ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

সরকার ও প্রধানমন্ত্রীকে আলাদা করে দেখা কেন?

প্রকাশিত: ০৫:৪২, ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৫

সরকার ও প্রধানমন্ত্রীকে আলাদা করে দেখা কেন?

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক একটি সংস্থার জরিপে বাংলাদেশ সরকারের চেয়ে প্রধানমন্ত্রী ব্যক্তিগতভাবে অনেক বেশি জনপ্রিয়, সে কথা উঠে এসেছে। বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতায় এ বিষয়টি নিশ্চিত ব্যাখ্যার দাবি রাখে। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠতে পারে যে, কেন সরকারের চেয়ে প্রধানমন্ত্রী বেশি জনপ্রিয় হবেন? কিংবা প্রধানমন্ত্রী আর সরকার কি আলাদা কোন কিছু? সংসদীয় গণতন্ত্রে সরকারপ্রধান হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর জনপ্রিয়তার সঙ্গে সরকারের জনপ্রিয়তা অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। সেদিক বিচারে কেন এ রকম অবোধ্য শিরোনাম প্রচারিত হলো, যেখানে সরকারের বিপরীতে প্রধানমন্ত্রীকে দাঁড় করিয়ে দেয়া হলো? বেশিরভাগ গণমাধ্যমেই বিশেষ করে পত্রপত্রিকায় এভাবেই উল্লেখ করা হয়েছে বিষয়টি। অথচ খোদ জরিপকারী প্রতিষ্ঠান এ রকম কোন শিরোনাম তো দূরের কথা, তারা সরাসরি বলেছে যে, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমান সরকারের কর্মকা-ে দেশের গরিষ্ঠ সংখ্যক মানুষ অসুখী নয়, বরং তারা সরকারকে সর্বাত্মক সহযোগিতা দিতেও প্রস্তুত। তাহলে বিষয়টিকে কেন এ রকম ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে বলা হচ্ছে? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে আসুন আমরা বিবেচনা করি যে, সরকার আসলেই সঠিক কাজটি করছে কি-না? নিজের বিবেককে প্রশ্ন করি সবার আগে যে, সরকারের কোন্্ কর্মকা- দেশের উপকারে আসছে আর কোন্টি নয়? একজন সাধারণ মানুষের চোখে বাংলাদেশের চলমান অবস্থায় সবচাইতে ইতিবাচক দিক নিশ্চিতভাবেই তার জীবনমানের উন্নয়ন, আগুনে বোমা দিয়ে মানুষ হত্যার রাজনীতি থেকে মুক্ত থাকা এবং সর্বোপরি একটি শান্তিপূর্ণ অবস্থা বিরাজ করাকেই নির্দেশ করবে। কিন্তু মানুষ কি সব সময় সফলতাকে মনে রাখে? বিশেষ করে যখন সরকারের সামান্য ব্যর্থতারও ঢালাও প্রচারণা হয়, তখন মানুষের পক্ষে কোন সফলতাকেই মনে রাখা সম্ভব নয়। বরং, সরকারের সামান্য ব্যর্থতাও আগামীতে যে ভয়ঙ্কর প্রচারণার অংশ হবে এবং মানুষ তা বিশ্বাস করবে, সে বিষয়ে যারা সন্দেহ পোষণ করেন তাদের সম্পর্কে কিছু বলা থেকে বিরত থাকাই উত্তম। কিন্তু শেখ হাসিনার সরকারকে সফল বলার জন্য স্বাভাবিকভাবেই আমাদের পেছনের দিকে ফিরে যেতে হয়। তুলনা করতে হয় বিএনপি-জামায়াত জোটের শাসনকাল এবং তার পরবর্তীতে ১/১১-র শাসনকালের দিকে। এমনকি আমরা যদি শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এর আগের আমলকেও বর্তমানের সঙ্গে তুলনা করি তাহলেও অত্যুক্তি হবে না। কারণ, একটি সরকার দুই মেয়াদে ক্ষমতায় থাকলে তাদের উন্নয়ন কর্মকা- যদি দ্বিতীয় মেয়াদ প্রথম মেয়াদকে ছাড়িয়ে ওপরে উঠতে না পারে, তাহলে দ্বিতীয় মেয়াদ নিয়ে সন্দেহ তৈরি হয়, তৈরি হয় সংশয়। আর কে না জানে যে, সংশয় ও সন্দেহ থেকে অবিশ্বাসের জন্ম হয়। কিন্তু আমরা এ কথা নির্দ্বিধায় বলতে পারি যে, শেখ হাসিনার ২০০৮ ও ২০১৪ সালের সরকার যে কোন সূচকেই বিএনপি-জামায়াত জোট এবং ১/১১-র সরকারের চেয়ে অনেক বেশি মাত্রায় জনগণবান্ধব, উন্নয়নবান্ধব এবং স্বচ্ছ। দুর্নীতির সূচকের আন্তর্জাতিক রিপোর্টও প্রমাণ করে