ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সংস্কৃতি সংবাদ

বিলম্বিত আয়োজনে সুরের স্নিগ্ধতায় নজরুল স্মরণ

প্রকাশিত: ০৫:৪৭, ৭ সেপ্টেম্বর ২০১৫

বিলম্বিত আয়োজনে সুরের স্নিগ্ধতায় নজরুল স্মরণ

স্টাফ রিপোর্টার ॥ জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের প্রয়াণবার্ষিকী ছিল গত বারোই ভাদ্র। আর দ্রোহ প্রেম, সাম্য ও মানবতার এই কবিকে স্মরণ করা হলো বাইশে ভাদ্র রবিবার। দশদিনের এই বিলম্বিত আয়োজনে কবিকে স্মরণ করল বাংলাদেশ নজরুলসঙ্গীত সংস্থা। শরতের সন্ধ্যায় শিল্পকলা একাডেমির সঙ্গীত ও নৃত্যকলা মিলনায়তনে সুরের স্নিগ্ধতায় শ্রদ্ধা নিবেদন করা হলো কবিকে। অন্যদিকে এখন পর্যন্ত কবির মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠানসূচী ঘোষণা করেনি নজরুল চর্চাভিত্তিক আরেক সংগঠন নজরুলসঙ্গীত শিল্পী পরিষদ। তবে এত দীর্ঘ বিরতি দিয়ে জাতীয় কবির প্রয়াণবার্ষিকী পালনের কোন অর্থবহ জবাব খুঁজে পাওয়া যায় না সংগঠকদের পক্ষ থেকে। বিলম্বে কবিকে স্মরণের এ আয়োজনে সংস্থার সাধারণ সম্পাদক খায়রুল আনাম শাকিল বলেন, আসলে বিশেষ কোন কারণ নেই। কবির প্রয়াণবার্ষিকীর দিনটিতে শিল্পীদের বিভিন্ন সরকারী অনুষ্ঠানের ব্যস্ততা থাকে। আরেকটি সমস্যা হচ্ছে অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য সঠিক সময়ে মিলনায়তন বরাদ্দ পাওয়া যায় না। এছাড়া একজন শিল্পী একাধিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত থাকার কারণেও অনুষ্ঠান আয়োজনে সমস্যা সৃষ্টি হয়। তবে ভবিষ্যতে এ ধরনের আয়োজন যাতে সঠিক সময়ে হয় সেজন্য কয়েক মাস আগে থেকেই আমরা প্রস্তুতি গ্রহণ করব। বাঙালীর প্রাণের কবি নজরুলকে স্মরণের আয়োজনটি নির্ধারিত সময়ের চেয়ে বেশ দেরিতে হলেও ছিল না আন্তরিকতার ঘাটতি। শিল্পীদের প্রাণের উচ্ছ্বাসে সুরের বৈভবে শ্রোতার অন্তর সিক্ত করে কবিকে জানানো হয় শ্রদ্ধাঞ্জলি। নবীন-প্রবীণ শিল্পীরা পরিবেশন করেন কবির রচিত গান। নজরুলসঙ্গীতের মাধুর্য ছড়িয়ে পড়ে মিলনায়তনজুড়ে। অনুষ্ঠানের শুরুতে স্বাগত বক্তব্য রাখেন সংস্থার সভাপতি খালিদ হোসেন। শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক খায়রুল আনাম শাকিল। সংক্ষিপ্ত কথন শেষে মিলনাতয়নে ভেসে বেড়ায় নজরুলের সুরের মূর্ছনা। মঞ্চে আসেন একঝাঁক শিল্পী। অনেক কণ্ঠ এক সুরে গেয়ে শোনায়Ñজাগো অমৃত পিয়া ও মৃত্যু নাই নাই দুঃখ শিরোনামের দুটি সম্মেলক সঙ্গীত। এর পর সালাউদ্দিন আহমদের ভরাটকণ্ঠে গীত হয় ভুল করে যদি ভালোবেসে থাকি...। কুহুকুহু কোয়েলিয়া গানটি পরিবেশন করেন বিজনচন্দ্র মিস্ত্রী। পিয়া গেছে কবে পরদেশ গানটি গেয়ে শোনান মাহমুদুল হাসান। রেজাউল করিমের কণ্ঠে গীত হয় ওগো অন্তঃযামী ভক্তের তব...। আফরোজা খান মিতার গাওয়ার গানের শিরোনাম ছিল নয়ন ভরা জল...। বিদায় সন্ধ্যায় আসিল শীর্ষক সঙ্গীত পরিবেশন করেন বনা রাণী হালদার। উম্মে জোহরা হকের কণ্ঠে গীত হয় প্রিয়তম এত প্রেম....। দাঁড়ালে দুয়ারে মোর গানটি পরিবেশন করেন ইউসুফ আহমেদ। খায়রুল আনাম শাকিল গেয়ে শোনান বসিয়া বিজনে...। কবিকে স্মরণ করে ডাঃ শাওলী গাইলেন আমি চিরতরে দূরে চলে যাব...। এছাড়াও সুরের মায়াজাল বুনে একককণ্ঠে গান শোনান খালিদ হোসেন, ড. লীনা তাপসী খান, জোসেফ কমল রড্রিক্স, করিম হাসান খান, ইয়াকুব আলী খান, নাসিমা শাহীন ফ্যান্সি, সুস্মিতা দেবনাথ শুচি, জান্নাত এ ফেরদৌসী, শহীদ খান, আহমেদ মায়া আখতারী, উম্মে জোহরা হক, ইউসুফ আহমেদ প্রমুখ। শিল্পীদের গাওয়া অন্য কয়েকটি গানের শিরোনাম ছিলÑ শাওন আসিল ফিরে, ভুলে যেও ভুলে যেও, এ আঁখি জল মোছ, মোর প্রথম মনের মুকুল, কেমনে রাখি বারি ও পরদেশী বধূয়া। সঙ্গীতের এ অনুষ্ঠানে ভিন্ন মাত্রা যোগ করে কবিতাপাঠ। নজরুলের কবিতা থেকে আবৃত্তি করেন বাকশিল্পী শিমুল মুস্তাফা ও রূপা চক্রবর্তী। গঙ্গা-যমুনা উৎসবে মঞ্চস্থ দুই নাটক ॥ জমে ওঠা গঙ্গা-যমুনা নাট্য ও সাংস্কৃতিক উৎসবের তৃতীয় দিন ছিল রবিবার। এদিন বিকেলের গান, কবিতা, নৃত্য ও পথনাটক পরিবেশনা শেষে সন্ধ্যায় মঞ্চস্থ হলো দুটি মঞ্চনাটক। উৎসব প্রাঙ্গণ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালা মিলনায়তনে মঞ্চস্থ হয় চট্টগ্রামের নাট্যদল উত্তরাধিকারের প্রযোজনা সাম্পান নাইয়া। আর এক্সপেরিমেন্টাল থিয়েটার হলে মঞ্চস্থ হয় শব্দ নাট্যচর্চা কেন্দ্রের নাটক ইনফরমার। আমিনুর রহমান মুকুলের নির্দেশনায় সাম্পান নাইয়া নাটকের নির্দেশনা দিয়েছেন মোসলেম উদ্দিন সিকদার। নাটকের কাহিনী আবর্তিত হয়েছে দক্ষিণ চট্টগ্রামের উপকূলবর্তী জেলে জনগোষ্ঠীকে কেন্দ্র করে। কুতুবদিয়া থেকে ইন্দ্রপুল পর্যন্ত বিস্তৃত এ নাট্যকাহিনীতে জেলেদের যাপিত জীবনের সংগ্রাম, তাদের নানামুখী জীবনসংঘাত, স্বপ্নপরিকল্পনা, সমাজবাস্তবতা প্রভৃতি উঠে এসেছে নিবিড় বিশ্বস্ততায়। শ্রেণীহীন শোষণমুক্ত এক সমাজ অনুসন্ধান সাম্পান নাইয়া নাটকের অন্যতম প্রতিপাদ্য বিষয়। এ নাটকের কাহিনী গ্রন্থনে লোকভাবনা নির্মাণে লোক উপকরণের প্রয়োগ প্রভৃতি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বাংলা নাটকের দেশজ আঙ্গিক অনুশীলনের চেষ্টা করা হয়েছে। প্রযোজনাটির বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেন সুমন বড়ুয়া, বিটু ভৌমিক, মাহমুদ রাসেল, অর্ণা দাশ, গুলশান আরা বন্নি, অসিত দাশ পুলক, কংকন দাশ। শান্তনু বিশ্বাসের রচনায় ইনফরমার নাটকের নির্দেশনা দিয়েছেন খোরশেদুল আলম। মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে আবর্তিত হয়েছে নাটকের কাহিনী। এ নাটকের অন্যতম চরিত্র শেখ জামান। তার সাহসিকতা, প্রত্যুৎপন্নমতিতা, দেশপ্রেম উঠে এসেছে এ নাটকে। মুক্তিযুদ্ধকালে পাকসেনাদের সংবাদ সরবরাহকারী হিসেবে শেখ জামান নিযুক্ত