ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

শিল্পী তাজুল ইসলাম ও লক্ষণ সূত্রধর

গ্যালারি চিত্রকে ট্যাপেস্ট্রি প্রদর্শনী

প্রকাশিত: ০৮:৪২, ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৫

গ্যালারি চিত্রকে ট্যাপেস্ট্রি প্রদর্শনী

সাজু আহমেদ ॥ ট্যাপেস্ট্রি তথা বয়নচিত্র শিল্পবিশ্বের অন্যতম একটি সমৃদ্ধ শিল্প মাধ্যম। বিশ্বে শিল্প হিসেবে যে সব মাধ্যম রয়েছে তার মধ্যে ট্যাপেস্ট্রিই সবচেয়ে ভিন্নধারার, ব্যয়বহুল ও শ্রমসাধ্য। এ কারণে সভ্যতা বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে শিল্পের অন্যান্য মাধ্যম চাহিদা অনুযায়ী বিকশিত হলেও এই শিল্পটি ঠিক ততটা বিকাশ লাভ করেনি। জনপ্রিয়তা কিংবা বহুল পরিচিতি লাভ করেনি। তবে যারা শ্রমসাধ্য এ শিল্প নিয়ে কাজ করেছেন তারা নিজ দক্ষতাগুণেই কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ প্রশংসিত হয়েছেন, পুরস্কৃত হয়েছেন। আমাদের দেশে অন্যান্য শিল্প মাধ্যম থেকে অপেক্ষাকৃত কম পরিচিত পাওয়া এ মাধ্যম আদতে নতুন নয়। ৫০০-৬০০ বছর আগেও পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে শিল্পীরা এই মাধ্যমের অনেক কাজ করে গেছেন। বিশেষভাবে বলা যায় আগে থেইে আমাদের দেশে ঘরের মেঝেতে ব্যবহারের জন্য শতরঞ্জি বা কার্পেট হিসেবে এই ট্যাপেস্ট্রি বা বয়নশিল্পের প্রচলন হয়ে আসছে। এ ধরনের সৃষ্টিই আসলে ট্যাপেস্ট্রি শিল্প। বাংলাদেশে এ শিল্পের প্রথম শিল্পী রশিদ চৌধুরী। তিনিই প্রথম (১৯৬৫-১৯৮৬ সাল পর্যন্ত) এ মাধ্যমে তার শিল্পকর্মের দক্ষতা প্রদর্শন করেন। তার অধীনে ওই সময় তার সহকারী ছিলেন আরেক শিল্প প্রতিভা তাজুল ইসলাম। তিনিও বর্তমানে স্বপ্রতিভায় উদ্ভাসিত। তিনি এ শিল্পের একটি ধারা তৈরিতেও সক্ষম হয়েছেন। তারই অনুপ্রেরণায় আরও একজন এ শিল্পে বিশেষ দীক্ষা নিয়েছেন তিনি লক্ষণ সূত্রধর। সম্ভাবনাময় এই শিল্পের বিকাশ, প্রচার এবং প্রসারের লক্ষ্যে এই শিল্প প্রদর্শনীর উদ্যোগ নিয়েছে গ্যালারি চিত্রক। জানা গেছে, রাজধানীর ধানম-ির গ্যালারি চিত্রকে আগামীকাল শুক্রবার থেকে শুরু হচ্ছে দেশের প্রতিভাবান শিল্পী তাজুল ইসলাম এবং লক্ষণ সূত্রধরের ১০ দিনব্যাপী যৌথবাবে ট্যাপেস্ট্রি প্রদর্শনী। আগামীকাল সন্ধ্যা ৬টায় এ প্রদর্শনীর উদ্বোধন করবেন বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক নজরুল ইসলাম। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন শান্ত-মারিয়াম ইউনিভার্সিটি এ্যান্ড ক্রিয়েটিভ টেকনোলজির ফেকোল্টি অব ফাইন এ্যান্ড পারফর্মিং আর্ট বিভাগের ডিন অধ্যাপক মিজানুর রাহিম। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন সামিট গ্রুপের চেয়ারম্যান বিশিষ্ট শিল্পবোদ্ধা মুহাম্মদ আজিজ খান। উপস্থিত থাকবেন গ্যালারি চিত্রকের নির্বাহী পরিচালক মোঃ মুনিরুজ্জামান। প্রদর্শনীতে তাজুল ইসলামের ২৮টি এবং লক্ষণ সূত্রধরের ২৫ মোট ৫৩টি চিত্র স্থান পাবে। প্রদর্শনীটি আগামী ২০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত চলবে। শিল্পী তাজুল ইসলাম প্রসঙ্গে আরেক কিংবদন্তি শিল্পী মনিরুল ইসলাম বলেন, বর্তমানে সমকালীন শিল্পীদের মধ্যে ট্যাপেস্ট্রির জগতে তাজুল অন্যতম। গত ৪৭ বছর ধরে তাজুল ইসলাম ট্যাপেস্ট্রির জগত নিয়ে কাজ করছেন। বাংলাদেশে এ শিল্পের প্রথম শিল্পী রশিদ চৌধুরীর সহকর্মী হিসেবে তাজুল কাজের দক্ষতা অর্জনের সুযোগ পান। এরপর থেকে তিনিএকান্তভাবে নিজের চিন্তায় একাগ্রচিত্তে অনেক কাজ করেছেন। বর্তমানে