ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

স্বদেশ রায়

গার্ডিয়ানের রিপোর্ট ও বাংলাদেশে ডানপন্থী ষড়যন্ত্রের ছবি

প্রকাশিত: ০৩:৪৮, ১ অক্টোবর ২০১৫

গার্ডিয়ানের রিপোর্ট ও বাংলাদেশে ডানপন্থী ষড়যন্ত্রের ছবি

লন্ডনের দ্য গার্ডিয়ান, দ্য গার্ডিয়ানই। এর থেকে বেশি এ পত্রিকা নিয়ে বলার কিছু নেই। সেন্টার লেফট এই পত্রিকাটি গত কয়েক দিনে বাংলাদেশ নিয়ে দুটো বড় রিপোর্ট করেছে। এর ভিতর তাদের ২১ সেপ্টেম্বরের রিপোর্টটি এক্সক্লুসিভ। ‘বাংলাদেশ’স পি.এম রিজেক্ট ক্লেমস অফ রেপারেশান : আই ডু পলিটিক্স ফর দ্য পিপল’ শিরোনামের এই রিপোর্টটির শুরুর অংশ শেখ হাসিনার সাক্ষাতকার ও তাঁর সাফল্য নিয়ে। এই অংশটুকু বাংলাদেশের পত্র-পত্রিকায় প্রায় সকলে পড়েছেন। ইন্টারনেটের কল্যাণে সব পত্র-পত্রিকা এখন প্রত্যেকের মোবাইলে মোবাইলে। তাই গার্ডিয়ানের পুরো রিপোর্টটি দেশের অনেকেই পড়েছেন। যারা মনোযোগের সঙ্গে পড়েছেন তারা নিশ্চয়ই এই রিপোর্টটির শেষাংশে এসে বাংলাদেশের আরেকটি চিত্র পেয়েছেন। শুরুতেই উল্লেখ করেছি, গার্ডিয়ান গার্ডিয়ানই। তাই তারা শেষ অংশে বাংলাদেশে অন্ধকারের ভিতর যে ঘটনা ঘটার চেষ্টা চলছে তার ছবি তুলে এনেছে অত্যন্ত মুন্সিয়ানার সঙ্গে। দু’জন রিপোর্টার নিপুণ পেইন্টারের মতো একের পর এক রেখা টেনে গেছেন। যে রেখাগুলো হঠাৎ করে কতকগুলো রেখা মনে হয়। কিন্তু সবগুলো রেখাকে নিজের চোখের ফ্রেমের ভিতর নিয়ে এলে একটি ভয়ঙ্কর কালো মুখের ছবি পাওয়া যায়। যেমন এর শুরুটা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের(!) অধ্যাপক আতাউর রহমানের একটা বাক্য থেকে, যার অর্থ, ‘...আমাদের গণতন্ত্র এখন ধ্বংসের খাদের কিনারে।’ বলা যেতে পারে আতাউর রহমানের এই একটি বাক্য দিয়ে ওই ছবিটির আউট লাইন আঁকা হয়েছে। এর পরে ছবির সামগ্রিক বডি প্রকাশ করেছেন গার্ডিয়ানের ওই দুজন রিপোর্টার, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন সাবেক জেনারেলকে উল্লেখ করে। জেনারেল তাঁর নাম প্রকাশ না করার কারণ হিসেবে বলেছেন, বাংলাদেশে এখন মাঝরাতে মানুষ হারিয়ে যায়। তিনি ওইভাবে হারিয়ে যেতে চান না। অর্থাৎ তাঁর নাম প্রকাশ হলে তিনি হারিয়ে যাবেন। যা হোক, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই জেনারেলের বক্তব্য বিস্তারিত প্রকাশ করেছে আতাউর রহমান যে খাদকে উল্লেখ করেছেন ওই খাদটি কী? অর্থাৎ গণতন্ত্র ধ্বংস হয়ে বাংলাদেশ কোন্ খাদে পড়তে যাচ্ছে? সাবেক ওই জেনারেল বলেছেন, ‘২০১৪-এর পর থেকে শেখ হাসিনার আর দেশ শাসনের কোন অধিকার নেই। শেখ হাসিনা বাস্তবে টিকে আছেন র‌্যাব, পুলিশ, বর্ডার গার্ড, সিভিল ব্যুরোক্র্যাট ও বিশেষ কায়দায় সেনাবাহিনীর ওপর নির্ভর করে।’ সেনাবাহিনীর ওপর কোন্ কোন্ পথে নির্ভর করে শেখ হাসিনা টিকে আছেন তার ব্যাখ্যা করেছেন ওই নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জেনারেল এভাবে যে, ‘সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থরা তাঁকে (শেখ হাসিনা) সমর্থন করে। উচ্চপদস্থ সকলে তাঁর হাতে নিয়োগ পেয়েছেন। সামরিক বাহিনীতে বেতন বাড়িয়ে, বাজেট বাড়িয়ে তাদের কিনে ফেলা হয়েছে। বড় বড় ব্যবসা দেয়া হচ্ছে তাদের যেমন ব্যাংক, হোটেল, রিয়েল এস্টেট, শিল্প এমনকি ট্যাক্সি ক্যাব। পিস কিপিংও তাদের জন্য অত্যন্ত লাভজনক। এছাড়া নতুন সমরাস্ত্র কিনেও শেখ হাসিনা তাদের খুশি করছেন।’ এরপরে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই সাবেক জেনারেল বাংলাদেশ কোন্ খাদে পড়তে যাচ্ছে তা একটু আবরণে রেখে উল্লেখ করেছেন। জেনারেল বলেছেন, ‘সাময়িক বা কিছু সময়ের জন্য সামরিক অভ্যুত্থানের ভয় থেকে এখন আওয়ামী লীগ মুক্ত ঠিকই; কিন্তু কেউই বলতে পারে না সামরিক বাহিনীর মিডিল ও লোয়ার র‌্যাঙ্কের ডানপন্থীরা ভবিষ্যতে কিভাবে রিএ্যাক্ট করবে।’ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই জেনারেলের বক্তব্যের ভিতর দিয়ে কিন্তু বাংলাদেশের কালো মুখ বা ষড়যন্ত্র বা যে খাদে বাংলাদেশ পড়তে যাচ্ছে যাই বলা হোক না কেন, গার্ডিয়ান সে ছবির প্রায় সবটুকু প্রকাশ করেছে। তারপরেও কিন্তু এখানেই এই রিপোর্টটি পরিপূর্ণ হয় না। কারণ আতাউর রহমান বিএনপিপন্থী এবং অতীতের সামরিক সরকারের পৃষ্ঠপোষক। অন্যদিকে আরেকজন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক। তাই তাদের রিপোর্টের পরিপূর্ণতা এবং ঘটনার বিশ্বাসযোগ্যতার জন্য যারা বাংলাদেশে তথাকথিত সিভিল সোসাইটির অংশ হিসেবে নাম ধরে আছে তারাও যে এই কালো মুখের সঙ্গে জড়িত, তারা যে বর্তমান গণতান্ত্রিক ধারায় আস্থাবান নন তার প্রকাশ ঘটেছে রিপোর্টের পরের দুইজনের মন্তব্যে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই জেনারেলের পরে ওই রিপোর্টে বক্তব্য উদ্ধৃতি করা হয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের ডিরেক্টর ইফতেখারুজ্জামানের। তিনি বলেন, বাংলাদেশে একটি ফুটন্ত পানির অবস্থা শীঘ্রই আসতে যাচ্ছে। কেউ বলতে পারে না কখন পানিটি ফুটবে, তবে তা ঘটবে। এরপরে ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনামের দীর্ঘ মন্তব্য উদ্ধৃত হয়েছে ওই রিপোর্টে। মাহফুজ আনাম সেখানে মিডিয়ার