ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আবুল মাল আবদুল মুহিত

ছেলেবেলা ও ছাত্রজীবন

প্রকাশিত: ০৫:২২, ৩ অক্টোবর ২০১৫

ছেলেবেলা ও ছাত্রজীবন

জন্ম ও পারিবারিক কথা (২ অক্টোবরের পর) আমি যে বাড়িতে জন্মগ্রহণ করি সেখানে আমার দাদার জমি ছিল ৩ বিঘার কিছু বেশি। আমার আব্বা যে বাড়িটি নির্মাণ করলেন তার পাশে একজন বৈষ্ণব মুহুরি ৩/৪ কাঠা জমিতে শনের ছাদের মাটির বাড়িতে বসবাস করতেন। সেই দম্পতি সম্ভবত ১৯৪০ সালে বা তার সামান্য পরে সংসার ছেড়ে বৈষ্ণব ভিক্ষু হিসেবে বেরিয়ে পড়েন। তার কুটিরটি ভেঙ্গে আমাদের বাড়ির এলাকা বর্ধিত করা হয়। তার পাশে ৭ কাঠা জমি সম্ভবত আগেই বন্দোবস্ত দেয়া হয় একজন কবিরাজকে। যিনি পরবর্তীকালে সিলেটে একজন শ্রেষ্ঠ কবিরাজ রসময় ভট্টাচার্য হিসেবে পরিচিতি পান। এই ৭ কাঠা এবং আরো প্রায় বারো কাঠা ছাড়া বাকি প্রায় দেড় বিঘা নিচু জমি ছিল এবং বর্ষাকালে সেখানে পানি জমতো। উঁচু প্রায় আধা বিঘা জমিতে আমার দাদা কোন এক সময়ে একটি সুন্দর বাড়ি নির্মাণ করেন এবং সেটি ১৯৬১ সাল পর্যন্ত ভাড়ায় ছিল। আমাদের বাড়ির পেছনের নিচু ভূমি ১৯৩৯-৪১ সালের মধ্যে পাহাড় কেটে লালমাটি ট্রাক দিয়ে বয়ে এনে ভরাট করা হয়। তার ফলে আমরা আমাদের বাসার পেছনে একটি ছোটখাটো ফুটবল মাঠ পেয়ে যাই। এই মাঠে পরবর্তীকালে পঞ্চাশের দশকের শেষ দিকে আমার আম্মা অনেক গাছপালা লাগিয়ে ছোটখাটো একটি বন সৃষ্টি করেন। সেখানে আনারসের বাগান এবং বাঁশঝাড়ও গড়ে ওঠে। শৈশবে এই এলাকায় একমাত্র মুসলমান পরিবার ছিল আমাদের পরিবার। এই পাড়ায় (ধোপাদীঘির দক্ষিণ এবং পূর্ব পাড়ে) থাকতেন হিন্দু ভদ্রলোকেরা। তাদের মধ্যে কয়েকজন ছিলেন উকিল, ২ জন মোক্তার, ১ জন মুহুরি, একটি পরিবারে দুই ভাই ছিলেন জেলা আদালতের কর্মচারী। পূর্ব পাড়ের শেষ মোড়ে ছিল ধোপাপাড়া এবং ধোপাদীঘিটি তাদের জন্যই নাকি নবাব আমলে খনন করা হয়। ধোপাদীঘিটিকে ছেলেবেলা একটি সাগর মনে হতো এবং তার পানি ছিল খুব স্বচ্ছ। প্রায় বিশ বিঘা ছিল তার আয়তন, তবে তার প্রায় অর্ধেক এলাকা পৌরসভা এক সময় ভরাট করে ফেলে। কিন্তু বাকি অর্ধেক প্রায় মরা দীঘি হিসেবে এখনও নাকি ধোপাদের দখলে আছে। দক্ষিণ পাড়ে ছিল একজন উকিল বাবুর বাড়ি। জেলা আদালতের কর্মচারী দুই ভাইয়ের বাড়ি। আর একটি সুদৃশ্য বাড়ি ছিল অবসরপ্রাপ্ত ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট মহেন্দ্র ধামের। মহেন্দ্র বাবুর ছেলে পয়বেন্দু ধাম আমার কৈশোরে পূর্ববাংলায় বিচারিক সার্ভিসে যোগদান করেন এবং খুশি হয়ে আমাদের সেই সংবাদটি পরিবেশন করেন। ষাটের দশকে তিনি কোন সময় ময়মনসিংহে হয়তো জেলা জজ ছিলেন। কিন্তু বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা পাবার পর তার আর কোন খোঁজ পাইনি এবং তাদের বাড়িতে এখন অনেক লোকের বাস এবং অনেক দোকানপাট রয়েছে। দক্ষিণ পাড়ে আর দুটি বাড়ি ছিল। একটাতে ভাড়াটিয়ারা থাকতেন আর অন্যটিতে থাকতেন একজন মুহুরি। পূর্ব পাড়ে আমাদের প্রতিবেশী ছিলেন কবিরাজ রসময় ভট্টাচার্য। