ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

স্বদেশ রায়

রেভ্যুলেশান স্কোয়ার ও সেকেন্ড কামিং

প্রকাশিত: ০৫:১০, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৫

রেভ্যুলেশান স্কোয়ার ও সেকেন্ড কামিং

রবিবার দুপুরে সিএনএনের খবরের প্রধান শিরোনাম ছিল কিউবার হাভানার রেভ্যুলেশান স্কোয়ারে পোপের জনসভা। লাখ লাখ উচ্ছ্বসিত মানুষ ওই জনসভায়। পোপ বক্তব্য রাখছেন। সিএনএনের হাভানা সংবাদদাতার মুখে শোনা যেতে থাকে সেই জনসভার নানান বর্ণনা। চোখের সামনে টেলিভিশন, কানে হেডফোনের স্পীকার, হাতে অন্য কাজ করছিলাম। কিন্তু কেন যেন হেডফোনের স্পীকার থেকে কোন কথা আর শুনতে পাইনি, হাত দুটো থেমে যায়। চোখের সামনে কল্পনায় ভেসে ওঠে আরেকটি ছবি, মনও চলে যায় সেখানে। মনের ভেতর ছবিগুলো আরও বড় হয়ে ওঠে। মনে হয়, এই সেই রেভ্যুলেশান স্কোয়ার। এখানে বিপ্লব শেষে ফিরে এসে ভাষণ দিয়েছিলেন ফিদেল কাস্ট্রো। চে গুয়েভারাসহ তার অন্য সঙ্গীরা পাশে ছিল। তাদের কাঁধে ছিল বিজয়ী অস্ত্র, যাকে ওই মুহূর্তে মানুষ মনে করেছিল, অপূর্ব সুরলীলার বাদ্যযন্ত্র। যে যন্ত্রের সুর বয়ে যাবে ভবিষ্যতের সুন্দরতম পৃথিবীর নতুন সুর হয়ে। তারপরের ইতিহাস, গত অর্ধ শতকের বেশি সময়ের ইতিহাস। চে গুয়েভারা এখন কিছু তরুণ-তরুণীর টি-শার্টে, ফিদেলের রচনা এখন অনেক সেলফে ধুলো-বালিতে পড়ে আছে। কেউ কেউ এখনও যতেœ উলটায় মাঝে মাঝে। আর বর্তমানের সত্য হলো হাভানার রেভ্যুলেশান স্কোয়ারে পোপ ভাষণ দিচ্ছেন। ইহকাল পরকাল নিয়ে হয়ত অনেক কথাই বলেছিলেন তিনি দুর্ভাগ্য না অন্য কিছু জানি না, হেডফোনের স্পীকার পৌঁছে দেয়নি সে কথা কানে। কেবলই কল্পনায় ভেসেছিল মনে একটি ছবি, ফিদেল আর চে’র বিজয়ী অস্ত্রে বাজছে পৃথিবীর পথে পথে নতুন সুর। আহা! কী সুরেলা সে ধ্বনি! ফিদেলের মতো এমনি চেহারা নিয়ে বিজয়ী অস্ত্র হাতে এই ঢাকা শহরে ঢুকেছিলেন কাদের সিদ্দিকী। এই বাংলার টাইগার সিদ্দিকী হিসেবে। পৃথিবীর অনেক মিডিয়ায় তার চেহারায় মিল খুঁজে পেয়েছিল ফিদেলের। হঠাৎ মনে হলো, সেখানেও কী বিশাল পরিবর্তন। তিনিও তো বদলে গেছেন রেভ্যুলেশান স্কোয়ারের মতো। এখন অদ্ভুত সাজে গলায় গামছা টাঙিয়ে বেড়ান যেন কত অপরাধ করেছেন তিনি- তাই গামছা গলায় দুয়ারে দুয়ারে মাঙিছে মাফ। শুধু কি এক টাইগার সিদ্দিকী! আশির দশকেও সাংবাদিক হিসেবে দেখেছি, বায়তুল মোকারমের দক্ষিণ গেট, মুক্তাঙ্গনের সামনে, পল্টনের আউটার স্টেডিয়ামে- সিপিবি, মোজাফফর ন্যাপ, জাসদ, বাসদ, সাম্যবাদী দল (তোয়াহা), ন্যাপ (মুজাফফর)সহ এমনি সব প্রগতিশীল দলের কত বড় বড় জনসভা। ছাত্র ইউনিয়নের দীর্ঘ মিছিল। নব্বইয়ের পর থেকে ধীরে ধীরে বদলে গেল সে সব। এখন সিপিবি, জাসদ, বাসদ, ছাত্র ইউনিয়ন সবই কোনমতে বনসাই হয়ে টিকে আছে। তাদের জনসভায় এখন আর