যে, শেখ হাসিনার দুই মেয়াদের সরকার সার্বিকভাবে সফল। হ্যাঁ, যে কেউই পদ্মা সেতুকে নিয়ে বিশ্বব্যাংকের তুঘলকি, শেয়ারবাজারের এবং হলমার্কের কেলেঙ্কারিকে সামনে নিয়ে আসতে পারেন। কিন্তু পদ্মা সেতুকে ঘিরে বিশ্বব্যাংকের দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে কানাডায় চলমান বিচার প্রক্রিয়ায় বিশ্বব্যাংকের এখন নাকানি-চুবানি খেতে হচ্ছে। কারণ তারা এখনও পর্যন্ত কোন প্রমাণ হাজির করতে পারছেন না। ইতোমধ্যে আদালত থেকে মামলাটি খারিজ করার কথাও শোনা যাচ্ছে। দেখা যাক, বিষয়টি কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়। আর দেশের ভেতর ঘটা আর্থিক কেলেঙ্কারি এখনও তদন্তাধীন। এর আগে বাংলাদেশে এ রকম কোন কেলেঙ্কারি ধরা তো দূরের কথা, বিচারের আওতায় আনার কথা কেউ ভাববার সাহসও পেয়েছেন কি-না জানা যায় না। কিন্তু তারপরও এই সব কেলেঙ্কারিকে সাধারণ মানুষ সরকারের ব্যর্থতা হিসেবেই দেখবে এবং এর দায় সরকারকে বহন করতেই হবে। তবে আশার কথা হলো, বিচার প্রক্রিয়ার দ্রুততা ও স্বচ্ছতা হয়ত এই ব্যর্থতা থেকে সরকারকে মুক্ত করতে সক্ষম হবে। কিন্তু আরেকটি প্রশ্ন এখানে থেকেই যায়। কোন দেশের উন্নয়ন কর্মকা-কে দ্রুততার সঙ্গে এগিয়ে নিতে হলে দেশের ভেতরকার রাজনৈতিক পরিস্থিতির স্থিতিশীলতা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় উপকরণ এবং যে কোন সরকারের জন্য এ রকম পরিস্থিতিই কাম্য। প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশে বিগত সাত বছরে কতদিন সে রকম শঙ্কামুক্ত পরিবেশ ছিল সরকারের পক্ষে নিরবচ্ছিন্ন কাজ করার? দেশের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতির সঙ্গে আন্তর্জাতিকভাবেও কি সরকারকে সুস্থির থাকার সুযোগ দেয়া হয়েছে? যুদ্ধাপরাধের বিচারকে কেন্দ্র করে যে অস্থিতিশীলতা প্রায় গৃহযুদ্ধের রূপ নিয়েছিল, সেই ভয়াল তা-বে কারও পক্ষে উন্নয়ন প্রক্রিয়া চালু রাখাটা কতটা দুঃসাধ্য হতে পারে, তা যে কোন ব্যক্তিই বুঝতে পারবেন। যারা বুঝতে চাইবেন না তারা নিঃসন্দেহে জ্ঞানপাপী। সুতরাং ২০০৮ সালে গঠিত সরকারের পক্ষে চাইলেও কাক্সিক্ষত ফলাফল অর্জন সম্ভব হয়নি, এ কথা আমাদের স্বীকার করতে হবে। অপরদিকে, ২০১৪ সালের পর সরকারকে আন্তর্জাতিকভাবে বিপদে ফেলার অনেক চক্রান্ত একে একে উন্মোচিত হচ্ছে। সর্বশেষ, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি ও যুক্তরাজ্যভিত্তিক একজন আইনজীবীর প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যে চুক্তিটি সম্প্রতি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে তাতে স্পষ্ট লেখা আছে যে, সরকারকে আন্তর্জাতিকভাবে হেনস্থা করার জন্যই যুক্তরাজ্যভিত্তিক প্রতিষ্ঠানটিকে বিএনপি নিয়োগ দিচ্ছে। এই প্রতিষ্ঠানটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শেখ হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধে লবিং করবে এবং বিএনপি নেতৃত্বকে আমেরিকান নেতৃবৃন্দের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের সুযোগ করে দেবে এবং এর মাধ্যমে বর্তমান সরকারকে বিপদে ফেলা সম্ভব হবে। আমরা ধরেই নিতে পারি যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের জন্য শুল্কমুক্ত সুবিধা না পাওয়ার পেছনে এই চুক্তি অনুযায়ী কাজ হয়েছে এবং বলাই বাহুল্য যে, যুক্তরাজ্যভিত্তিক এই প্রতিষ্ঠানটি এ ব্যাপারে সফল হয়েছে। এখন বলুন, সরকারের বিপক্ষে কাজ করতে গিয়ে যদি কোন রাজনৈতিক দল দেশবিরোধী কাজ করে, তাহলে সেই রাজনৈতিক দলের এ দেশে রাজনীতি করার কি কোন নৈতিক