ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

দাম কমাতে তৎপর শক্তিশালী সিন্ডিকেট চক্র ;###;ওঁৎ পেতে আছে পাচারকারীরা, ঝুঁকিতে রফতানি বাণিজ্য;###;সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ ছাড়া চ্যালেঞ্জে পড়বে চামড়া অর্থনীতি

চামড়া নিয়ে কারসাজি ॥ অপকৌশল আঁটছেন ট্যানারি মালিকরা

প্রকাশিত: ০৫:১৯, ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৫

চামড়া নিয়ে কারসাজি ॥ অপকৌশল আঁটছেন ট্যানারি মালিকরা

এম শাহজাহান ॥ কোরবানির চামড়া খয়রাতি দামে কিনতে এবারও অপকৌশল আঁটছেন ট্যানারি মালিকরা। এ কারণে চামড়ার আগাম দরদাম নির্ধারণ নিয়ে নিজেদের মধ্যে মতানৈক্য তৈরি হয়েছে। এ শিল্পের উদ্যোক্তাদের অপকৌশল, পুরনো ধ্যান-ধারণা ও মানসিকতার পরিবর্তন না হওয়ায় সম্ভাবনাময় চামড়া শিল্প মুখ তুলে দাঁড়াতে পারছে না। প্রকল্প চালু হওয়ার দীর্ঘ বারো বছরে হাজারীবাগ থেকে সাভারে স্থানান্তর হতে পারেনি চামড়া শিল্পনগরী। এছাড়া অভ্যন্তরীণ কিছু সঙ্কটের কারণেও চামড়া রফতানির প্রবৃদ্ধি সেভাবে বাড়ছে না। বিশেষ করে লবণ, কেমিক্যাল, শ্রমমূল্য ও গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বেড়ে যাওয়ায় চামড়া শিল্প খারাপ সময় অতিবাহিত করছে। ঝুঁকির মুখে রয়েছে এ খাতের রফতানি বাণিজ্য। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের। জানা গেছে, কোরবানি সামনে রেখে কম দামে চামড়া কিনতে ট্যানারি মালিকরা বিভিন্ন কারসাজির আশ্রয় নিচ্ছে। কাঁচা চামড়ার দাম কমাতে তৎপর হয়ে উঠেছে এ শিল্পের শক্তিশালী সিন্ডিকেট চক্র। একচেটিয়া ব্যবসার আড়ালে বর্তমান চামড়া শিল্প নিয়ন্ত্রণ করছে ১৫৫টি কারখানা। আড়ত মালিক, পাইকার ও ফড়িয়াসহ সবাই জিম্মি ট্যানারি মালিকদের কাছে। কারণ চামড়া শেষ অবধি এদের কাছে বিক্রির জন্য আনতে হবে। পাশাপাশি পাচারকারীরাও মুখিয়ে আছে কম দামে চামড়া কেনার এ সুযোগ নিতে। প্রতিবেশী রাষ্ট্রে দাম বেশি হওয়ার সুবাধে কোরবানির চামড়ার একটি বড় অংশ পাচার হবে সেখানে। ওঁৎপেতে আছে পাচারকারীরা এ আশঙ্কা সরকারের গোয়েন্দা সংস্থারও। রফতানিতে দ্বিতীয় অবস্থানে জায়গা করে নেয়ার পরও শুধু ট্যানারি মালিকদের চরম গাফিলতি ও মনোপলি ব্যবসার কারণে চামড়া শিল্প সম্প্রসারণ হতে পারছে না বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন। জানা গেছে, মনোপলি ব্যবসার সুযোগ নিয়ে দাম নির্ধারণ হয় বলে কখনই চামড়ার ন্যায্যমূল্য পায় না ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা। মাঠ পর্যায়ের চাষীরাও বঞ্চিত হয় ন্যায্য দাম থেকে। এতে চামড়া শিল্পের অর্থনীতিতে সঙ্কট দিন দিন প্রকট হচ্ছে। ভারত থেকে গরু আমদানি কমে যাওয়ায় দেশে কাঁচা চামড়ার সঙ্কট তৈরি হওয়ার আশঙ্কা করছে সরকার। এতে দেশে দ্রুত বিকাশমান পাদকুা শিল্প কাঁচামাল সঙ্কটে পড়তে পারে। সঠিক পরিকল্পনা