স্বাধীনতা না থাকার কথা বলেছেন, শেখ হাসিনার সাকসেসের কথা বলেছেন। তবে শিক্ষিত ও মার্জিত এ ব্যক্তি অন্যদের থেকে আরও চতুরভাবে উপরোক্ত বক্তব্যের, কালো মুখের বা খাদের সমর্থনের একটি বাক্য বা রেখা উল্লেখ করেছেন। যা দৃশ্যত খুবই পজিটিভ মনে হয় এবং এ মুন্সিয়ানা মাহফুজ আনামের আছে। তিনি শেখ হাসিনার সাফল্যের সারি উল্লেখ করতে গিয়ে বলেছেন, ‘সেনাবাহিনী তাঁর হাতের মুঠোয়।’ দৃশ্যত খুবই সাধারণ একটি বাক্য। কিন্তু আমেরিকার কোন সম্পাদক কি ওবামার সাফল্যের কথা বলতে গিয়ে বলবেন, আমেরিকার সেনাবাহিনী ওবামার হাতের মুঠোয়, এমনকি মোদির সাফল্যের কথা বলতে গিয়ে বলবেন? বলবেন না। বরং পার্লামেন্টারি ডেমোক্রেসিতে ডিফেন্স মিনিস্টারের অধীনে নিয়মতান্ত্রিক সেনাবাহিনী থাকবে এটাই স্বাভাবিক। শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ডিফেন্স তাঁর হাতে রেখেছেন। তাই এ তো বাস্তবে সূর্য পূর্বদিকে ওঠার মতোই সত্য। তারপরেও কেন এই বাক্যটি? এখানে কি চাওয়া হচ্ছে শেখ হাসিনার হাতের মুঠো থেকে বেরিয়ে যাক! অন্য কিছু করুক! ‘সেনাবাহিনী শেখ হাসিনার হাতের মুঠোয়’ বলে কিন্তু খুব সুচতুর ও মার্জিতভাবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই জেনারেলের বক্তব্যকেই সমর্থন করা হয় না কি? তাই স্বাভাবিকই গার্ডিয়ানের এই রিপোর্টের ভিতর দিয়ে এ সত্য বেরিয়ে আসে যে, বাংলাদেশের ভিতর একটি অংশ কাজ করছে বা বসে আছে একটি ডানপন্থী প্রতিক্রিয়া আশা করে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের ইফতেখার কিন্তু বলতে চাচ্ছেন খুব শীঘ্রই বাংলাদেশ তপ্ত কড়াইয়ে পড়বে। গার্ডিয়ানের এই রিপোর্টের বাইরেও একটি অংশের কর্মকা-ও কিন্তু প্রমাণ করছে যে, তারা শেখ হাসিনার এই অর্থনৈতিক সাফল্য ও গণতান্ত্রিক ধারা বিনষ্ট করতে এ কাজ করছে। যেমন, ড. ইউনূস যে কোন মূল্যে শেখ হাসিনার শাসনের অবসান চান। হিলারির ডি ক্লাসিফাইড ই-মেইলের যে অংশে ইউনূস আছে সেখানে বোঝা যায় ইউনূসের আকুতি। তাছাড়া পদ্মা সেতু প্রকল্প থেকে শুরু করে তিনি এ অবধি বাংলাদেশ ও শেখ হাসিনাবিরোধী যত ক্যাম্পেন করেছেন তাও কিন্তু খুব সুখকর নয়। সর্বশেষ নিউইয়র্কে শেখ হাসিনাবিরোধী জামায়াত ও যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষের বিক্ষোভকারীদের কাছ থেকে ফুল নিয়ে, হাসি মুখে তাদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে ড. ইউনূস যে বার্তা দিলেন এর পরে আর কারও কোন সন্দেহ থাকার কথা নয় এবং তাঁর অবস্থান যে ডানপন্থীদের সঙ্গে এটাও প্রমাণিত। পাশাপাশি, এই ডানপন্থীদের সমর্থনে