মানুষ হয়ে ওঠে না বড় বৃক্ষসম। এখনও ওইসব স্থানে জনসভা হয়, মিছিলও নামে মাঝে মাঝে। তবে সে সব জনসভার বক্তা ভিন্ন, তাদের দলের নামও ভিন্ন। এখন মুক্তাঙ্গনে-পল্টনে জনসভা হয়, চরমোনাইয়ের পীরের ইসলামিক শাসনতান্ত্রিক আন্দোলন, একাত্তরের রাজাকার শর্ষিনার পীরের অমনি কী একটা সংগঠন, আরেক রাজাকার (কিছুদিন হলো মারা গেছে) মুফতি আমিনীর ইসলামী ঐক্যজোট। তারা সেখানে সেøাগান দেয়, বাংলা হবে আফগান- আমরা হবো তালেবান। এখন আর বুড়িগঙ্গার কল্লোল সাথে নতুন দিনের নহবত মিলায় না তান। এখন আর পল্টনে কোন জনসভায় কেউ গায় না দারিদ্র্যের শিকল ভাঙ্গার গান, কেউ আর গায় না কালো মানুষের সঙ্গে সংহতির সেই তীব্র আকুতি জড়ানো গান। অন্যদিকে শুধু উপমহাদেশে নয়, এশিয়ার গণতন্ত্রের উজ্জ্বল উদাহরণ ছিল ভারত। কত বর্ণ, কত ধর্ম, কত গোত্র এক গাছের ফুল হিসেবে সেখানে ফোটাতে চেয়েছিলেন মতিলাল নেহরু, চিত্তরঞ্জন দাশ, সুভাষ বোস , মৌলানা আজাদ, দাদাভাই নওরোজী, বাদশা খান প্রমুখ। তাদের অনেকের অবর্তমানে খ-িত ভারতে জওয়াহেরলাল নেহরুর হাত ধরে সেখানে তবুও শক্ত পায়ে দাঁড়ানোর ভিত্তি পেয়েছিল গণতন্ত্র। আজ সেখানে গণতন্ত্রের থেকে বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে ব্যক্তির খাদ্যাভ্যাসের ওপর রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ। কে গরু খাবে কি খাবে না, কী জবাই করবে কী করবে না- এটাই যেন রাষ্ট্রের সব থেকে বড় দায়িত্ব। গণতন্ত্র এখন মানুষ ছেড়ে গরু নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। তাদের এই গো-হত্যা নিয়ে এই মহারণ দেখে মনে করিয়ে দেয় স্বামী বিবেকানন্দের একটি ঘটনা। তাঁর কাছে গিয়ে কোন একটি সমিতির একদল লোক বলেছিলেন, স্বামীজি আপনি গো-হত্যা বন্ধের জন্যে কিছু করেন। কারণ, গরু আমাদের মাতা। স্বামীজি তাঁর স্বভাব সুলভ উইট থেকে বলেছিলেন, ‘তাই তো সন্তানদের এই দশা!’ কিন্তু এর পরেও তো শতবর্ষ পেরিয়ে গেল। গণতন্ত্রের পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে গেল ভারতে। এখনও সন্তানদের মনুষ্যমাতা হয়নি! বাস্তবে পৃথিবীতে কোথায় আছি এখন আমরা- আমেরিকা এখন এ্যাবরশনে ঈশ্বরপুত্র হত্যা দেখছে, ক্যামেরন চার্চ শিক্ষা নিয়ে ব্যস্ত। রেভ্যুলেশান স্কোয়ারে পোপের লাখো মানুষের জনসভা। ভারতবর্ষ মানুষের বদলে গরু নিয়ে ব্যস্ত। গরু মানুষের মাতা। শ্রীলংকা, মিয়ানমারে শান্তির বুদ্ধের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে রক্তাক্ত তরবারি। সেখানে বুদ্ধের শান্তির বাণীর বদলে বুদ্ধের বাণী যাদের কণ্ঠে তাদের হাতে মারা যাচ্ছে অন্য বর্ণ আর ধর্মাবলম্বীরা। আর বাংলাদেশেও ক্যামেরনের চার্চ শিক্ষার মতো মাদ্রাসা শিক্ষায় ব্যস্ত। অন্যদিকে বাংলাদেশের রেভ্যুলেশানের ঐতিহাসিক স্থানগুলোতে এখন ইসলামিক