নিয়ে এগোলে ভবিষ্যতে পোশাক শিল্পের ন্যায় আরেকটি অতি সম্ভাবনাময় খাত হয়ে উঠতে পারে এ শিল্প। এদিকে আগামী ডিসেম্বর মাসের মধ্যে হাজারীবাগ থেকে ১৫৫টি ট্যানারি সাভারে স্থানান্তর করতে সরকারী বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এখানেও ট্যানারি শিল্প মালিকদের চরম গাফিলতি রয়েছে বলে মনে করছে সরকার। তাই এবার ঘোষিত সময়ের মধ্যে কারখানা সরিয়ে নিতে ব্যর্থ হলে তাদের প্লট বাতিল করা হবে। কারণ আগামী বছরের জুন মাসে চামড়া শিল্পনগরী নামের এ প্রকল্পটির মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে সরকারের খরচ হবে ১ হাজার ৭৮ কোটি ৭১ লাখ টাকা। এতে কারখানা স্থানান্তরে ক্ষতিপূরণ হিসেবে ২শ’ ৫০ কোটি টাকা পাচ্ছেন ট্যানারি মালিকরা। শুধু তাই নয়, কাঁচা চামড়া কিনতে এবারও সাড়ে ৪শ’ থেকে ৫শ’ কোটি টাকা ঋণ দেবে সরকার। যদিও ট্যানারি মালিকদের দাবি ১ হাজার কোটি টাকার ঋণ। এতসবের পরও ঘোষিত সময়ের মধ্যে হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি সাভারে স্থানান্তর হবে কিনা, তা নিয়ে সন্দেহ পোষণ করেছেন চামড়া শিল্পনগরী গড়ে তোলার জন্য নিয়োজিত প্রকল্প পরিচালক মোঃ সিরাজুল হায়দার। কারণ কোরবানি সামনে রেখে ট্যানারি মালিকদের ভাবনা এখন কাঁচা চামড়া নিয়ে। যত কম পয়সায়, এমনকি পানির দামে চাই এ চামড়া। তাই আগে-ভাগে নানা অজুহাত দাঁড় করানো হচ্ছে। ‘বিশ্ববাজারে দাম কম’ কিংবা ‘পঞ্চাশ ভাগ চামড়ার মজুদ আছে বিক্রির অভাবে’Ñ এসব পুরনো ও অযৌক্তিক কথা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আবার সামনে নিয়ে আসা হচ্ছে। এ খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সঠিক পরিকল্পনা নিয়ে একটি পরিপূর্ণ রোডম্যাপ প্রণয়ন না হলে নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে দেশের চামড়া শিল্পের অর্থনীতি। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (রফতানি) মোঃ শওকত আলী ওয়ারেছী জনকণ্ঠকে বলেন, এবার কোরবানিতে কাঁচা চামড়া সঙ্কটের আশঙ্কা করা হচ্ছে। চাহিদামতো গবাদিপশু সরবরাহের বিষয়টি নিশ্চিত না হলে কোরবানি কমে যেতে পারে। এছাড়া প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত থেকে গরু আমদানির বিষয়টি এখন আর আগের মতো নেই। কোরবানি সামনে রেখে গরু এলেও বছরের অন্যান্য সময় ওইভাবে আসতে পারেনি। এ কারণে অভ্যন্তরীণ বাজারে মাংস ও চামড়ার দাম এখন বেশি। তিনি বলেন, ব্যবসায়ীরা কম দামে চামড়া কিনতে ৫০ ভাগ মজুদের কথা বলছে। তাদের এ বক্তব্য সঠিক নয়। এটা এক ধরনের কৌশলমাত্র। বাস্তব অবস্থা হলো কাঁচা চামড়া নিয়ে আমরা চিন্তিত। আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশী চামড়ার আলাদা গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ক্রাস্ট চামড়ার পাশাপাশি চামড়াজাত পণ্যের রফতানিও বেড়েছে। বিশেষ করে চামড়ার তৈরি