ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

আঘাত নারীর ওপর

প্রকাশিত: ০৬:৫২, ৮ সেপ্টেম্বর ২০১৫

আঘাত নারীর ওপর

বাংলাদেশের নারী সমাজের ওপর হাজার বছর ধরে আরোপিত সামাজিক-পারিবারিক দৃষ্টিভঙ্গি ও আচরণগত কারণে যে কোন সঙ্কটে-সমস্যায় বড় আঘাতটা আসে নারীর ওপরই। সেটি পারিবারিক বা সামাজিক হোক, কিংবা হোক বৈশ্বিক বা প্রকৃতিগত। অথচ নারী-পুরুষ উভয়েরই সমান অংশভাগ থাকা সমীচীন সব বিষয়েই। নজরুলের কবিতা তো আর অসত্য হতে পারে না! সেই কত যুগ আগে তিনি বলে গেছেন- ‘বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর/ অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।’ অথচ নারীর অবদানকে অস্বীকার করার প্রবণতা চলে আসছে শত শত বছর ধরে। কী সুখে কী দুঃখে, কী সংগ্রামে কী সংসারে নারীকেই কেন বইতে হবে অধিক গুরুভার? পালাপার্বণে নারীই দেয় বেশি শ্রম, আবার পরিবারের কষ্টের সময়ে তারই কষ্টের ভাগ বেশি। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পড়ছে প্রকৃতি ও মানব জাতির ওপর। মানব জাতি বলতে নারী ও পুরুষের সম্মিলিত জগৎ সংসার। তাহলে এই জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে নারী কেন বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে? এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজা জরুরী। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে নারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। একই কারণে নারীদের ওপর গৃহস্থালি কাজে বোঝা বৃদ্ধিসহ পারিবারিক নির্যাতন, নারীর প্রতি সহিংসতা ও যৌন হয়রানির ঝুঁকিও বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশে আঞ্চলিক পর্যায়ে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে নারীদের কর্মসংস্থানহীনতাও বেড়েছে। ‘জেন্ডার বিশ্লেষণ : বাংলাদেশে স্থানীয় পর্যায়ে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এবং এর সামাজিক ও অর্থনৈতিক মূল্য’ আমাদের শঙ্কিত করে তোলে। জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কিছু অঞ্চলে নারীকে পানি আনার জন্য দিনে ৩-৬ ঘণ্টা ব্যয় করতে হচ্ছে। বাংলাদেশের মতো জলাভূমি ভরপুর বহুল বৃষ্টিপাতের দেশটিতে প্রাকৃতিকভাবে সুপেয় পানির সঙ্কট থাকার কথা ছিল না। সমস্যা হয়েছে জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে। সেচ ব্যবস্থায় পাম্প প্রক্রিয়ায় ক্রমাগত ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের কারণে তলদেশের পানির প্রবাহ হ্রাস পেয়েও সুপেয় পানি সঙ্কটের সৃষ্টি হয়েছে। দেশের দক্ষিণে রয়েছে বঙ্গোপসাগর, লোনা পানির বিশাল পারাবার। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে জোয়ার বা জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা বাড়ছে। বিশেষ করে ২০০৯ সালে আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড় আইলায় খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট অঞ্চলের উপকূলীয় বাঁধ ছিন্নভিন্ন হয়ে লোনা পানি ঢুকে যাওয়ার পর ওই এলাকায় সুপেয় পানির তীব্র সঙ্কট বিরাজ করছে। সুপেয় পানি সংগ্রহের কাজে নারীই প্রধান ভূমিকা পালন করছে। সামাজিকভাবে এই কাজ নারীদেরই, এমন একটি ধারণা প্রতিষ্ঠিত থাকার ফলে নারী একতরফাভাবে কষ্ট করছে অনেক ক্ষেত্রেই। এ অবস্থার পরিবর্তনে প্রয়াসী সমাজের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ। নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং তার সার্বিক উন্নয়নের জন্য যা যা করা দরকার সরকার তা করবে- এমনটা মানুষের প্রত্যাশা। এমন সমাজ নির্মাণই আমাদের লক্ষ্য, যেখানে নারী নিজেকে বিপন্ন এবং বৈষম্যের শিকার বলে ভাববে না। একই সঙ্গে একটি বিষয় অভিভাবকদের গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে। পরিবারে ছেলে সন্তানটিকে এমনভাবে গড়ে তুলতে হবে যেন সে মেয়েদের সম্মান করতে শেখে। নারীর ওপর যে কোন ধরনের নির্যাতনের প্রতিবাদ করতে শেখে। পারিবারিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা অবশ্যই জরুরী। একপেশেভাবে নারী ক্ষতিগ্রস্ত হোক- এমনটা কোন সভ্য মানুষের কাম্য হতে পারে না। ঘরে-বাইরে শ্রম, সংগ্রাম, কষ্ট ও ক্ষতির দায়ভাগ নারীর সঙ্গে সমানভাবে পুরুষ তার কাঁধে তুলে নেবে- এটাই সুস্থ ও ভারসাম্যপূর্ণ সমাজের নীতি হওয়া প্রত্যাশিত।
×