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ভাড়াটিয়া, আইনজীবী যতীন্দ্র মোহন ভট্টাচার্যের বাড়ি তার পাশে আরও ২/১টি বাড়ি আর একটি মোক্তার বাবুর বাড়ি, তারপরেই রাস্তাটি নাইওরপুলের দিকে চলে যায়। পূর্ব পাড়ের উত্তর কোণে ধোপাপাড়া ছাড়াও আরো কয়েকটি উল্লেখযোগ্য পরিবার ছিল। রাস্তার মোড়ে ছিল আইনজীবী ধীরেন্দ্র রাহা এবং তার ভাই চিকিৎসক রাহার বাড়ি। তারপরে আর একজন কে থাকতেন আমার মনে নেই; কিন্তু তারপরেই থাকতেন খান বাহাদুর মফিজুর রহমান, জেনারেল ওসমানী সাহেবের পিতা। ওসমানী সাহেবরা দুই ভাই ছিলেন। ওসমানী সাহেব মাঝে-মধ্যে ছুটিতে বাড়ি আসতেন। তার অন্য ভাই নুরুল গণি আসাম প্রশাসনিক সার্ভিসে ছিলেন এবং তিনি পূর্ববাংলায় জেলা প্রশাসক এবং কেন্দ্রীয় সরকারের যুগ্ম-সচিব হিসেবে অবসরে যান। তার স্ত্রী ছিলেন হিন্দু। সেজন্য তার পিতার সঙ্গে তার বহুদিন মনোমালিন্য বহাল ছিল। অবশ্য আমরা তাকে সপরিবারে কিছুদিন খান বাহাদুর সাহেবের বাড়িতে থাকতে দেখেছি। এক সময় খান বাহাদুর সাহেবের খালি বাড়িতে তার স্ত্রীর বোনের মেয়ে তার ছেলেমেয়েদের নিয়ে বসবাস করতে আসেন। তার বড় ছেলে ছাড়া সকলেই ঐ বাড়িতে থাকতেন এবং তাদের সঙ্গে আমাদের ভাইবোনদের বিশেষ খাতির ছিল। এই বাড়িটিই বর্তমানে ওসমানী জাদুঘরে পরিণত হয়েছে। এই বাড়ি পেরিয়ে গেলে পশ্চিম দিকে তিনটি সুন্দর বাড়ি ছিল রাস্তার একদিকে, আর অন্যদিকে বেশ কয়েকটি বাড়ি ছিল। দু’টি বাড়ির নাম ছিল খুবই আকর্ষণীয়। যথা ‘পদ্মলোচন স্মৃতি ভবন’ এবং ‘সত্যভামা স্মৃতি সদন’। এই দু’টি বাড়িতেই অনেক ভাড়াটিয়া বসবাস করতেন। রাস্তার অন্যপাশে ছিলেন সিলেটের অনেক স্থায়ী বাসিন্দা। যাদের মধ্যে নাম করতে হয় আইনজীবী সয়ফুল আলম খান, আইনজীবী আবদুস সোবহান চৌধুরী, সিলেটের অন্যতম ধনী ব্যক্তি কুদরতুল্লাহ (যিনি অপুত্রক ছিলেন এবং যার নামে জেলা আদালতের কাছেই কুদরতুল্লাহ মসজিদ অবস্থিত)। তার ভাগ্নে কনাই মিয়া কুদরতুল্লাহ সাহেবের জমিজমার পরিচর্যা করতেন এবং ওনার অনেক ভাড়াটিয়া, দোকানদার এবং অন্যান্য ব্যক্তির দেখাশোনা করতেন। কনাই মিয়ার বাড়ির পাশেই ছিলেন তার ভাড়াটিয়া শিক্ষা বিভাগের একজন পরিদর্শক খান সাহেব আবদুল ওয়াহেদ। খান সাহেবের পরিবারের সঙ্গে আমাদের ভাল যোগাযোগ ছিল এবং সেই যোগাযোগ তার উত্তরাধিকারীদের সঙ্গেও বলতে গেলে এখনও বহাল আছে। ধোপাদীঘির পশ্চিম পাড়ে ছিল জেলের সীমানা এবং সেই জেলটি প্রায় ৫০ বিঘা জমির ওপর এখনও বিদ্যমান। তবে কিছু জমি পৌর বাজারের দখলে চলে গেছে। এটি আগামী বছরের শেষে মহানগরের বাইরে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে বাদাঘাটে স্থানান্তরিত হচ্ছে। জেলখানার এই উন্মুক্ত জায়গা আগামীতে ধোপাদীঘিসহ একটি সুদৃশ্য পার্কে পরিণত করার জন্য নীলনকশা প্রণীত হয়েছে। এটিই হবে সিলেটের একটি উন্মুক্ত পার্ক, অর্থাৎ মহানগরের ফুসফুস। আমার শৈশবের স্মৃতি খুবই আবছা, সম্ভবত সেই শৈশবকাল শেষ হয়ে যায় আমার ৭ বছর বয়সে। ততদিনে আমাদের পরিবারে আমার ২টি বোন ও একটি ভাই জন্ম নিয়েছে। অর্থাৎ আমরা ৬ ভাই বোন হয়ে গেছি। শৈশবে আমার মনে হয় আমরা বড় ৩ ভাইবোন মাঝে মাঝে বাড়ির পেছনে খুব সাবধানে দলবেঁধে যেতাম বিভিন্ন ধরনের ফল আহরণের জন্য। সাপের ভয় ছিল, তাই খুব সাবধানে যেতে হতো। আমরা প্রায়ই দাদাবাড়িতে গিয়ে সেখানকার বৃহত্তর এলাকায় অনেক ঘোরাফেরা করতাম। সেখানে বাড়ির সামনে চাচারা ব্যাডমিন্টন খেলতেন, সেটাও অবলোকন করে আনন্দ পেতাম। ১৯৩৭ সালে প্রাদেশিক সরকার গঠনের উদ্দেশ্যে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তার কোন স্মৃতি আমার নেই। কিন্তু শুনেছি যে, মুসলিম লীগের পতাকা নিয়ে আমরা চার ভাইবোন আমাদের প্রার্থীর জন্য প্রচার করতাম। আমাদের প্রার্থী ছিলেন আমার আব্বার মামা আবদুল হামিদ, যিনি তখন ছিলেন আসাম প্রদেশের শিক্ষামন্ত্রী। ১৯৩৭ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগ সারা আসামে মোট ৪টি আসন পায়। তবে স্যার মোহাম্মদ সাদুল্লাহ যিনি একজন এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলর ছিলেন, তিনি পাহাড়ী এবং হিন্দুদের নিয়ে একটি দল প্রতিষ্ঠা করে মন্ত্রিসভা গঠন করলেন। তার মন্ত্রিসভা এক বছরের মধ্যে বেশ বিপদে পড়ে গেল। তখন তিনি মুসলিম লীগের সদস্যদের দলভুক্ত করলেন এবং কোনমতে তার নেতৃত্ব বজায় রাখলেন। কিন্তু তা বেশিদিন চললো না এবং তাকে ক্ষমতা ছাড়তে হলো। কংগ্রেস শাসনামলে হিন্দু-মুসলিম বিরোধ মাথাচাড়া দেয় এবং ১৯৩৮ সালের অক্টোবর মাসে সিলেটে একটি ছোটখাটো দাঙ্গা হয়। এই দাঙ্গার কিছু স্মৃতি আমার আছে। আমরা যদিও এই পাড়ায় ছিলাম একমাত্র মুসলিম পরিবার; কিন্তু আমাদের হিন্দু প্রতিবেশী বেশির ভাগ ব্যবহারজীবী ভদ্রলোকেরা এই দাঙ্গায় খুব ভয় পেয়ে যান এবং আব্বার কাছে আসেন তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য। আমাদের বাড়িতে তখন দু’জন পুরুষ কাজের লোক ছিল- বটু এবং ইন্তাজ। তারা দু’জন হাতে লোহার শিক দু’টি নিয়ে পাড়া পরিভ্রমণ করতো। আমরা দুই ভাইও তখন মাঝে মাঝে হাতে একটা শিক নিয়ে সঙ্গী হতাম। তখন শহরে খালগুলো বড় ছিল এবং প্রায় প্রত্যেকটি বাড়ির সামনে উন্মুক্ত খাল ছিল। চলবে...
×