জুতা, ব্যাগ, স্যান্ডেল ও বেল্টসহ প্রভৃতি জিনিসের চাহিদা বাড়ছে বিশ্ববাজারে। তিনি বলেন, এ শিল্পে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ বাড়ায় চামড়ার অভ্যন্তরীণ চাহিদাও বেড়ে গেছে। দেশের প্রধান রফতানি পণ্য গার্মেন্টসের পরই এখন চামড়া শিল্পের অবস্থান। তাই চামড়া শিল্প রক্ষায় একটি পরিপূর্ণ রোডম্যাপ প্রয়োজন। সরকার সে বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে এখন কাজ করছে। জানা গেছে, চামড়া শিল্প শতভাগ দেশীয় কাঁচামালনির্ভর রফতানিমুখী শিল্প খাত। এ শিল্পের সঙ্গে বর্তমান ২২০টিরও বেশি ট্যানারি, সাড়ে ৩ হাজার ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প এবং ১১০ বৃহৎ শিল্প জড়িত রয়েছে। এসব কারখানায় বছরে ২৫ কোটি বর্গফুটেরও বেশি চামড়া উৎপাদিত হয়। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এ শিল্প খাতে প্রায় ৭০ লাখ দক্ষ ও অদক্ষ লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। শতকরা ৯০ ভাগ মূল্য সংযোজনের সুযোগ রয়েছে চামড়া শিল্পে। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যমতে, গত ২০১৩-১৪ অর্থবছরে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রফতানি খাত থেকে আয় হয়েছে ১ দশমিক ৩০ বিলিয়ন ডলার, যা আগের বছরের তুলনায় প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩২ দশমিক ১২ শতাংশ। গত অর্থবছরে এ খাতের রফতানি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৪০ শতাংশ। পরিবেশবান্ধব চামড়া উৎপাদন শুরু হলে বছরে রফতানি হবে ৫ বিলিয়ন ডলারের চামড়া ও চামড়াজাতপণ্য। শুধু তাই নয়, পর্যায়ক্রমে এই রফতানি ১৬ বিলিয়ন ডলারে নিয়ে যাওয়া সম্ভব বলে মনে করেন চামড়া খাতের বিনিয়োগকারীরা। জানতে চাইলে এ প্রসঙ্গে চামড়া শিল্পনগরীর প্রকল্প পরিচালক মোঃ সিরাজুল হায়দার জনকণ্ঠকে বলেন, তৈরি পোশাকের পরই রফতানিতে চামড়া শিল্পের অবস্থান। শতভাগ দেশীয় কাঁচামালনির্ভর রফতানিমুখী এ শিল্প খাতটির সম্ভাবনা ব্যাপক। এজন্য পরিবেশবান্ধব চামড়া শিল্পনগরী গড়ে তোলা হচ্ছে সাভারে। ট্যানারি মালিকদের দায়ী করে তিনি বলেন, সরকারী সহযোগিতা পাওয়ার পরও তাদের মানসিকতার পরিবর্তন হয়নি। তবে এখন তারা বুঝতে পারছেন আর হাজারীবাগে থাকা সম্ভব নয়, তাই তারা সাভারের হেমায়েতপুরের চামড়া শিল্পনগরীতে কারখানা স্থানান্তরে অবকাঠামো উন্নয়নে কাজ করছেন। তিনি বলেন, চামড়া শিল্পনগরী গড়ে তুলতে ২০০৩ সালে বিসিকের আওতায় একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। সেই প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছে ২০১৬ সালের জুন মাসে। ওই সময়ের আগে সরকার প্রকল্পটি পুরোপুরি চালু করার চেষ্টা করছে। তিনি বলেন, ট্যানারি মালিকদের গড়িমসির কারণেই বারো বছরে প্রকল্পটি সম্পন্ন হতে পারেনি। চামড়া শিল্পনগরী প্রকল্পে সরকারের ব্যয় ॥ হাজারীবাগ থেকে আপন ভুবনে স্থানান্তর হচ্ছে ১৫৫ ট্যানারি। এজন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে ১২ বছর। এই ভুবনের নাম চামড়া শিল্পনগরী। নগরীটির অবস্থান ঢাকার অদূরে সাভারের হরিণধরায়। নদী তীরে ২০০ একর জমির উপর গড়ে তোলা হচ্ছে পরিবেশবান্ধব চামড়া শিল্পনগরী। এটিই হচ্ছে ট্যানারি কারখানাগুলোর আসল ঠিকানা। ট্যানারিগুলোকে সেখানে স্থায়ী করতে এখন পুরোদমে চলছে অবকাঠামো উন্নয়নের কাজ। এজন্য সব ধরনের প্রস্তুতি ও তাগিদ রয়েছে সরকারের। আগামী বছরের জুন মাসে চামড়া শিল্পনগরী নামের এ প্রকল্পটির মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছে। এ প্রকল্পের মোট ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে ১ হাজার ৭৮ কোটি ৭১ লাখ টাকা। পরিবেশবান্ধব চামড়া শিল্পনগরী গড়তে হাজারীবাগ থেকে চামড়া শিল্পসমূহ স্থানান্তরের লক্ষ্যে ২০০৩ সালে বিসিকের আওতায় ১৭৫ কোটি ৭৫ লাখ টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। পরিবেশবান্ধব চামড়া শিল্পনগরী গড়ে তুলতে সিইটিপি (কমন ইফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্লান্ট) ও ডাম্পিং ইয়ার্ড নির্মাণ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এতে সরকারের মোট ব্যয় হবে ৬০০ কোটি টাকা। এছাড়া ইতোমধ্যে পরিবেশ অধিদফতরের ছাড়পত্র গ্রহণ, প্রশাসনিক ভবন নির্মাণ, পুলিশ ফাঁড়ি নির্মাণ, ফায়ার ব্রিগেড শেড নির্মাণ, পাম্প ড্রাইভারস কোয়ার্টার নির্মাণ, প্রবেশ সড়ক নির্মাণ, অভ্যন্তরীণ রাস্তা নির্মাণ, ড্রেন ও কালভার্ট নির্মাণ, সীমানা প্রাচীর নির্মাণ, পানি সরবরাহ পাইপলাইন নির্মাণ, গভীর নলকূপ স্থাপন, কেন্দ্রীয় পানি সরবরাহ ব্যবস্থা, বিদ্যুত লাইন নির্মাণ, আরইটি কর্তৃক ১০ এমভি ক্যাপাসিটিসম্পন্ন দুটি বৈদ্যুতিক উপকেন্দ্র স্থাপন, গ্যাসলাইন স্থাপন, যানবাহন ক্রয়, জনবল নিয়োগ, বিটিএ এবং বিএফএলএলএফইএ’র আওতাধীন ১৫৫টি শিল্প ইউনিটের অনুকূলে ২০৫টি প্লট বরাদ্দ প্রদান কার্যক্রম সম্পন্ন করা হয়েছে। চামড়ার দর নির্ধারণ চায় না ট্যানারি মালিকরা ॥ মাঠপর্যায়ের প্রান্তিক ব্যবসায়ী, এতিম, অসহায় ও ভিক্ষুকদের কথা বিবেচনায় নিয়ে সাধারণত চামড়ার দরদাম নির্ধারণ করে দেয়া হয়। কিন্তু এবার দর নির্ধারণ করা হবে না বলে জানা গেছে। এ নিয়ে ট্যানারি মালিক ও আড়ত ব্যবসায়ীদের মধ্যে ইতোমধ্যে বিরোধ দেখা দিয়েছে। ট্যানারি মালিকরা দাম নির্ধারণের ঘোর বিরোধিতা করছেন। আগামী ১৪ সেপ্টেম্বর সোমবার দরদাম সংক্রান্ত একটি বৈঠক ডেকেছে বাংলাদেশ ফিনিশড লেদার, লেদার গুডস এ্যান্ড ফুটওয়্যার এক্সপোর্টার্স এ্যাসোসিয়েশন। ওই বৈঠকে বাংলাদেশ ট্যানার্স এ্যাসোসিয়েশন এবং বাংলাদেশ হাইড স্কিন এ্যান্ড মার্চেন্টস এ্যাসোসিয়েশনের সদস্যদেরও আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। মূলত এই তিন সংগঠনের পক্ষ থেকে যৌথ সিদ্ধান্ত নিয়ে কাঁচা চামড়ার দর নির্ধারণ করা হবে কিনা, সে বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ফিনিশড লেদার, লেদার গুডস এ্যান্ড ফুটওয়্যার এক্সপোর্টার্স এ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএল-এলএফইএ) সভাপতি ইঞ্জিনিয়ার এম আবু তাহের জনকণ্ঠকে বলেন, চামড়ার দর নির্ধারণ করা ঠিক হবে না। দর নির্ধারণ করা হলেও মাঠপর্যায়ে বেশি দামে চামড়া কেনাবেচা হয়। অতীতে এটা নিয়ে বড় ধরনের সমস্যা তৈরি হয়েছে। তাই তিন সমিতির পক্ষ থেকে চামড়ার দর নির্ধারণের ব্যাপারে আপত্তি জানানো হবে। তিনি বলেন, তাদের মোকামে প্রায় ৫০ শতাংশ চামড়ার মজুদ রয়েছে। এই বাস্তবতায় এ বছর চামড়ার দাম কম হবে। ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে হলে কম দামে চামড়া কিনতে হবে। তবে দাম কম হওয়ার কারণে চামড়া পাচার হওয়ার আশঙ্কাও ব্যক্ত করেছেন তিনি। পোস্তার আড়ত ব্যবসায়ীরা চান এ বছর চামড়ার দর নির্ধারণ করা হোক। এছাড়া বাংলাদেশ ট্যানার্স এ্যাসোসিয়েশন এ ব্যাপারে এখনও তাদের সিদ্ধান্ত জানায়নি। কোরবানির সঠিক তথ্য যাচাই-বাছাই করা হবে ॥ প্রতিবছর বাংলাদেশে কী পরিমাণ গবাদিপশু কোরবানি হয়ে থাকে তার কোন সঠিক পরিসংখ্যান নেই। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একটি তথ্য থেকে জানা গেছে, সারাবছর যে পরিমাণ গবাদিপশু জবাই হয় তার প্রায় ৪০ শতাংশ হয়ে থাকে কোরবানির সময়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ হিসাব মতে, দেশে এখন গরুর সংখ্যা ২ কোটি ৮৬ লাখ। এর মধ্যে ১ কোটি ৭৫ লাখ গাভী। এছাড়া প্রাণিসম্পদ অধিদফতর ও মাংস ব্যবসায়ীদের হিসাবে, দেশে বছরে ১ কোটি ৪০ লাখের মতো গরু ও মহিষ জবাই হয়। অন্য একটি সূত্র বলছে, কোরবানি ঈদে প্রায় ৭০ লাখ গরু ও মহিষের চাহিদা রয়েছে। কিন্তু এখন দেশে কোরবানি দেয়ার মতো গরু ও মহিষের মজুদ রয়েছে ৬০ লাখ। সেই হিসাবে ১০ লাখ গরুর ঘাটতি রয়েছে। এ কারণে কোরবানির সময় গরু আমদানির প্রয়োজন রয়েছে। সম্প্রতি সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেন, ঈদের জন্য দেশে ৩০ লাখ গরু-মহিষ, ৬৯ লাখ ছাগল রয়েছে। তাই আগামী ঈদ-উল-আযহায় কোরবানির পশুর কোন সঙ্কট থাকবে না বলে ভোক্তাদের আশ্বস্ত করেছে বাণিজ্যমন্ত্রী। এদিকে বিএফএলএলএফইএ’র সভাপতি ইঞ্জিনিয়ার এম আবু তাহের জানান, কোরবানির সময় ৪০ লাখ গরু-মহিষ জবাই করা হয়। এছাড়া ৬০ লাখ ছাগল, ভেড়া ও বকরি জবাই করা হয়ে থাকে। আরেকটি সূত্র দাবি করেছে কোরবানির সময় ৩০-৩৫ লাখ গরু-মহিষের চাহিদা রয়েছে। বিভিন্ন তথ্যে বিভিন্ন ধরনের পরিসংখ্যান থাকায় এবার সঠিক তথ্য যাচাই-বাছাই করবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। প্রয়োজনে বিবিএসের সহায়তায় কোরবানির সঠিক সংখ্যা নিরূপণ করা হবে। দেশে ব্যবহার হচ্ছে ৩৫-৪০ শতাংশ চামড়া ॥ জানা গেছে, চামড়া শিল্পের ৯০ শতাংশ কাঁচামাল দেশে উৎপাদিত হচ্ছে। পাদুকা ও অন্যান্য পণ্য তৈরিতে উৎপাদিত পাকা চামড়ার ৩৫-৪০ শতাংশ ব্যবহার করা হচ্ছে। ওই হিসাবে চামড়ার সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা গেলে চামড়াজাত পণ্য ও পাদুকা শিল্পের প্রসার পাঁচগুণ বাড়ানো সম্ভব। রফতানিতে চামড়া শিল্পের অবস্থান এখন দ্বিতীয়। জানতে চাইলে এ প্রসঙ্গে লেদার গুডস এ্যান্ড ফুটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স এ্যান্ড এক্সপোর্টার্স এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের উপদেষ্টা হাজী বেলাল হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, প্রতিবছর পাদুকা শিল্পে বিনিয়োগ বাড়ছে। আশার খবর হলো, বিদেশীরা এ শিল্পে বিনিয়োগে উৎসাহিত হচ্ছেন। তিনি বলেন, এরই মধ্যে অন্তত ৫৫টি প্রতিষ্ঠান যৌথ বিনিয়োগের জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেছে। শুধু তাই নয়, জুতা প্রস্ততকারী দেশ চীন এখন বিশ্ববাজার থেকে নিজেদের সরিয়ে নিচ্ছে। জানা গেছে, চামড়ার জুতা উৎপাদনকারী প্রধান দেশ চীন, ভিয়তেনাম এবং ব্রাজিল এ খাত থেকে ধীরে ধীরে নিজেদের গুটিয়ে নিচ্ছে। এ কারণে গার্মেন্ট শিল্পের পর চামড়া শিল্পই এখন বিদেশী বিনিয়োগ আসার সবচেয়ে সম্ভাবনাময় খাত। লেদার খাত সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, দেশে বর্তমানে ১১৫টি রফতানিমুখী কারখানায় চামড়ার পাদুকা তৈরি করা হচ্ছে। এর মধ্যে এপেক্স, এফবি, পিকার্ড বাংলাদেশ, জেনিস, আকিজ, আরএমএম বেঙ্গল এবং বে’র রয়েছে নিজস্ব ট্যানারি ও চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা। কোরবানির সময় নষ্ট হচ্ছে ৩০ ভাগ চামড়া ॥ অদক্ষ্য কসাই ও আনারি কারিগর দিয়ে কোরবানির পশু থেকে চামড়া ছাড়ানো ও সঠিক সংরক্ষণের অভাবে প্রতিবছর উৎপাদিত চামড়ার প্রায় ৩০ শতাংশ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। পশু থেকে চামড়া ছাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে লবণ এবং কেমিক্যাল দিয়ে তা সংরক্ষণ করতে হয়। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে এ নিয়ম অনুসরণ করা হয় না বলে চামড়া নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ হাইড স্কিন এ্যান্ড মার্চেন্ট এ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি আলী হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, প্রতিবছর ৩০ শতাংশ চামড়া নষ্ট হচ্ছে শুধু সঠিকভাবে সংরক্ষণ না করায়। সারাদেশ থেকে কোরবানির চামড়া ট্যানারি ও আড়তে আসতে প্রায় দেড় মাস সময় লাগে। এ সময়ের মধ্যে প্রায় ৩০ শতাংশ চামড়া পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যায়। কোরবানির সময় এ বিষয়টি নিয়ে সরকারের সচেতনতামূলক প্রচারণা প্রয়োজন। এজন্য সংবাদপত্র, রেডিও এবং টেলিভিশনের সহযোগিতা নেয়া যেতে পারে।
×