তার কাজে নিজস্ব ধারা ও ব্যক্তিত্ব ফুটে উঠেছে। তার গভীর চিন্তাধারা প্রকাশের ধারাবাহিকতায় তাজুল বর্তমানে এ মাধ্যমে বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। তার কাজ আজ বিভিন্ন শিল্প রসিকরা ব্যাপকভাবে বিভিন্ন সংস্থার জন্য সংগ্রহ করেছেন। আমাদের দেশে অল্প সংখ্যক শিল্পীই এ মাধ্যমে কাজ করে থাকেন। আমি বহু বছর যাবত তাজুলের কাজ ও ব্যক্তিত্বের সঙ্গে পরিচিত। আমি তার এই প্রদর্শনীর সাফল্য কামনা করি। এই সঙ্গে ট্যাপেস্ট্রি মাধ্যমটি বিকাশের জন্য বাংলাদেশে তাজুল যে অশেষ শ্রম ও মেধা দিয়ে চেষ্টা করছেন, সে জন্য তাকে বিশেষ মূল্যায়ন করা দরকার। প্রদর্শনীতে অংশ নেয়া শিল্পী তাজুল ইসলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচকলা বিভাগ থেকে ১৯৬৮ সালে বিএফএ এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৭৪ সালে এমএফএ পাস করেন। ১৯৬৫-৭৯ সাল পর্যন্ত শিল্পী রশিদ চৌধুরীর ট্যাপেস্ট্রি স্টুডিওতে তার ডিজাইন সহকারী হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। ১৯৭৯-২০০২ সাল পর্যন্ত বিজেএমসির বাগদাদ-ঢাকা কার্পেট ফ্যাক্টরিতে সিনিয়র ডিজাইনার পদে কর্মরত থাকা অবস্থায় যুগোশ্লাভিয়া, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে প্রশিক্ষণ ও আন্তর্জাতিক কার্পেট ফেয়ারে অংশগ্রহণ করেন। ২০০৯ সালের ২৪ জুন থেকে ২০১০ সালের ২৩ জুন পর্যন্ত ওমানে পাবলি অথোরিটি ফর ক্রাফটস ইন্ডাস্ট্রিজের অধীনে হাতে তৈরি কার্পেট বুনন ও উৎপাদনের জন্য প্রশিক্ষক পদে যুক্ত ছিলেন। ১৯৮১ সালে ‘বাটা’ আন্তর্জাতিক আর্ট প্রতিযোগিতায় বিশেষ পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৮৭ সালে বিজেএমসি থেকে ক্রিয়েটিভ কার্পেট ডিজাইন উদ্ভাবন ও উৎপাদন ক্ষেত্রে বিশেষ পুরস্কার অর্জন করেন। ২০০৭-২০০৮ সালে সম্মাননা পদক এবং ২০১০ সালে বাংলাদেশ সরকারের অধীনে জেডিপিসি আয়োজিত প্রতিযোগিতায় শ্রেষ্ঠ উদ্যোক্তা পদক পান। ২০০২ সালে ব্যবস্থাপক (ডিজাইন) হিসেবে কর্মরত অবস্থায় গোল্ডেন হ্যান্ডসেক পেয়ে অবসর গ্রহণ করেন। তার ৯টি একক চিত্রপ্রদর্শনীর মধ্যে ৭টি হয়েছে ট্যাপেস্ট্রি মাধ্যমে। বিভিন্ন সময়ে তিনি জাতীয় ও দ্বিবার্ষিক এশীয় চারুকলা প্রদর্শনীতে অংশ নেন। বহু শিল্প রসিক ও সমঝদাররা তাঁর ট্যাপেস্ট্রি সংগ্রহ করেছেন। এছাড়া আরেক শিল্পী লক্ষণ সূত্রধর ১৯৭৪ সালে তৎকালীন ঢাকা চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয় থেকে বিএফএ কোর্স সম্পন্ন করেন। তিনি তার কর্মজীবনে ১৯৮০-২০০৭ পর্যন্ত বাংলাদেশ স্কাউটস এ সিনিয়র শিল্পী হিসেবে কর্মরত ছিলেন। বর্তমানে তিনি বুলবুল ললিতকলা একাডেমিতে শিক্ষকতার পাশাপাশি স্বাধীন শিল্পী হিসেবে ট্যাপেস্ট্রি জল রং ও অন্যান্য মাধ্যমে কাজ করছেন। এছাড়া প্রায় তিন বছর আগে বিসিক এ অনুষ্ঠিত বয়ন চিত্রকর্মশালায় অংশ নেন। শিল্পী তাজুল ইসলামের অধীনে ওই কর্মশালায় কোর্স সম্পন্ন করার পর একাগ্রচিত্তে বয়নচিত্র করতে থাকেন। তার কাজ দেখে মুগ্ধ হোন তাজুল ইসলামসহ অনেকেই। এ আয়োজন প্র্রসঙ্গে তাজুল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, বয়ন চিত্র নিয়ে আয়োজিত এ প্রদর্শনীতে আমার সঙ্গে অংশ নিচ্ছেন লক্ষণ সূত্রধর। আশা করি প্রদর্শনীতে স্থান পাওয়া কাজগুলো দর্শকদের আকর্ষণ করতে সক্ষম হবে। এ আয়োজনের মাধ্যমে অনেকে এ মাধ্যমে কাজ শিখতে আগ্রহী হবে। পাশাপাশি এ আয়োজন এ শিল্পের উত্তরোত্তর প্রসার ঘটবে বলে আমি বিশ্বাস করি।
×