শাসনতন্ত্র আন্দোলন, চরমোনাইয়ের পীর, শর্ষিনার পীর এদের দাপট। শুধু তাই নয়, সরকারের, সাংবিধানিক পদে এমনকি সমাজে সবখানে বিপ্লবের নায়করা ও বিপ্লবের পক্ষের সুর যাদের গলায় বাজে তারা পিছে পড়ে গেছে। তারা অপমানিত। কবি শামসুর রাহমান খুব নির্বিবাদী মানুষ ছিলেন। তার প্রতিবাদের ভাষাও ছিল তেমনি শান্ত-কোমল। তাই হয়ত বলতে পেরেছিলেন, হে পরোয়ারদেগার, আমাকে একজন খাস রাজাকার করে দাও। কারণ, যারা রাজাকার ছিল তারা ভাল আছে। যারা রাজাকারকে মেনে নিতে পারছে তারাও ভাল আছে। যারা রাজাকারকে ঘৃণা করে, বিপ্লবকে বুকে নিয়ে, আধুনিকতাকে জীবন বোধ মনে করে মাথা উঁচু করে বাঁচতে চায় তাদের এখনও দুঃসময়। তাদের করা হচ্ছে বনসাই। যাতে একদিন তারা শুধু টবেই থাকবে। এর পরে কী থাকে আর! এখন কি কেবল কবি ইয়েটসের মতো সেকেন্ড কামিং-এ আশা করে বসে থাকা ছাড়া আর কিছু সামনে আছে? ইয়েটস দেখতে পেয়েছিলেন সব কিছু ভেঙ্গে পড়ছে, কোন কেন্দ্র নেই। তিনি বিশ্বাস করেছিলেন, দু’হাজার বছর পর পর সভ্যতার যে পরিবর্তন হয় সে পরিবর্তন আসন্ন। এই সব কিছু ভেঙ্গে পড়ার পর, নতুন বেথেলহেমে যে সন্তান জন্ম নেবে তার হাত ধরে আসবে পরিবর্তন। কবিরা সব সময়ই আশাবাদী। আর ইয়েটসের মতো কবির কণ্ঠে অবশ্যই ভবিষ্যতের ধ্বনি থাকবে। বাস্তবে তাই মনে হয় এখন বুঝি পৃথিবীকে ভাবতে হবে, এ মুহূর্তে পৃথিবীতে যা চলছে এই নিয়ে বসে থাকব, এটাকে মেনে নেব- না ইয়েটসের মতো সেকেন্ড কামিং-এর কথা ভাবব। বাস্তবে এ মুহূর্তে যা চলছে তা পৃথিবীর সভ্যতার সত্য হয়ত হতে পারে না। সত্য হতে পারে না মানুষের প্রগতির ইতিহাসের। তাই সেকেন্ড কামিং-এর কথা ভাবতেই হবে। আর মনে রাখা দরকার- পৃথিবীর সভ্যতার কোন কিছুই কিন্তু আকাশের আপেল হয়ে মানুষের মুখে নামে না। মানুষকে আপেল চাষ করে, তাতে ফল ধরিয়ে সে ফল পেড়ে তবেই মুখে নিতে হয়। তাই সেকেন্ড কামিং বা সভ্যতার যে নতুন সময়টি আসবে- এই সব কিছু ভেঙ্গে পড়ার সময়কে উত্তীর্ণ করে তার জন্যে মানুষকে গাছের চারা রোপণ করতে হবে। সভ্যতার জন্যে গাছের চারা রোপণ করলে- সভ্যতার ইতিহাস বলে মানুষের আত্মদানের রক্তে সে চারা বড় করে তুলতে হয়। পৃথিবীতে এখন বুঝি সেই সময় বয়ে যায়, কাউকে না কাউকে এখন ওই চারাটি রোপণ করতে হবে। আর পৃথিবীর ইতিহাসের সত্য হলো, তরুণের আত্মদানের রক্তে সভ্যতার চারা বড় হয় পরবর্তী প্রজন্মের জন্যে। তাই উত্তপ্ত মাটিতে হাত দিয়ে কাউকে না কাউকে হাত পুড়িয়ে এখন বুনতে হবে নতুন পৃথিবীর বা নতুন সভ্যতার বীজটি আর কোন একটি তরুণ প্রজন্মকে দিতে হবে রক্ত- যে রক্তমাখা পথ বেয়ে আসবে সভ্যতার সুন্দরতম দিনটি। আবার কোন রেভ্যুলেশান স্কোয়ারে বাজবে আরেক ধরনের নতুন সুর, যেখানে আবার বলা হবে- মানুষের চেয়ে বড় কিছু নেই। মানুষই মানুষের মূল কেন্দ্র। [email protected]
×