অধিকার থাকে? অন্য দেশে থাকে না এ কথা নিশ্চিত করেই বলা যায়। কিন্তু বাংলাদেশে থাকে এবং তাদের পেছনে দাঁড়ানোর মতো লোকেরও অভাব হবে না। আমরা এও ইতোমধ্যেই জেনেছি যে, বাংলাদেশের একমাত্র নোবেল বিজয়ী ব্যক্তিত্ব যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনকে শ’খানেক ইমেইল করে শেখ হাসিনার সরকারকে বিপদে ফেলার জন্য অনুরোধ জানিয়েছিলেন। এখানেও আমরা ধরে নিতে পারি যে, অন্তত অনেক ক্ষেত্রেই এই নোবেল বিজয়ী সফল হয়েছিলেন শেখ হাসিনার সরকারকে আন্তর্জাতিকভাবে হেনস্থা করতে। এসব বিষয়ে বিস্তারিত না বলে শুধু এটুকুই বলতে চাইছি যে, এই যখন আমাদের ‘দেশের শত্রু, দশের শত্রু’-দের কর্মকা- তখন কেবল সরকারকে দায়ী করলে চলবে? শুরুতেই যে প্রশ্ন তুলেছিলাম, সরকার ও প্রধানমন্ত্রীকে আলাদা করে জনপ্রিয়তার মাপকাঠিতে বিচারের যে প্রচলন গণমাধ্যমে শুরু হয়েছে, তাকেও আমরা আলাদা করতে পারি না এই সব দেশজ ও আন্তর্জাতিক চক্রান্তের বাইরে। বরং, এ কথা স্পষ্ট করেই বলতে হবে যে, আসছে দিনগুলোতে এই চক্রান্ত ও অনৈতিক কর্মকা-ের ব্যাপ্তি বাড়বে এবং চক্রান্তকারীরা আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠবে। এর সঙ্গে যদি যোগ করি দেশের ভেতরকার ক্রমবর্ধমান জঙ্গী তৎপরতা এবং এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিক জঙ্গী সংগঠনের সঙ্গে এদেশীয় জঙ্গীদের যোগসাজশ, তাহলে ভীত হওয়ার যথেষ্ট কারণ থেকে যায়। দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি সকল প্রকার আস্থা রেখেই বলছি, যতদিন না এইসব জঙ্গীকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয়ার ক্ষেত্রে সামাজিক ও রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা বন্ধ হবে, ততদিন তাদের পক্ষে এদেরকে নির্মূল করা কোনভাবেই সম্ভব হবে না। বরং আসছে সময়ে তারাই হয়ে উঠবে এদেশে রাজনীতির প্রধান নিয়ামক। জনগণকে বিভ্রান্ত করার রাজনীতিতে যারা বিগত কয়েক দশকে সফলতার পরিচয় দিয়েছে, যারা গণজাগরণ মঞ্চের বিপরীতে হেফাজতকে দাঁড় করানোর রাজনীতিতে সফলতা অর্জন করেছে, তারা এই বিস্তৃত জঙ্গী নেটওয়ার্ককে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলে কাজে লাগাতে সফল হবে না, সেটা ভাববার কি কোন কারণ আছে? মনে হয় নেই। তাহলে বিষয়টা দাঁড়াচ্ছে কি? তার মানে হচ্ছে, সরকারের চেয়ে প্রধানমন্ত্রীর জনপ্রিয়তা বাড়ার যে পরিকল্পিত সংবাদ প্রচার করা হচ্ছে, তার অন্তরালেও রয়েছে রাজনীতি এবং এই রাজনীতি সর্বতোভাবে তারাই করছে, যারা নিকটতম সময়ে দেশের ভেতর ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক বিপ্লব সংঘটনের স্বপ্নে বিভোর হয়ে আছে। তারা মনে করছে যে, উপযুক্ত সময়ে দেশের ভেতরকার জঙ্গীদের তারা একটি প্ল্যাটফরমে নিয়ে আসতে সক্ষম হবে এবং তাদের দিয়ে সরকারকে উৎখাত করায়ও সফল হওয়া যেতে পারে। আমরা ধরেই নিতে পারি যে, এই মধ্যবর্তী সময়ে সরকারের ব্যর্থতাগুলোকে রঙ-চঙ চড়িয়ে প্রকাশের ক্ষেত্র তৈরি হবে এবং তখন এসব জরিপ যেন কোনভাবেই সরকারের পক্ষে ইতিবাচক দৃষ্টান্ত তৈরি করতে না পারে, সে জন্য আগে থেকেই শিরোনামে ‘সরকারের চেয়ে প্রধানমন্ত্রীর জনপ্রিয়তা বেশি’ বাক্য ব্যবহার করে রাখা। হয়ত আমার সঙ্গে অনেকেই এ নিয়ে দ্বিমত পোষণ করতে পারেন, আমিও খুশিই হব সে রকম কিছু না হলে; কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতির গতি-প্রকৃতি কিছুটা জানা-বোঝা আছে বলে ঘরপোড়া গরুর মতো সিঁদুরে মেঘ দেখলেই ভীত হয়ে উঠি। ৯ সেপ্টেম্বর, বুধবার ॥ ২০১৫ ॥ [email protected]
×