হলেও সে মূলত কাজ করেছে মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে। নারীসম্ভোগ এবং মদ্যপানের প্রলোভন দেখিয়ে পাকসেনাদের সে নিয়ে আসে নিজ গ্রামে। এক পর্যায়ে কৌশলে সে হত্যা করে পাক সেনা অফিসারদের। এজন্য অবশ্য চরম মূল্য দিতে হয়েছে জামানকে। পাকসেনারা তাকে নির্মমভাবে হত্যা করে। মুক্তিযুদ্ধে গ্রামের সহজ-সরল সাধারণ মানুষের অসাধারণ সাহসিকতা এবং আত্মত্যাগের নাট্যচিত্র ‘ইনফরমার’। প্রযোজনাটির বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেন মোহাম্মদ উল্লাহ মাহমুদ, সিকদার মুকিত, আব্দুল হাদী, ইসমাইল হোসেন, হাসিব সরকার রওশন জান্নাত রুশনী প্রমুখ। তৃতীয় দিনের উৎসবে বিকেলে নাট্যশালার উন্মুক্ত মঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। এ পর্বে আজব বাক্স শিরোনামের পথনাটক পরিবেশন করে চন্দ্রকলা থিয়েটার। আবৃত্তি পরিবেশন করে প্রকাশ সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সংগঠন। সম্মেলক সঙ্গীত পরিবেশন করে ক্রান্তি শিল্পী গোষ্ঠী। নৃত্য পরিবেশন করে ভোরের পাখি নৃত্যকলা কেন্দ্র। সঙ্গীতগুণী অজিত রায়ের স্মরণানুষ্ঠান ॥ বরেণ্য কণ্ঠশিল্পী, সুরকার, সঙ্গীত পরিচালক ও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সংগঠক অজিত রায়। অনন্য কণ্ঠের অধিকারী এই প্রথিতযশা রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী ছিলেন বাংলাদেশের সঙ্গীত ভুবনের উজ্জ্বল নক্ষত্র। আর শুধু শিল্পী কিংবা সঙ্গীতজ্ঞ নয়, বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনেও ছিল তাঁর সরব পদচারণা। এই সঙ্গীতগুণীর চতুর্থ মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে স্মৃতিচারণ ও সঙ্গীতানুষ্ঠানের আয়োজন করে তাঁরই প্রতিষ্ঠিত সংগঠন অভ্যুদয় সঙ্গীত অঙ্গন। রবিবার সন্ধ্যায় চট্টগ্রামে থিয়েটার ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে এ স্মরণানুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক সুমন বসাকের স্বাগত বক্তব্যের পর আলোচনাসভায় অজিত রায়ের সঙ্গীতজীবন এবং একাত্তরের মুক্তির সংগ্রামে তাঁর ভূমিকার কথা তুলে ধরেন প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. অনুপম সেন এবং শিক্ষাবিদ ও সঙ্গীতজ্ঞ হাসিনা জাকারিয়া বেলা। সভাপতিত্ব করেন শিল্পী প্রদ্যোৎ মজুমদার। অনুষ্ঠান শুরু হয় কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতা থেকে গানে রূপান্তরিত ‘হে মহামানব’ শীর্ষক সম্মেলক পরিবেশনার মাধ্যমে। এরপর রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশন শাশ্বতী তালুকদার ও তৃপ্তি দাশ। শেষ পর্বে বাংলাদেশের সাঙ্গীতিক ইতিহাসে অমর হয়ে থাকা অজিত রায় সুরারোপিত ১২টি গান পরিবেশন করেন অভ্যুদয়ের শিল্পীরা। এ পর্বটি পরিচালনা করেন অজিত রায়ের মেয়ে কণ্ঠশিল্পী শ্রেয়সী রায়।
×