ইতোমধ্যে একজন শিখ-ী তৈরি করা হয়েছে। যাকে কেউ মুসলিম ডানপন্থী মৌলবাদী হিসেবে চিহ্নিত করতে পারবে না। তার আচরণও দেশবাসী দেখছে। তিনি তার পদ ও চেয়ারকে তোয়াক্কা না করে বিভিন্ন স্থানে রাজনৈতিক নেতার মতো বক্তব্য দিয়ে বেড়াচ্ছেন। বিভিন্ন স্থানে অযাচিতভাবে দাঁড়াচ্ছেন। যা অতীতে কখনও ঘটেনি। তবে অতীতেও বাংলাদেশ ডানপন্থী প্রতিক্রিয়ার সঙ্গে এই অবস্থানের ব্যক্তির যোগ বাংলাদেশ দেখেছে। অন্যদিকে সম্প্রতি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের আন্দোলনে হিযবুত অংশে দেখা গেছে তারা সামনে একজন মাইনরিটিকে রেখেছিলো। বাস্তবে এটাও খুব অসম্ভব কোন বিষয় নয়। অর্থের একটা শক্তি আছে। তাছাড়া রবীন্দ্রনাথের ওই কথা, ‘কানে কানে কহে দুই পাখি রাজা হবে, রাজা হবে।’ পাশাপাশি বাংলাদেশে ডানপন্থীদের মূল জীয়নকাঠি আইএসআই। বাংলাদেশে এই আইএসআইয়ের পালের গোদা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী। তার পরিবারের কিছুকাল যাবত যে তৎপরতা ও তার প্রতি আওয়ামী লীগের কারও কারও যে সমর্থন দেখা গেল- এসব কোন কিছুই হিসাবের বাইরে নেয়ার কোন সুযোগ নেই। পাশাপাশি অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট দলের হঠাৎ বাংলাদেশ সফরে আপত্তি। বাংলাদেশে ইতালীয় নাগরিক খুন। প্রতিবেশী ভারতে দুটি শহরে পরদিনই হাই এলার্ট। ভারতের সেভেন সিস্টারের জঙ্গী বিশেষ করে উলফার কিছু তৎপরতা বাংলাদেশে দৃশ্যমান না হলেও চোখের বাইরে নয়। আইনের কোন কোন হাত সেখানে থেমে না গেলেও সন্দেহমুক্ত নয়। বাংলাদেশ সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রসহ বেশ কয়েকটি দেশের সতর্ক অবস্থান। এগুলোকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে দেখাও কি ঠিক হবে? তবে শেখ হাসিনা ৬৮ পার করে ৬৯-এ পা দিয়েছেন। শুধু চড়াই-উতরাইয়ের রাজনৈতিক জীবনই তাঁর ৩৬ বছরের। তাই আরও চড়াই-উতরাই তিনি পার হতে পারবেন। এ আশা করা ভুল হবে না এবং এসব তাঁর যে অজানা তাও মনে হয় না। কারণ তাঁর দলের জেনারেল সেক্রেটারি নির্লোভ ও মিতভাষী নেতা সৈয়দ আশরাফ মাস দুয়েক আগেই এই কালোমুখ, ষড়যন্ত্র বা খাদ যে নামেই বলি না কেন এর ইঙ্গিত দিয়েছেন জনগণকে সতর্ক হওয়ার জন্যে। তবে শুধু ষড়যন্ত্র জানতে পারা ও সতর্ক থাকতে বলা কখনই কিন্তু এসব ষড়যন্ত্র রুখতে কার্যকর হয় না বরং চিহ্নিতকে উপড়ে ফেলাই উচিত। এদের রেখে যতই লোহার বাসর তৈরি করা হোক না কালনাগিনীর পথ ঠিকই থেকে যায়। আর ডানপন্থী এই প্রতিক্রিয়াকে শুধু ডানপন্থী কোন অভ্যুত্থান ভাবলেও কিন্তু ভুল হবে। [email protected]
×