনি তো ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে বেঁচে গেছেন। এই লাইনে আপনাকে আসতে হয়নি। সবাই তো শুধু হাসপাতালগুলোকে দোষ দেয়। কিন্তু আপনি কি জানেন, আমরা কী টাইপের ডাক্তার পাই? আপনার কোন ধারণা আছে, সারাজীবনে তারা কী লেখাপড়া করেছে, কিভাবে ডাক্তারি সার্টিফিকেট নিয়ে নিয়েছে, আর কী তারা শিখেছে? আমি কোন উত্তর না দিয়ে ফ্যাল ফ্যাল করে তার উত্তরের জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। তিনি কথার রেশ ধরেই বলতে থাকেন, আমরা দেশের একটা বড় হাসপাতাল হওয়ার পরও এখানে যা পাই তাদের ডাক্তারি সম্পর্কে বেসিক জ্ঞানটুকুও থাকে না। তারা কিভাবে ডাক্তার হয়ে এসেছে, এটা আল্লাহ ছাড়া আর কেউ জানে না। আগে আমরা তবুও কিছু পেতাম; এখন হাতেগোনা কিছু পাই। এবার বোঝেন হাসপাতাল কিভাবে চালাই! বিষয়টি হতাশাব্যঞ্জক। আমি আমার ডাক্তার বন্ধুদের জিজ্ঞেস করি। তারাও মাথা নাড়িয়ে বলে, লেখাপড়ার মান ভয়াবহ রকমের খারাপের দিকে চলে গেছে। আন্তর্জাতিক বাজার তো অনেক দূরে, স্থানীয় রোগীদের এরা কিভাবে দেখবে তার ঠিক নেই। একজন প্রফেশনাল ডাক্তার হওয়ার জন্য যে ইন্টেলেকচুয়াল ক্যাপাসিটি থাকা দরকার, তা ধীরে ধীরে কমে গেছে। তার প্রমাণও আমরা চাক্ষুস দেখতে পাই। যারা একটু এফোর্ড করতে পারেন, কিংবা রাজনীতিবিদ নয়ত আমলা - তারা কেউই দেশে চিকিৎসা করান না। তারা জানেন, কি ‘মাল’ তারা তৈরি করেছেন! তাদের থেকে ভাল তো আর কেউ জানে না! চার. বাংলাদেশ এই পৃথিবীর একটি অন্যতম নবীন দেশ। এই দেশের জনসংখ্যার শতকরা ৭০ ভাগের মতো মানুষ বয়সে ৩৫-এর নিচে অর্থাৎ, প্রায় ১২ কোটির মতো মানুষ বৃদ্ধ নয়। এই গ্রহের অনেক জাতি আছে, যেখানে তরুণ-তরুণীর সংখ্যা কম; বৃদ্ধের সংখ্যা বেশি। ফলে সেই জাতি বেশ একটা ঝামেলার ভেতর রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ এই একটি কারণেই সবচেয়ে বেশি সম্ভাবনাময় দেশ। আমরা এখন যে প্রবৃদ্ধি দেখি, যা শতকরা ৬ ভাগের মতো- তার একটি অন্যতম কারণ হলো নতুন জনগোষ্ঠী, নতুন শক্তি, নতুন বাজার, নতুন চাহিদা, নতুন ইকোনমি। এই জনবলের একটি বিশাল অংশ চলে গেছে পোশাক শিল্পে। আরেকটি বড় অংশ চলে গেছে প্রবাসী শ্রমিক হয়ে। কিন্তু এই শ্রমিকগোষ্ঠীকে যদি দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তর করা যেত, তাহলে বাংলাদেশ আরও দ্রুত উন্নত দেশের দিকে ধাবিত হতো। অনেকের হয়ত মনে আছে, একটা সময়ে ইরান বাংলাদেশ থেকে অসংখ্য ডাক্তার নিয়েছিল। আমাদের ডাক্তাররা বিশ্বে সুনাম অর্জন করেছিল এবং সেই ডাক্তাররা এখন সারাবিশ্বে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছেন। তারা আমাদের পতাকা বহন করে আছেন। কিন্তু সেই প্রক্রিয়াটা যদি আমরা ধরে রাখতে পারতাম, আমরা যদি মানসম্মত চিকিৎসক তৈরি করতে পারতাম, তাহলে এই গ্রহের অনেক দেশ যারা বৃদ্ধ জাতিতে পরিণত হয়েছে, তারা আমাদের ওপর নির্ভর করত। নিজের দেশের চাহিদা মিটিয়ে আমরা পুরো বিশ্বকে সেবা দিতে পারতাম। এই সুযোগটি কাজে লাগিয়েছে থাইল্যান্ড আর ভারত। এই দুটি দেশে সারাবিশ্ব থেকে এত মানুষ চিকিৎসা নিতে আসে, যা তাদের মূল অর্থনীতিকে চাঙ্গা করে রেখেছে। এমনকি বাংলাদেশের মানুষও চিকিৎসা নিতে ভারতে, নয়ত থাইল্যান্ডে চলে যায়। অথচ সুযোগটা ছিল আমাদেরই। আর এখন যদি ফাঁস হওয়া প্রশ্নে ডাক্তার হতে হয়, তাহলে তো বুঝতেই পারছেন কোথায় যেতে পারে এই পথ চলা! পরিশেষে, শুধু এটুকু বলতে পারি, এই দেশে চিকিৎসা সেবা কখনই উন্নত হবে না, যতদিন না এই দেশের প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি, বিরোধীদলীয় নেত্রী এবং সমাজের উঁচু পর্যায়ের মানুষেরা নিজের এবং তাদের পরিবারের স্বাস্থ্যের চিকিৎসা এই দেশে নিয়মিত করাবেন। তারা যেহেতু নিজের জীবন নিয়ে এই সেবাটি নেন না, তাই সাধারণ মানুষকে কে চিকিৎসা দিল, আর কী চিকিৎসা দিল তাতে কার কী আসে যায়? আর তোমরা যারা প্রশ্নপত্র ফাঁস করে ডাক্তার হয়েছ, তাদের জন্য ছোট একটি কথা বলে রাখি। আজ থেকে ৫ বছর পরেই যখন কোথাও চিকিৎসা সেবা নিতে যাব, আমরা প্রথমেই জিজ্ঞেস করব, তুমি আবার ১০১৫-১৬ সালের ব্যাচ না তো? ৩ অক্টোবর ২০১৫ লেখক : তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ এবং সম্পাদক, প্রিয়.কম ুং@ঢ়ৎরুড়.পড়স
×