ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ঈদ ও পুজো সামনে রেখে তৎপর জাল টাকার কারবারিরা

প্রকাশিত: ০৬:২৮, ৯ সেপ্টেম্বর ২০১৫

ঈদ ও পুজো সামনে রেখে তৎপর জাল টাকার কারবারিরা

রহিম শেখ ॥ চলতি মাসের শেষ সপ্তাহে মুসলমানদের ধর্মীয় বড় উৎসব ঈদ-উল-আযহা উদযাাপিত হবে। উৎসবকে কেন্দ্র করে রাজধানীসহ সারা দেশে কোরবানি পশুরহাট কেনাবেচায় জমে উঠবে। শুধু রাজধানীতে ১৬টি স্থানে হাট বসবে। আগামী মাসে অনুষ্ঠিত হবে হিন্দু ধর্মাবলম্বীর সবচেয়ে বড় উৎসব শারদীয় দুর্গাপুজো। বড় দুই উৎসবকে সামনে রেখে তৎপর জাল টাকার কারবারিরা। এবারের দুই উৎসবে বাজারে জাল টাকার কারবারিদের দৌরাত্ম্য ঠেকাতে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এবারের পশুর হাটে নতুন-পুরনো মিলে প্রায় এক হাজার জাল নোট শনাক্তকারী মেশিন নিয়ে সতর্ক অবস্থানে থাকবেন বিভিন্ন ব্যাংক ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। এছাড়া দেশের বিভিন্ন স্থানে জাল নোট প্রতিরোধে সচেতনতামূলক ভিডিও প্রদর্শন, গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপন ও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে প্রচারণা চালানো হবে। এদিকে জামিনে থাকা জাল নোট কারবারিদের ওপর বিশেষ নজর রাখতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে অনুরোধ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সূত্র জানায়, চলতি মাসের ২৫ সেপ্টেম্বর ঈদ-উল-আযহা অনুষ্ঠিত হতে পারে। এর সপ্তাহ দুয়েক আগে থেকেই কোরবানি পশু কেনার হাট জমে উঠবে। এ ছাড়া উপহারসামগ্রীসহ পোশাক-আশাক কেনার ধুম পড়বে। পরের মাসে ২৩ অক্টোবর অনুষ্ঠিত হবে হিন্দুদের সবচেয়ে বড় উৎসব দুর্গাপুজো। এই দুই উৎসবে বিপুল পরিমাণ নগদ টাকার লেনদেন বাড়বে। বিপুল পরিমাণ নগদ টাকার লেনদেনের এ সময়ে সক্রিয় হয়ে ওঠে জাল টাকার কারবারিরা। জানা গেছে, জাল নোট তৈরি ও বাজারজাতের সঙ্গে জড়িত রয়েছে বেশ কয়েকটি চক্র। এদের সঙ্গে কিছু অসৎ ব্যাংক কর্মকর্তা-কর্মচারীও জড়িত। তাদের মধ্যে কয়েকটি চক্রকে শনাক্ত করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। বাংলাদেশ ব্যাংকের জাল নোট প্রচলন প্রতিরোধ বিষয়ক এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, দেশে প্রচলিত নোটের মধ্যে ৫০০ ও ১০০০ টাকা মূল্যমানের নোটই বেশি পরিমাণে জাল হচ্ছে। জাল নোট তৈরির সরঞ্জাম ও নোটসহ যেসব প্রতারক চক্র ধরা পড়েছে তার বেশিরভাগই ওইসব নোটের জালকারী। ৫০ ও ১০০ টাকা মূল্যমানের নোট এখন জাল হচ্ছে না বললেই চলে। প্রতিবেদনে আর বলা হয়, জাল নোটসহ গ্রেফতার করা চক্রের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ থাকলেও এ ক্ষেত্রে জোরালো কোন ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। বিছিন্নভাবে যেসব জাল নোট উদ্ধার করা হয়, ওসব মামলায় যাদের সাক্ষী করা হয় তারা নিয়মিত সাক্ষ্য দিতে আসে না। ফলে মামলাগুলো নিষ্পত্তি হচ্ছে না। আর যেগুলোর নিষ্পত্তি হচ্ছে সেগুলোয় সাজা হচ্ছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে জাল টাকা প্রতিরোধ কমিটির সভায় বার বার বিষয়টি তুলে ধরা হলেও নেয়া হচ্ছে না কার্র্যকর কোন উদ্যোগ। অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, এক হাজার টাকার মতো বড় নোটই জাল হয় বেশি। উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহারে ছাপানো এসব জাল টাকা মানুষের হাত ঘুরে চলে আসে নগদ লেনদেনের সবচেয়ে ব্যস্ততম জায়গা ব্যাংকের ক্যাশ কাউন্টারেও। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যাংক কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে বলেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রে পুরাতন টাকার ওপর ছাপ বসানো হয়, যা জাল টাকা শনাক্তকারী মেশিন ধরতে পারে না। তিনি আরও বলেন, এজন্য প্রতিটি টাকার নোট দেখে শনাক্ত করে রাখতে হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, পশুর হাটে নোট জালকারী চক্রের অপতৎপরতা রোধকল্পে দেশের সব সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা ও থানা পর্যায়ের অনুমোদিত কোরবানির পশুর হাটে বাংলাদেশ ব্যাংক ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সহযোগিতায় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো বিরতিহীনভাবে জাল নোট যাচাইসংক্রান্ত সেবা প্রদান করবে। এবার রাজধানীতে দুই সিটি কর্পোরেশন কর্তৃক নির্ধারিত ১৬টি স্থানে পশুর হাট বসবে। এসব পশুর হাটে ৪১টি ব্যাংকের মাধ্যমে জাল নোট শনাক্তকারী মেশিন স্থাপন করা হবে। ইতোমধ্যে এসব হাটে ক্রেতা-বিক্রেতাদের জাল টাকার নোটসংক্রান্ত সেবা দেয়ার জন্য বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। একেকটি হাটকে একেকটি ব্যাংকের জন্য নির্দিষ্ট করে দেয়া হবে। এটি সরাসরি তত্ত্বাবধান করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। ঢাকার বাইরে যেসব জেলায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শাখা অফিস রয়েছে সেখানেও ওই শাখা অফিস তত্ত্বাবধান করবে। যেখানে শাখা অফিস নেই সেখানে সোনালী ব্যাংকের নির্ধারিত শাখার (চেস্ট শাখা) মাধ্যমে বাজার তদারকি করা হবে। এ ছাড়া জাল টাকার কারবারিদের ওপর নজর রাখতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে অনুরোধ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এক চিঠিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে প্রাপ্ত সম্ভাব্য কারবারি এবং জামিনে থাকা কারবারিদের ওপর বিশেষ নজর রাখতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে অনুরোধ করেছে। এ ছাড়া গ্রেফতারকৃতরা যেন আইনের আওতায় শাস্তি পায় সে ধরনের পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে। জানা গেছে, এবারের পশুর হাটগুলোয় নতুন-পুরনো মিলে প্রায় এক হাজার জাল নোট শনাক্তকারী মেশিন নিয়ে সতর্ক অবস্থানে থাকবেন বিভিন্ন ব্যাংক ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। সারাদেশের ২৪০টি হাটে এ মেশিন দেয়া হবে। গত ঈদে ২০০টি জাল নোট শনাক্তকরণ মেশিন বিতরণ করা হয়েছিল। আসল নোট চেনার সহজ উপায় ॥ সম্প্রতি জাল টাকা প্রতিরোধে আসল নোটের বৈশিষ্ট্যসংবলিত বিজ্ঞাপন প্রচারের উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতি সংবলিত ১০০, ৫০০ ও ১ হাজার টাকার নোট লেনদেনের ক্ষেত্রে প্রধান চারটি নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা হয়েছে বিজ্ঞাপনটিতে। ১। প্রত্যেক প্রকার নোটেই মূল্যমান এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের লোগো সংবলিত নিরাপত্তা সুতা রয়েছে। নোটের মূল্যমান এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের লোগো নিরাপত্তা সুতার ৪টি স্থানে মুদ্রিত আছে। নোট চিত করে ধরলে নিরাপত্তা সুতায় মূল্যমান এবং লোগো দেখা যাবে। কিন্তু কাত করে খাড়াভাবে ধরলে তা কালো দেখা যাবে। এ নিরাপত্তা সুতা অনেক মজবুত বা নোটের কাগজের অবিচ্ছেদ্য অংশ। নখের আঁচড়ে বা মুচড়িয়ে উক্ত নিরাপত্তা সুতা কোনক্রমেই ওঠানো সম্ভব নয়। জাল নোটে নিরাপত্তা সুতা সহজেই নখের আঁচড়ে বা মুচড়ানোতে উঠে যায়। ২। প্রত্যেক প্রকার নোটের উপরের ডানদিকে কোণায় ইংরেজী সংখ্যায় লেখা নোটের মূল্যমান রং পরিবর্তনশীল কালিতে মুদ্রিত রয়েছে। ১০০ ও ১০০০ টাকা মূল্যমানের নোট আস্তে আস্তে নড়াচড়া করলে নোটের মূল্যমান লেখাটি সোনালী হতে ক্রমেই সবুজ রং-এ পরিবর্তিত হয়। একইভাবে ৫০০ টাকা মূল্যমানের নোটে ৫০০ মূল্যমান লেখাটি লালচে হতে পরিবর্তিত হয়ে সবুজ হয়। জাল নোটে ব্যবহৃত এ রং চকচকে করলেও তা পরিবর্তিত হয় না। ৩। প্রত্যেক প্রকার নোটের সম্মুখ ও পশ্চাদপৃষ্ঠের ডিজাইন, মধ্যভাগের লেখা, নোটের মূল্যমান এবং ৭টি সমান্তরাল সরলরেখা উঁচু-নিচু (খসখসে) ভাবে মুদ্রিত আছে। তাছাড়া, নোটের ডানদিকে ১০০ টাকার নোটে ৩টি, ৫০০ টাকার নোটে ৪টি এবং ১০০০ টাকার নোটে ৫টি ছোট বৃত্তাকার ছাপ আছে যা হাতের স্পর্শে উঁচু-নিচু (খসখসে) অনুভূত হয়। ৪। প্রত্যেক প্রকার নোটে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি, বাংলাদেশ ব্যাংকের মনোগ্রাম এবং নোটের মূল্যমান জলছাপ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের মনোগ্রাম এবং নোটের মূল্যমান প্রতিকৃতির তুলনায় উজ্জ্বল দেখাবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের বিজ্ঞাপনটিতে আরও বলা হয়, এ সকল বৈশিষ্ট্য জাল নোটে সংযোজন করা সম্ভব নয়।
×